• facebook
  • twitter
Thursday, 21 November, 2024

পুলিশের উর্দি ছেড়ে বীরভূমের ভোট-ময়দানে দেবাশিস

খেলার মাঠে বিপরীতে লোক পেলেন তিনবারের সাংসদ শতাব্দী খায়রুল আনাম: নাচতে না জানলে যেমন উঠোন বাঁকার কথা বলা হয় তেমনি, ভোট-ময়দানে নেমে যাঁরা খেলেন, তাঁদের মধ্যে একজনের জয়ের মধ্যে দিয়ে অন্যদের পরাজয় নিশ্চিত হয়৷ তখনও পরাজিতদের গলায় ভোট- ময়দানে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেমন বহুবিধ অভিযোগ থাকে তেমনি, নিজের দলের খোলায়াড়দেরও কারও কারও বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে বল ঠিকমতো না

খেলার মাঠে বিপরীতে লোক পেলেন তিনবারের সাংসদ শতাব্দী

খায়রুল আনাম: নাচতে না জানলে যেমন উঠোন বাঁকার কথা বলা হয় তেমনি, ভোট-ময়দানে নেমে যাঁরা খেলেন, তাঁদের মধ্যে একজনের জয়ের মধ্যে দিয়ে অন্যদের পরাজয় নিশ্চিত হয়৷ তখনও পরাজিতদের গলায় ভোট- ময়দানে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেমন বহুবিধ অভিযোগ থাকে তেমনি, নিজের দলের খোলায়াড়দেরও কারও কারও বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে বল ঠিকমতো না ঠেলে প্রতিপক্ষকে সুবিধা করে দেওয়ার অভিযোগও ওঠে৷ বীরভূম জেলার দু’টি লোকসভা আসনের মধ্যে সংরক্ষিত বোলপুর লোকসভা আসনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস কংগ্রেস থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে আসা বিদায়ী সাংসদ অসিত কুমার মালকে এবারও দলীয় প্রার্থী করেছে৷ আর অপর আসন বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস তাঁদের তিনবারের তারকা সাংসদ শতাব্দী রায়কে চতুর্থবারের জন্য প্রার্থী করেছে৷ এই মুহূর্তে এই দুই লোকসভা কেন্দ্রের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সংরক্ষিত বোলপুর আসনের জন্য পিয়া সাহার নাম ঘোষণা করতে পারলেও, বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে শতাব্দী রায়ের বিরুদ্ধে কাকে প্রার্থী করবে, তা জানাতে পারছিলো না৷

এমনিতেই সাঁইথিয়ার বাসিন্দা পিয়া সাহাকে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকেই, দলের অভ্যন্তরীণ বিবাদে বিব্রত হতে শুরু করেন তিনি৷ তাঁর বিরুদ্ধে ‘পিয়া হটাও, বিজেপি বাঁচাও’ বলে পোস্টারও পরে৷ পিয়া সাহাও একঅর্থে দলের এক শ্রেণির ‘চাটুকার আর ধান্দাবাজদের’ চক্রবু্যহে বন্দি হয়ে পরেছেন বলেও বলা হয়৷ তবুও তিনি ভোট-প্রচারে ঘুরছেনও৷ অনেক ক্ষেত্রে ‘উদভ্রান্তের মতো এবং ভুল পথে’ ঘুরছেন বা তাঁকে ঘোরানো হচ্ছে বলেও বলা হয়৷

কিন্ত্ত বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী কে, তা নিয়ে দলীয় রাজনীতির জলে যে ঘূর্ণাবর্ত তৈরী হয় তাতে উঠে আসে দলের অতীতের প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ দুধকুমার মণ্ডলের নাম৷ সেইসাথে দলের বীরভূম সাংগঠনিক জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহা এবং দলের রাজ্য নেতা তথা সিউড়ির ভূমিপুত্র জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের নামও ভেসে ওঠে৷ আর এনিয়ে দলের অভ্যন্তীণ দ্বন্দ্বের ঘূর্ণনও বাড়তে থাকে৷

তবে, দুধকুমার মণ্ডলের নামটি ছিলো সবার উপরে৷ কেন্দ্রীয় নেত্রী স্মৃতি জুবিন ইরানি বর্ধমানে দলীয় কর্মসূচিতে এলে সেখানে দুধকুমার মণ্ডল উপস্থিতও ছিলেন৷ আর সেই বৈঠকে স্মৃতি জুবিন ইরানি ধ্রুব সাহাকে ঢুকতেই দেননি৷ তখন থেকেই দুধকুমার মণ্ডলের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি আরও জোরালো হয়৷ বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে তারকা প্রার্থী হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস শতাব্দী রায়কে ২০১৪ সালে দ্বিতীয় বার প্রার্থী করলে বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে তারকা প্রার্থী হিসেবে জয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী করলে তিনি ২ লক্ষ ২৫ হাজার ভোট পেয়ে তাঁর সহ-অভিনেত্রী শতাব্দী রায়ের কাছে পরাজিত হন৷ অথচ ২০১৯ সালে তারকা প্রার্থীর পরিবর্তে বিজেপি দুধকুমার মণ্ডলকে প্রার্থী করলে, তিনি শতাব্দী রায়ের কাছে পরাজিত হলেও জয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে পিছনে ফেলে ৫ লক্ষ ২৫ হাজার ভোট পান৷ সেই পাটিগণিতেই এবারও দুধকুমার মণ্ডলকে বিজেপি প্রার্থী করতে পারে বলে মনে করা হয়৷ দুধকুমার মণ্ডল সেই ইঙ্গিতও দেন৷

কিন্ত্ত জেলায় দলের অভ্যন্তরীণ ‘চোরাগোপ্তা’ আক্রমণের দিকে নজর দিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শতাব্দী রায়ের বিরুদ্ধে এক সময়ের প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ভারতী ঘোষকে বীরভূম কেন্দ্রে প্রার্থী করার কথা ভাবে৷ ভারতী ঘোষ বেশ কয়েকবার জেলাতেও এসেছেন৷ কিন্তি তিনি রাজনৈতিক মাটির গন্ধ শুঁকে এখানে প্রার্থী হতে সম্মত হননি বলেই জানা যায়৷ তখনই রাজ্য সরকারের উপরে ‘রাগান্বিত’ হয়ে নানাভাবে বিব্রত হয়ে বসে থাকা আরেক আইপিএস অফিসার ৪৭ বছরের দেবাশিস ধরের দিকে নজর পড়ে বিজেপির৷ তিনি কোচবিহার জেলা পুলিশ সুপার থাকাকালীন সময়ে ২০২১ সালে শীতকুচিতে ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে অশান্তিতে কেন্দ্রীয়বাহিনীর গুলিতে যে মৃতু্যর ঘটনা ঘটে তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যে রিপোর্ট দেন তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করে রাজ্য৷ তারপর তাঁকে সাসপেণ্ড করা হয়৷ এই সময়ই তাঁর বিরুদ্ধে আয় বহির্ভূত সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার অভিযোগে সিআইডি তদন্ত শুরু হয়৷ যে তদন্ত এখনও চলছে৷

এছাড়াও এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর আর্থিক অনিয়মের যোগের অভিযোগও আনা হয়৷ পাঁচ বছর তাঁকে কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলেও কোনও তদন্তই শেষ হয়নি৷ দেবাশিস ধর ২০০১ সালে কর্মজীবন শুরু করেন জয়েন্ট বিডিও হিসেবে কাজে যোগ দিয়ে৷ বাঁকুড়ার গঙ্গাজল ঘাঁটি ও গলসি-২ ব্লকে কাজ করার পরে তিনি ২০০৪ সালে পুলিশে যোগ দেন৷ ২০০৬ সালের মার্চ থেকে তিন মাস তিনি বীরভূমের সিউড়িতে ডিএসপি, সদর হিসেবে ছিলেন৷ তারপর তিনি বোলপুরের এসডিপিও হন৷ তাই এজেলায় তিনি যেমন অপরিচিত নন তেমনি জেলাও তাঁর অপরিচিত নয়৷ এহেন এক আইপিএস অফিসার যখন ২১ মার্চ চাকরি থেকে ইস্তফা দেন এবং বিতর্ক এড়াতে তিরুপতি মন্দিরে পুজো দিতে চলে যান তখনই, দেবাশিস ধরের বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী হওয়া নিয়ে গুঞ্জন জোরালো হয়৷ বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ রাত্রে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের জন্য দেবাশিস ধরের নাম দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার মধ্যে দিয়ে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী-গুঞ্জনেরও অবসান ঘটে৷

সোমবার ১ এপ্রিল থেকে তিনি প্রচারে নামছেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন৷ তিনি জানিয়েছেন, এই সমাজকে আমার অনেক কিছু দেওয়ার আছে৷ কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে থেকে বেতন পেলেও কাজ করতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠছিলাম৷ আমি যেন কাজ করতে পারি, সেটাই আমার আন্তরিক প্রার্থনা৷ বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের জন্য বিজেপি তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করা নিয়ে কয়েক ঘণ্টা আগেই তীর্যক কটাক্ষ করে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী শতাব্দী রায় বলেছিলেন, ওদের কোনও প্রার্থী নেই৷ কেন দিচ্ছে না, কী করছে, কে আসছে সেটা ওরাই বলতে পারবে৷ তবে, ফুটবল একা একা তো খেলা যায় না৷ আমি যে বলটা মারবো, তার বিপরীতে সামনে আর একজনকে চাই বলটা মারার জন্য৷ সেই একজনই এবার সামনে৷ ভোটের ফলাফলই বলে দেবে, এই খেলার মাঠে গোলটা কে দিলেন৷ সংসদীয় রাজনীতিতে পোক্ত হয়ে ওঠা অভিনেত্রী-সাংসদ না কী, পুলিশের উর্দি ছেড়ে রাজনীতির মাঠে নামা প্রাক্তন আইপিএস অফিসার৷