বিস্ফোরণ কাণ্ডে নিখোঁজদের সন্ধান পেতে পুরস্কার ঘোষণার পোস্টার
খায়রুল আনাম: জেলা বীরভূমের ঝাড়খণ্ড রাজ্য সীমানা লাগোয়া যে বিস্তীর্ণ এলাকা রয়েছে তারমধ্যে দুবরাজপুর, লোকপুর, সদাইপুর, খয়রাশোল থানা এলাকায় অশান্তি, বোমা-গুলি, আগ্নেয়াস্ত্র বারুদের কারবার যেমন অতি সাধারণ বিষয় হয়ে রয়েছে তেমনি, এইসব কারবারের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁরা কখন কোন রাজনৈতিক শিবিরে থাকেন, তারও কোনও সঠিক ঘরের সন্ধান পাওয়া যায় না। এই এলাকার সগরভাঙার খোলামুখ কয়লাখনির দখল নিজেদের কব্জায় রাখতে এলাকার কয়লা মাফিয়ারা হমেশাই রাজনৈতিক শিবির বদল করে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গেই থেকে যান প্রশাসনিক সমীকরণে।
সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয় ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায়। ওই সন্ধ্যায় ঝাড়খণ্ড রাজ্য সীমান্তের লোকপুর থানার গাংপুর গ্রামের বাবলু মণ্ডলের বাড়িতে বিস্ফারণ ঘটলে গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে। গ্রামের বহু মানুষ আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। দেখা যায়, গ্রামের বাবলু মণ্ডলের টিনের ছাউনির দোতলা বাড়ির টিনের চাল সম্পূর্ণভাবে উড়ে গিয়ে অন্যত্র পড়েছে। ঘরের দেওয়ালে দেখা দিয়েছে বড় বড় ফাটল। অভিযোগ ওঠে যে, বাবলু মণ্ডলের দুই ছেলে নিরঞ্জন মণ্ডল ও মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল নানা ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম ও বেআইনিভাবে খোলামুখ কয়লাখনি থেকে কয়লা পাচার করার কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে, এলাকা দখল করতে যে বোমা মজুত করেছিল তাতেই বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু প্রশাসনিক দিক থেকে এব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগও ওঠে।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এক মাসের মধ্যেই স্থানীয় বড়রা, সদাইপুর ও খোয়াজমহম্মদপুরে একই রকমভাবে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়। যার পিছনে ছিল একইভাবে সদাইপুরের রেঙ্গুনি গ্রামের হাইতুন্নেসা খাতুনের গোয়ালঘরে বিস্ফোরণের ঘটনা। পুলিশ সেই সময় জানায়, এইসব ঘটনায় মানুষের কোনও ক্ষতি হয়নি। কোনওভাবে রান্নার গ্যাসের সিলিণ্ডার ফেটে এই ঘটনা ঘটতে পারে। যদিও পরবর্তীতে বলা হয় যে, সিআইডি ঘটনার তদন্ত করছে। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচি ও বিচারপতি বিভাস পট্টনায়কের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয় যে, এই তদন্ত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ করবে। সিআইডি-কে সমস্ত নথি এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে দুই বিচারপতি তাঁদের পর্যবেক্ষণে জানান, আইন অনুযায়ী এই ধরনের ঘটনা ঘটলে রাজ্যের তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-কে একটা প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠায়।
এক্ষেত্রে সেই রিপোর্ট পাঠানো হয়নি। কারণ রাজ্যের পাঠানো ভিত্তিতে এনআইএ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা তদন্ত করবে কিনা। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশের পরেও সিআইডি তাদের নথি দিচ্ছে না বলে এনআইএ কলকাতা হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, কলকাতা হাইকোর্ট তাদের নির্দেশ মানা না হলে সিআইডি-র বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব নেওয়ার কথা জানানোর পরে সিআইডি সমস্ত নথি এনআইএ-র হাতে তুলে দেয়। তারপরই এনআইএ-র তদন্তকারী আধিকারিকরা এলাকায় পৌঁছে তদন্তের কাজ শুরু করতেই অনেকেই গা ঢাকা দেন। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বাবলু মণ্ডলের দুই ছেলে নিরঞ্জন মণ্ডল ও মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল। এই দু’জনকে হাতে পেতে এনআইএ চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তাঁরা নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছে। তাই এবার এনআইএ-র পক্ষ থেকে নিরঞ্জন মণ্ডল ও মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলকে ‘নিরুদ্দেশ’ হিসেবে ঘোষণা করে তাঁদের ছবি-সহ গোটা এলাকা পোস্টারে ছেয়ে ফেলা হয়েছে এবং তাতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, নিরঞ্জন মণ্ডল ও মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের সন্ধান যে দিতে পারবে, তাঁকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এনআইএ এই পোস্টার দেওয়ার পর থেকেই ওই দুই ব্যক্তিকে আর এলাকায় প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।