ওপার বাংলার কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পটপরিবর্তনে ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল !

স্বপনকুমার মণ্ডল

বাংলাদেশের অচলাবস্থার রেশ এখনও কাটেনি। দুশ্চিন্তার ঘনঘটা সরকারি নিষেধাজ্ঞা থেকে আন্দোলন তুলে না নেওয়ার মধ্যেই তা প্রতীয়মান । সোস্যাল মিডিয়াতেও সরকার বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বার্তা এখনও সমান সক্রিয় । যুদ্ধং দেহি মনোভাবের মধ্যে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করার আহ্বান আরও তীব্র,আরও সোচ্চার । সেখানে চাকরিতে কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার বিরোধী বিদ্রোহের অভিমুখ ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে । সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’-এর ভাষায় ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল ! অবশ্য দেশজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার গতিপ্রকৃতি দেখে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল তার নেপথ্যে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ক্ষমতালোভী বিরোধী দলের গভীর ষড়যন্ত্র বর্তমান । সংগঠিত আন্দোলনের অচিরেই বিধ্বংসী আক্রমণে পরিণত হওয়াতে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । আন্দোলনে একের পর এক তরতাজা প্রাণের আত্মবলিদানে আন্দোলন আরও উগ্র মূর্তি লাভ করে, সে দেশের আমজনতাও পাশে এসে দাঁড়ায়,এপারের জনসমর্থনও সক্রিয় হয়ে ওঠে । ছাত্রদের ন্যায্য দাবির প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই এপার বাংলার অনেকেই সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ায় অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় । ছাত্র আন্দোলনের অপরাজেয় শক্তিতে সবার বিশ্বাস তখন টগবগিয়ে ফুটছে । অথচ তার নেপথ্যে যে দেশের জনতার শুধু যোগ নেই, সেইসঙ্গে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও ক্ষমতাকামী বিরোধী রাজনৈতিক দলেরই নিবিড় সংযোগ বিদ্যমান,তা ছাত্র আন্দোলনকে গণবিধ্বংসী বিদ্রোহে রূপান্তর করাতেই ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। একদিকে যখন সরকারি ভাবে দমনপীড়নের মাধ্যমে আন্দোলনকে প্রতিহত করার প্রয়াস চলে,অন্যদিকে তেমনই সেই বিদ্রোহের আবহ রণক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস হতে থাকে, জেলখানা ভেঙে কয়েদিদের মুক্ত করতেও যুদ্ধং দেহি মনোভাব। অসংখ্য কয়েদি পালিয়ে যায়, জেলকর্মীদের ছদ্মবেশে প্রাণ বাঁচাতে হয় । আন্দোলনের তীব্রতায় ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনে সামিল হতে পারত,অথচ তা ক্রমশ সরকার উৎখাতে তীব্র গণঅভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে চলে। শুধু তাই নয়, চাকরির কোটা বিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই ভারতবিরোধী মনোভাব থেকে ধর্মীয় বিদ্বেষভাবনা মিছিলের অগ্রভাগে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সেখানে ‘ভারত যাদের মামার বাড়ি/ বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি’র শ্লোগানে চাকরির কোটার কোনও কথা নেই, বরং কোটর থেকে ধর্মীয় বিদ্বেষে স্বদেশে পরবাসী করার হিংস্রতা বেরিয়ে এসেছে । আবার তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত,তাও জোর দিয়ে বলা যায় না ।

সাতচল্লিশের ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক ভাগবাঁটোয়ারায় যে দেশভাগ হয়েছিল,তাতে সম্প্রতি আসেনি,ধর্মীয় ঐক্যেও দেশের একতা বজায় থাকেনি, উল্টে ধর্মীয় বিদ্বেষের বীজ অচিরেই চিরশত্রুর বিষবৃক্ষে মহীরূহ হয়ে ওঠে । স্বাধীনতার চব্বিশ বছর পর মুসলিমপ্রধান পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয়। সেই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত করায় হিন্দুপ্রধান ভারতের অবদান অনস্বীকার্য । ভারতের সেই উদারতার হাতছানিও সেই বিষবৃক্ষের ছায়ায় সন্দেহের আধার হয়ে ওঠে । তাই ‘মামার বাড়ি’ হয়ে ওঠে স্বামী পরিত্যক্তা মায়ের বাবার বাড়ির শেষ আশ্রয় । সেক্ষেত্রে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের স্বদেশে পরবাসীর জীবন অনিবার্য নিয়তি হয়ে ওঠে, অনেকের সে দেশ ত্যাগে অবশেষে ভারতের আশ্রয়ে ‘মামার বাড়ি’র হাতছানি দেয় । সেই মর্মান্তিক প্রাণান্তকর ধারা আজও অব্যাহত । সেখানে স্বদেশবাসীর প্রতি কোনওরকম মমত্ব নেই, বাঙালির জাতিগত ঐক্যবোধেও নেই একাত্মতার পিছুটান । দেশভাগে বাঙালির মনভাগও হয়ে গেছে । এপারে বাঙালি, ওপারে বাংলাদেশি। বাঙালি জাতির চেয়েও বড় হয়ে ওঠে ধর্মীয় পরিচয় । বাঙালি হলেও হিন্দু বা মুসলিম পরিচয়ই সেক্ষেত্রে শেষ কথা। মুখে বাঙালি বলে ঐক্যবোধ গড়ে তুললেও মনে ধর্মীয় বিদ্বেষ সদা জাগ্রত । সেখানে ওপার বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের অতুলনীয় ভূমিকা স্বাধীন বাংলাদেশেও বিস্তার লাভ করে। আওয়ামী লীগের প্রতি সে দেশের বাঙালি হিন্দুদের সমর্থনের কথা এপারে চলে আসা মানুষের মুখে মুখে । সেখানে সরকারবিরোধী দলের কাছে ধর্মীয় বিদ্বেষই শুধু নয়,ভোটব্যাঙ্কের অভাববোধেও হিন্দুবিদ্বেষী মানসিকতা অতি মাত্রায় সক্রিয় । ধর্মীয় বিদ্বেষের ছলনায় সে দেশের বাঙালি হিন্দুদের বিতাড়ন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে । শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে শত্রুর সম্পত্তি আয়ত্ত করার লক্ষ্যও আস্তিনে গোটানো থাকে । যে-কোনও অছিলায় বাঙালি হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার নেমে আসে। সেদিক থেকে সে দেশের সরকারবিরোধী আন্দোলনে ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে অচিরেই হিন্দুবিদ্বেষী উগ্র সাম্প্রদায়িকতা অনিবার্য হয়ে ওঠে । যেন ভারত থেকে হিন্দুরা সে দেশে গিয়ে জোর করে উপনিবেশ গড়ে বসবাস করছে। ভারতের প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহার বা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের উদার বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতাই সেক্ষেত্রে সে দেশের সরকারবিরোধী দলের ভারতবিরোধীর সঙ্গে হিন্দুবিদ্বেষী মনোভাব আরও তীব্র আকার ধারণ করে। সেখানে ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’র নীতিহীনতায় সে দেশের হিন্দুদের স্বদেশছাড়ার হুমকি দাবিতে পরিণত হয়। কোটা বিরোধী আন্দোলনেও ‘বাংলা’ ছাড়ার শ্লোগান অস্বাভাবিক মনে হলেও তা স্বভাববিরুদ্ধ মনে হয় না । এজন্য অচিরেই সে দেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রতি এপার বাংলার সমর্থন নীরবতায় আত্মগোপন করে ।


অন্যদিকে অভ্যাসে আকর্ষণ কমে, শ্রদ্ধাও শিথিল হয়ে পড়ে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে দীর্ঘ নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসংখ্য যোদ্ধার প্রাণের বিনিময়ে গড়ে ওঠা স্বাধীন বাংলাদেশ তার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে চাকরিতে সংরক্ষণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছে,তাও নজিরবিহীন । প্রতিবেশী ভারত বা পাকিস্তানেও তা লক্ষ করা যায় না । স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উত্তরপুরুষের প্রতি এই বিরল শ্রদ্ধাবোধ দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক ধরে চালু ছিল, তা ভাবলেই সে দেশের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা আনত হয়। এই কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সে বিষয়টি সামনে চলে আসে। সময়ান্তরে সেই শ্রদ্ধাভক্তি উবে যাবে বা তা ধরে রাখার যুক্তি অসার মনে হবে,তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। সেখানে চাকরিতে কোটা বিরোধিতা করে মেধাভিত্তিক করার দাবিকে সামনে রেখে সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টির আন্দোলনও যথাযথ ছিল না। কেননা দাবি ওঠার পরিসরে ১৯১৮তেই সরকারই চাকরিতে কোটা বাতিল করে দেয় । পরে ১৯২১-এর ৫ জুন সে দেশের হাইকোর্টে তা অবৈধ বোধে সরকারি নির্দেশ বাতিল করে দেয়। সরকার এজন্য সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হয় । তার মধ্যেই সরকারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিধ্বংসী আক্রমণ নেমে আসে। সেখানে সরকারকে অস্থির করে আন্দোলনকে তীব্র গতিতে ছড়িয়ে দেওয়ার রণকৌশলে অসংখ্য তাজা প্রাণের হাহাকারকে হাতিয়ার করাটা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। অন্যদিকে শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘস্থায়ী শাসনের কুফলও আন্দোলনকে সক্রিয় করেছে । সরকারের স্থিতিশীলতায় দুর্নীতি ও অরাজকতা স্বাভাবিকতা লাভ করে। শুধু তাই নয়, যত উঁচুতে ওঠা যায়,মাটির সঙ্গে ততই দূরত্ব বাড়ে। শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে সে দেশের মানুষের সংযোগেও দূরত্ব বেড়েছে বলেই আন্দোলনের পরিসর সারা দেশে তা দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে । তাতে শুধু যে সরকারবিরোধী দলের ভূমিকাই সক্রিয় হয়ে উঠেছে,তা নয়। তার সঙ্গে আমজনতার সরকারবিরোধী যোগকে অস্বীকার করা যায় না। সোস্যাল মিডিয়ায় সরকারকে উৎখাত করার মনোভাব এখনও জারি।

অন্যদিকে যে-কোনও কারণেই হোক, সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে দেশের সর্বনাশ করা বা সরকারকে উৎখাত করার অগণতান্ত্রিক মানসিকতা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয় । আবার শুধু দমনপীড়নের মাধ্যমে বেশি দিন দেশও চালানো যায় না,একেবারেই তা প্রত্যাশিত নয় । দেশের আসল রক্ষক তার পুলিশ নয়, দেশের জনগণ। জনগণের সুরক্ষার স্বার্থে সরকার জরুরি, শাসন-শোষণের জন্য নয়। সেখানে সরকারের অপশাসন,অরাজকতা, দুর্নীতির শিকারে শুধু দেশের দুর্দশা নেমে আসে না,সাম্প্রদায়িক হানাহানিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । সে দেশের হিন্দুবিদ্বেষী মানসিকতার নেপথ্যে সরকারবিরোধী মনোভাবকেও অস্বীকার করা যায় না।