পলিগ্রাফ টেস্টে কি আসামী পার পেতে পারে? কীভাবে হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই আধুনিক পরীক্ষা?

পলিগ্রাফ টেস্টে কি প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে? কিভাবে এই পরীক্ষা করা হয়? এবিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত কী? আর জি কর কাণ্ডে প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করতে সাত জনকে আদালত পলিগ্রাফ টেস্টের অনুমতি দেওয়ার পরে সেই প্রশ্নগুলিই এখন রাজ্যবাসীর কাছে প্রধান কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ জানতে চাইছেন, এভাবে কি প্রকৃত অপরাধীদের নাগাল পাওয়া সম্ভব হবে?

এদিকে নির্যাতিতা চিকিৎসকের বাবা ও মা দাবি করেছেন, এই ঘটনায় সঞ্জয় রায় মূল দোষী নয়, পিছনে রয়েছে বড়সড় ষড়যন্ত্র। ঘটনার দিনেই ওই মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ভূমিকা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন ওঠে। তাঁকে ইতিমধ্যেই প্রায় এক সপ্তাহ টানা জেরা করা হয়েছে। এরপর শনিবারই আর জি কর-এর প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও চিকিৎসক সন্দীপ ঘোষের পলিগ্রাফ টেস্ট শুরু হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দাদের কাছে তদন্তে কোথাও একটা বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সেজন্য অভিযুক্ত সঞ্জয় রায় ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ সহ সাতজন সন্দেহভাজনের পলিগ্রাফ টেস্টের অনুমতি দিয়েছে আদালত। এই পলিগ্রাফের অনুমতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের অনেকে কিছুটা স্বস্তি পেলেও অধিকাংশ রাজ্যবাসীর মনে বড় কৌতূহল, আদৌ কি এই পলিগ্রাফ টেস্টে প্রকৃত অপরাধীর সন্ধান পাওয়া যাবে? নাকি সেই তদন্তের ফাঁক ফোকর গলে পার পেয়ে যাবে অপরাধীরা?

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পলিগ্রাফ টেস্ট চলাকালীন অভিযুক্তরা যদি মিথ্যা কথা বলে, তাহলে তার হৃৎ স্পন্দন দ্রুত হয়, বেড়ে যায় রক্তচাপ। এছাড়া অত্যধিক ঘাম হয়, শ্বাস নিতে সমস্যা দেখা যায়, ত্বকের বিভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই সময় তদন্তকারীদের প্রশ্নের উত্তরে কেউ সত্য বলছেন, নাকি মিথ্যা বলছেন তা বোঝা যায়। এভাবে অপরাধী সনাক্ত করতে সুবিধা হয় গোয়েন্দাদের। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কঠোর শাস্তির ভয়ে কোনও অপরাধীই এই তদন্তে নিজেকে ধরা দিতে চাইবে না। সেজন্য সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইবে। এক্ষেত্রে কি সেরকম কোনও কৌশল আছে? যার ফলে অপরাধী পার পেয়ে যেতে পারে? এবিষয়ে চিকিৎসকদের অনেকের মতে, ‘বিষয়টা খুব সহজ নয়। তবে এক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ যদি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অসত্য বলে, তা হলে তা ধরা পড়বে কি না, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।’


প্রসঙ্গত গত ৯ আগস্ট আর জি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার ঘটনায় নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা উপমহাদেশকে। বাংলা তথা দেশজুড়ে দফায় দফায় চলছে জোরদার আন্দোলন অপরাধীর বিচার চায়। কিন্তু, এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে ঠিক কে কে যুক্ত আছেন, তা এখনও এক অজানা রহস্যে মোড়া রয়েছে। এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের শাস্তি দেওয়াটা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে। ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে সিভিক পুলিশ সঞ্জয় রায়। ধৃত অপরাধের কথা স্বীকার করে নিলেও তাকে দফায় দফায় জেরা করেও এখনও সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। একটা বড় ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। কারণ ঘটনার ভয়াবহতা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি এবং ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলছে, এটি একটি সংগঠিত ও সমষ্টিগত অপরাধ। এই ঘটনার সঙ্গে একাধিক ব্যক্তি জড়িত আছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট দেখার পর এবিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রাথমিক অনুমান, এই ঘটনায় শুধু সঞ্জয় রায় নয়, একটি জনগোষ্ঠী জড়িত আছে। সেজন্য এই ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এরকম বহু ব্যক্তিকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। এবার পলিগ্রাফ টেস্ট করে প্রকৃত অপরাধীর নাগাল পেতে চাইছেন গোয়েন্দারা।

তবে এবিষয়ে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন, ‘অভিযুক্তকে প্রতিটি প্রশ্ন তিন বার করে করা হয়। অভিযুক্ত উত্তরে হ্যাঁ এবং না বলেন। যদি তিন বারই একই উত্তর আসে, তা হলে বোঝা যায় যে, তিনি মিথ্যে বলছেন না। আর যদি উত্তরে অসঙ্গতি থাকে, তখনই মনিটরে অভিযুক্তের নানা শারীরিক পরিবর্তন ফুটে ওঠে। তবে পলিগ্রাফ টেস্টের ক্ষেত্রে যে শারীরিক পরিবর্তনগুলি নির্ণায়ক হয়ে ওঠে, সেটা যে সব সময় অসত্য বলার কারণেই হয়, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অনেক সময় ভয়ের কারণেও নাড়িস্পন্দন, হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যেতে পারে। মানসিক চাপ থেকে রক্তচাপও বাড়ে। পরীক্ষা চলাকালীন এই শারীরিক বদল আসা মানেই কেউ সত্যি বলছেন না, সেটাও সব সময় নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায় না। ঠিক সেই কারণেই পলিগ্রাফ টেস্টের রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য নয়। আবার কেউ যদি প্রচণ্ড অপরাধমনস্ক হন, মনের কথা প্রকাশ না করার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে থাকেন, তা হলে পলিগ্রাফ টেস্ট তদন্তে কাজে না-ও আসতে পারে।’

এবিষয়ে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্তের মানসিক দৃঢ়তার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। অনেকের মনের ওপর অত্যন্ত মানসিক নিয়ন্ত্রণ থাকে, আবার অনেকের থাকে না। যাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে, তারা মাদক অবস্থাতেও বেমালুম একই মিথ্যা কথা বার বার বলে যেতে পারে। অন্যদিকে অনেক সময় এমন দেখা যায়, সেই মুহূর্তে যা মনে হচ্ছে, তারই উত্তর দিচ্ছেন অভিযুক্ত। যা পরে তদন্ত করে জানা যায়, সেরকম কিছুই হয়নি। সেজন্য পলিগ্রাফ টেস্টের রিপোর্টের ওপর সব সময় ভরসা করে না আদালত। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অপরাধীর মনের ওপর সব সময় নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সেজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে যায়। কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই পরীক্ষায় সহজে পাশ করে যাওয়ার কোনও কৌশল নেই।