পাঞ্জাবির ছেঁড়া হাতা সেলাই করে পরতেন বুদ্ধদা, স্মৃতি রোমন্থন করলেন কল্যাণী পৌরসভার প্রাক্তন বাম চেয়ারম্যান

অঙ্কিতা আচার্য, নদিয়া: বাম জামানার শেষ সেনাপতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রয়াত। শেষবারের মতো তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় জমিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁর শেষ যাত্রায় স্মৃতিরোমন্থন করলেন নদিয়ার কল্যাণী পৌরসভার প্রাক্তন বাম চেয়ারম্যান অধ্যাপক শান্তনু ঝা।  অধ্যাপক শান্তনু ঝা বলেন, বুদ্ধদার সাথে সরাসরি আলাপ বা একসাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা কবে প্রথম হয়েছিল এটা আমার মনে নেই। ছাত্র অবস্থায় দেখেছি এবং যখন দেখেছি তখন বুদ্ধদা যুব নেতা। পরবর্তী ক্ষেত্রে ওনার পার্টির ক্লাসও করেছি।

অধ্যাপক শান্তনু ঝা আরও বলেন, কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র থেকে ‘মেয়েটি’ বলে একটি নাটক করেছিলাম। আমাদের দলের পক্ষ থেকে বুদ্ধদা’কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল নাটকটি দেখার জন্য। একদিন সকালবেলা হঠাৎ বুদ্ধদা নিজে আমাদের দলের সম্পাদক কিশোরকে ফোন করে আমার খোঁজ করেন। বুদ্ধদা আমাকে প্রত্যক্ষভাবে চিনতেন। আর সভাপতি হিসেবে আমন্ত্রণপত্রে আমার নামটা ছিল। বুদ্ধদা আমাকে জানিয়েছিলেন, আমি একটু ব্যস্ততার কারণে যেতে পারছি না। কিন্তু নাটকটা আমি দেখব। তুমি আরেকটি দিন করো। যদিও ব্যস্ততার কারণে তা হয়নি। কিন্তু একজন মানুষ অতি ব্যস্ততার মাঝে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সেই অবস্থাতেও একটা নাটক দেখার আগ্রহ সম্পর্কে অবগত করছেন সংগঠকদের। এটা বড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক শান্তনু ঝা বলেন, কল্যাণী পৌরসভা তখন আমাদের দখলে। সেবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কল্যাণী স্টেডিয়ামে জনসভা করবেন বুদ্ধদা। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আমাদের যখন জানানো হয়, তখন স্টেডিয়ামটি আমরা কল্যাণী পৌরসভার অধীনে তৈরি করছি। ওটা খেলার জায়গা। আমরা স্টেডিয়ামের বাইরে সভা করব। এক কথায় সেই বক্তব্য গ্রহণ করে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর। খেলাধুলা, সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং সংযুক্তিকরণ না থাকলে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর এবং মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া যে দফতর থেকে কাজ হয় না। তাঁরা আমাদের ওই বক্তব্যকে ভালো চোখে নিতেন না।


তিনি আরও বলেন, সেই জনসভা উপলক্ষে আমরা একটি প্রকাশনা করেছিলাম। তাতে কল্যাণী উৎকর্ষতা শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। আমরা ভালোভাবে খেয়াল করিনি। বুদ্ধদা ওটা হাতে পেয়ে আমার কানের কাছে এসে প্রথমে বললেন, উৎকর্ষতা শব্দটি ভুল, হবে উৎকর্ষ। সংশোধনের সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমাদের নজরে এনেছিলেন। একেবারে অভিভাবক সুলভ। এই ধরনের পরামর্শ প্রতি মুহূর্তে পেতাম বিভিন্ন সময়ে। অসংখ্যবার।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক শান্তনু ঝা আরও বলেন, বুদ্ধদা মজা করতেন। সিগারেট খেতেন। কিন্তু কারোর সামনে খেতেন না। একবার হয়েছিল এমনটা। আমরা কথা বলতে গিয়েছি, তিনি সিগারেট খাচ্ছিলেন। তিনি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন আমাদের কাছে। বলেছিলেন, দেখো তোমরা আছো আমি জানতাম না, সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলেছি। প্রশাসনিক ভবন থেকে রাজনৈতিক চর্চা ও রাজনৈতিক পরিচালনা একেবারেই করতেন না বুদ্ধদা।

অধ্যাপক শান্তনু ঝা বলেন, অত্যন্ত সুভদ্র মানুষ ছিলেন। কফি খেতে ভালোবাসতেন। মজা করতেন। ছোট মাছ খেতে ভালোবাসতেন। খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। আপনারা দেখেছেন ধবধবে পাঞ্জাবি। কিন্তু এটা দেখেননি যে, পাঞ্জাবির হাতের কাছে ছিঁড়ে গিয়েছে, সেটাকে সেলাই করে ঠিকঠাক করে তিনি সেটি ব্যবহার করছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক চর্চা করে গিয়েছেন। পড়াশুনা ও বইয়ের মধ্যেই তিনি থাকতেন। এরকম একজন মানুষ তাঁকে নেতা হিসেবে, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাছ থেকে পাওয়া, ছোট ছোট পরামর্শ থেকে শিক্ষা নেওয়া এ বড় কম কথা নয়। আমি বুদ্ধদার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। উনার অনুজ হিসেবে মনে করি, অনেক কিছু শেখার ওনার কাছ থেকে। ছিল যা সবটা পাইনি। বুদ্ধদা আরও বেশিদিন বাঁচলে আমরা সবাই হয়তো আরও দীক্ষিত হতাম।