• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

ব্রিটেনে লেবার পার্টির জয়জয়কার, ভারত-ব্রিটেন সম্পর্ক কোন পথে?

সর্বাণী মুখোপাধ্যায় বিপুল ভোটে জিতে ১৪ বছর পর ব্রিটেনে ক্ষমতায় এল লেবার পার্টি৷ সে দেশের ৫৮তম প্রধানমন্ত্রী হলেন কিয়ের স্টার্মার৷ যদিও জনমত সমীক্ষায় আগেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে, এবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চলেছে লেবার পার্টি৷ ফলাফল প্রকাশের পরেও দেখা গেল মোট ৬৫০ আসনের মধ্যে ৪১২টি আসনে জিতে সেই সমীক্ষাকেই সত্যি প্রমাণ করেছে লেবার

সর্বাণী মুখোপাধ্যায়

বিপুল ভোটে জিতে ১৪ বছর পর ব্রিটেনে ক্ষমতায় এল লেবার পার্টি৷ সে দেশের ৫৮তম প্রধানমন্ত্রী হলেন কিয়ের স্টার্মার৷ যদিও জনমত সমীক্ষায় আগেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে, এবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চলেছে লেবার পার্টি৷ ফলাফল প্রকাশের পরেও দেখা গেল মোট ৬৫০ আসনের মধ্যে ৪১২টি আসনে জিতে সেই সমীক্ষাকেই সত্যি প্রমাণ করেছে লেবার পার্টি৷ সেই সঙ্গে শেষ হল প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের শাসন৷ তাঁর নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ১২১টি আসন পেয়েছে৷ এমন খারাপ ফল তারা এর আগে কখনও করেছে বলে মনে পড়ে না৷ এখন প্রশ্ন হল, গত প্রায় দেড় দশক ধরে ওয়েস্ট মিনস্টারে ক্ষমতায় ছিলেন কনজারভেটিভরা৷ সুতরাং দীর্ঘদিন পরে বিলেতে পালাবদল হওয়ার পর ভারত-ব্রিটেন সম্পর্ক এবার কোনদিকে গড়াবে? স্টার্মারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার পরে তা ভারতের জন্য ভালো হবে, না খারাপ?

সময়ের পাতা উল্টে যদি পিছন দিকে তাকাই, তবে দেখা যাবে ভারতের সঙ্গে লেবার পার্টির সম্পর্ক ভালোই ছিল৷ কিন্ত্ত জেরেমি করবিন যখন লেবার পার্টির নেতৃত্বে এলেন, তখন থেকেই সেই সম্পর্কের ফাটল ধরে৷ ভারত সম্পর্কে জেরেমির নেতিবাচক মনোভাব লন্ডন ও নয়াদিল্লির মধ্যে দূরত্ব বাড়ায়৷ কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ হওয়ার পর ২০১৯ সালে জেরেমির নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি একটি প্রস্তাব পাশ করেছিল৷ বলা হয়েছিল, ‘কাশ্মীরে বড় মাপের মানবিক সংকট চলছে৷’ এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সেখানে যাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছিল, যা ভারত সরকার মোটেই ভালোভাবে নেয়নি৷ এছাড়া ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয়দের থেকেও তীব্র প্রতিক্রিয়া আসার পরে ‘কাশ্মীর সমস্যা’ ভারত-পাকিস্তানের ‘দ্বিপাক্ষির বিষয়’ বলে ব্রিটিশ সরকার বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়৷

এই পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয় ২০২০ সালে৷ জেরেমি সরে যাওয়ার পর স্টার্মার লেবার পার্টির নেতৃত্বের ভোটে বিপুল জয় পান৷ দলের নেতৃত্বের রাশ হাতে পে‌েই স্টার্মার কিন্ত্ত কাশ্মীর ইসু্যতে দলের আগের অবস্থান পরিবর্তনের রাস্তায় হাঁটেন৷ তিনি বলেন, কাশ্মীর সমস্যা ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়৷ এই সমস্যা দুই দেশ মিলেই সমাধান করবে৷ এবারে ভোটের প্রচারের অনেক আগে থেকেই স্টার্মার প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন৷ কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে৷ ব্রিটেনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দুদের উপরে খালিস্তানিদের হামলার কড়া ভাষায় নিন্দা করেছিলেন স্টার্মার৷ গতবছর নেমজেনের বিএপিএস শ্রীস্বামীনারায়ণ মন্দিরে দীপাবলির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন৷ এমনকি একথাও বলেছিলেন, ‘ব্রিটেনে হিন্দু ফোবিয়ার কোনও স্থান নেই৷’ এবারে ভোটের প্রচারের সময় উত্তর লন্ডনের কিংসবারির শ্রীস্বামীনারায়ণ মন্দির পরিদর্শন করেছিলেন৷

পাশাপাশি, মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় ব্রিটেনের হিন্দুদের প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছিলেন৷ গতবছর ইন্ডিয়া গ্লোবাল ফোরামে ভারত-ব্রিটেন সম্পর্কের বিষয়ে স্টার্মার লেবার পার্টির অবস্থান কী হতে পারে তার কিছুটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় এলে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক গণতন্ত্র ও আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে নির্মিত হবে৷ তিনি বলেছিলেন, ‘আমার লেবার সরকার ভারতের থেকে যা চাইবে, তা হল মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ)৷’ তাঁর বক্তৃতায় বারবারই উঠে এসেছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং জলবায়ু সুরক্ষার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা৷
ভোট পূর্ববর্তী লেবার পার্টির নেতা স্টার্মারের এহেন মতামতের ভিত্তিতে ভোটপরবর্তী ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্টার্মার এবার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কোন খাতে এগিয়ে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন? এক্ষেত্রে মূলত তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যেতে পারে৷ প্রথমত, দু’দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি৷ দ্বিতীয়ত, ব্রিটেনে ভারতীয়দের চাকরি ও পড়াশোনা ও ভিসা সংক্রান্ত সমস্যা৷ তৃতীয়ত, কাশ্মীর প্রমাদে নতুন ব্রিটিশ সরকারের অবস্থান কী হতে চলেছে৷

প্রথমে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি ধরা যাক৷ এবারের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা হচ্ছে ব্রিটিশ অর্থনীতির বেহাল অবস্থাকে৷ সাম্প্রতিক সময়ে সে দেশের মানুষের আয়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে৷ জীবনযাত্রার মানে পতন, ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে গিয়েছে৷ ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে৷ এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ঋষি সুনক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অনেকেই আশা করেছিলেন, ২০২২ সালের দীপাবলির সময় এই চুক্তি সই হয়ে যেতে পারে৷ যদিও তা হয়নি৷ কারণ বিষয়টি মোটেই সহজ নয়৷ যদি ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট হয়, সেক্ষেত্রে বিনা বাধায় ব্রিটিশ পণ্য ভারতে ঢুকতে থাকবে৷ সেক্ষেত্রে ভারতীয় উৎপাদকদের কী অবস্থা হবে, সেটা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়৷ অন্যদিকে আমাদের দেশে উৎপাদিত পণ্যের যে কাঁচামাল থাকবে, তাতে ভর্তুকি রাখা চলবে না৷ কারণ তা না হলে সস্তা ভারতীয় পণ্যে ব্রিটেনের বাজার ভরে যাবে, যা ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের স্বার্থের পরিপন্থী৷ তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে ব্রিটেনের অর্থনীতির স্বার্থে ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা আবার শুরু হবে৷ বিশেষ করে এখন ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী হয়েছেন ডেভিড ল্যামি, যিনি এবারের ভোটের প্রচারের সময় একাধিকবার এই চুক্তির প্রসঙ্গ তুলেছিলেন৷

এবার ধরা যাক দ্বিতীয় বিষয়টি৷ চাকরির জন্য ভারতীয়দের ক্ষেত্রে কতটা উদার হবে নতুন ব্রিটিশ সরকার? স্টুডেন্ট ভিসা সম্পর্কে হয়তো নীতি খুব একটা কিছু নাও বদলাতে পারে৷ কারণ ভারতীয়রা ওখানে পড়তে গেলে ব্রিটিশ সরকারের লাভ বই ক্ষতি নেই৷ কিন্ত্ত ওয়ার্কিং ভিসার ক্ষেত্রে কী নীতি নেওয়া হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন৷

ঋষি সুনকের সরকার এক্ষেত্রে কঠোর নীতি নিয়েছিলেন, অভিবাসনের হার কমানোই ছিল যার একমাত্র উদ্দেশ্য৷ যেমন কাজের জন্য ভিসা প্রার্থীদের ক্ষেত্রে নূ্যনতম বেতনের উর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ অর্থাৎ কম বেতনের কাজ নিয়ে ব্রিটেনে ছোট বা মাঝারি পদের কাজ নিয়ে ব্রিটেনে যেতেন সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ স্বাস্থ্য এবং পরিচর্যা পরিষেবার ক্ষেত্রকে এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলেও স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছিল স্ত্রী বা পরিবারের অন্য কোনও সদস্যকে সঙ্গে আনা যাবে না৷ এমনকি স্টুডেন্টদের ভিসায় স্নাতক পাঠক্রম শেষ হওয়ার পরেও কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা ছাড়াই যে দু’বছর পর্যন্ত ব্রিটেনে থাকা যেত, সেটাও বিবেচনাধীন করা হয়েছিল৷

আর একটা দিক থেকেও ভারতীয় কর্মীরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন৷ সুনকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লেভারলি বলেছিলেন, কর্মীর ঘাটতি রয়েছে এমন পেশার তালিকা নতুন করে তৈরি করা হবে৷ এতদিন এই ঘাটতি তালিকায় থাকা পেশায় ২০ শতাংশ কম বেতনে ভিনদেশি কর্মী নিয়োগ করা যেত৷ সেই সুযোগ নতুন আইনে নেই৷ কনজারভেটিভ সরকারের ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ঘোষিত এই নীতি ভারতীয়দের কপালে নিঃসন্দেহে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল৷ কারণ এই নীতির ফলে সেখানকার ভারতীয় রেস্তরাঁগুলি যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে৷ ব্রিটেনের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা পরিষেবায় প্রচুর ভারতীয় কাজ করেন৷ পরিবার না নিয়ে যাওয়ার শর্ত তাঁদের পক্ষে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে৷

যদিও লেবার পার্টি কনজারভেটিভদের মতো অত কঠিনভাবে অভিবাসন বিরোধী নয়, কিন্ত্ত উল্টো দিকে তারা ব্রিটিশদের কাজের দাবিকে প্রথম গুরুত্ব দেওয়ার কথাও বলেন৷ তাই ওয়ার্কার ভিসার ব্যাপারে নতুন সরকার কী পদক্ষেপ নেবে, তা এখনই বলা কঠিন৷ তবু কূটনীতিকরা আশাবাদী বিধিনিষেধ আগের তুলনায় শিথিল হবে, যদিও ভারতীয় কর্মীদের অস্থায়ী ভিসার বিষয়ে ভারসাম্যমূলক আইন তৈরি নিঃসন্দেহে নতুন সরকারের অন্যতম চিন্তার বিষয় হবে৷

এবার আসি তৃতীয় বিষয় কাশ্মীর প্রসঙ্গে৷ আগেই বলেছি, লেবার নেতা জেরেমি করবিন কাশ্মীরে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চেয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাশ করিয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত স্টার্মার দলের দায়িত্ব পেয়েই কাশ্মীর ইসু্যতে অবস্থান বদলের রাস্তায় হাঁটেন৷ প্রবাসী ভারতীয়দের সম্মেলনে এও বলেছিলেন যে, কাশ্মীর দ্বিপাক্ষিক বিষয়, ভারত-পাকিস্তানই তার সমাধান করবে৷ সেই সময় ভারত এটিকে তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে করবিনের পদক্ষেপের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল৷ সুতরাং সেই সময় স্টার্মারই যে উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ ভারতের মতো ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক যে দৃঢ় রাখা জরুরি, তা স্টার্মার তাঁর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং কূটনৈতিক যুক্তি দিয়ে বুঝেছিলেন৷

সুতরাং প্রধানমন্ত্রী স্টার্মার অতঃপর কীভাবে, কোন পথে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেন, সেটাই দেখার৷ লেবার পার্টির তরফে বলা হয়েছে, তারা ভারতের সঙ্গে নতুন কৌশলগত অংশীদারিত্ব খুঁজবে৷ বর্তমানে জটিল আন্তর্জাতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ব্রিটেনের নতুন সরকারের কাছে ভারতের গুরুত্ব কমবে না বলেই মনে হয়৷