বেশি জরুরি চাকরি পাওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ফিরিয়ে আনা

যোগ্য চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি

স্বপনকুমার মণ্ডল: লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই ব্যাপক সংখ্যক চাকরি হারানোর বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে৷ দুর্নীতির ইসু্যতে তা যেন সরকারবিরোধী টাটকা প্রমাণের সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে৷ একের সর্বনাশ,অন্যের পৌষমাস মনে হলেও এরকম ভয়ঙ্কর পরিণতি কেউ প্রত্যাশা করেনি,ভাবতেই পারেনি৷ সেখানে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ২০১৬-র প্যানেলের ২৫৭৫৩ জনের চাকরি চলে যাওয়ার খবরে সারা রাজ্য জুড়ে তা নিয়ে তুমুল হৈচৈ পড়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক৷ তার মধ্যে প্রায় তিনভাগই শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে৷ যারা এতদিন পথে নেমে শিক্ষকের হকের চাকরি পাওয়ার জন্য জীবনপণ করে রাস্তায় পড়ে থেকে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দাতে দাঁত চেপে দিনের পর দিন সুবিচারের প্রত্যাশায় সরকারি রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সুদীর্ঘ সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিল, অভ্যাসের ফেরে আমজনতার উদাসীনতায় তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরও ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে৷ মাঝে মাঝে তা জাগিয়ে তোলার প্রয়াসেও টালবাহানার খেলায় উপেক্ষা আর উদাসীনতার নেমে আসে৷ যে বিচারপতির সৎসাহসে ভর করে আন্দোলনের রাস্তাই একমাত্র রাস্তা মনে হয়েছিল, সেই বিচারপতির পদত্যাগ ও রাজনীতিতে যোগদান থেকে লোকসভার আসন্ন নির্বাচন সবেতেই সেই সবদিক থেকে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের গতি রুদ্ধ হয়ে পড়ে৷ তারপরেও তাদের নাছোড় মনোভাবে যখন মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ে যোগ্যতার প্রশ্নে গোটা প্যানেলটাই বাতিল হয়ে যায়, তখন তাদের দাবি মান্যতা পেলেও চাকরিহারা শিক্ষকদের হাহাকারে তারা পিছনে চলে যায়৷

সেখানে যোগ্য ও অযোগ্যদের তরজা বা অবৈধ চাকরির জন্য বৈধ শিক্ষকদের নিয়ে রাজ্যজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে, নির্বাচনী প্রচারের আলো শুষে নেয়৷ শুধু তাই নয়, তাতে মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ের প্রতিও তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়৷ মহামান্য সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়ে সেই অসন্তোষ ক্রমশ নিস্তেজ হলেও চাকরিহারা শিক্ষকদের তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন রাজপথে নেমে আসে৷ স্বাভাবিক ভাবে তাতে শিক্ষকতায় বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন পেছনের সারিতে চলে যায়৷ অন্যদিকে যোগ্য চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়ে যায় তীব্র প্রতিযোগিতা৷ সেখানে নির্বাচনী প্রচারে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষকদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা শুধু সময়ের দাবিই নয়, অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ৷ তাতে ইতিমধ্যে সুফলও মিলেছে৷ তাতে শুধু যোগ্যদের চাকরি ফিরে পাওয়ার হাতছানিই নেই, অযোগ্যদের অবৈধ চাকরির পরিবর্তে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের প্রত্যাশা পূরণের সম্ভাবনাও রয়েছে৷ কিন্ত্ত তাতে সব সমাধান হবে,তা ভাবলে ভুল হবে৷ আসলে এক যুগের বেশি সময় ধরে এ রাজ্যের সরকারি কর্মক্ষেত্রে শূন্যতাবোধে কর্মপ্রার্থীরাই শুধু ভুক্তভোগী নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনেও ভয়ঙ্কর হতাশা গ্রাস করেছে৷ সেখানে শুধু চাকরি চুরির কথাই মনে আসেনি, ভবিষ্যতের সাধ ও স্বপ্নও চুরির কথাও মনে করিয়ে দেয়৷ সেক্ষেত্রে হারানো চাকরি ফিরিয়ে দিলেই তার সমাধান হবে না, বৈধ পথে যোগ্যতার নিরিখে চাকরি পাওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা জরুরি৷ সেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর জরুরি তৎপরতায় সেই বৈধ পথের সুরাহা ও সুরক্ষা নতুন করে প্রত্যাশা জাগায়৷


আসলে সময়ে শুধু অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায় না, অস্তিত্বকেও নতুন করে চিনিয়ে দেয়৷ সেখানে বৈধ-অবৈধের ধারণা থেকে যোগ্য-অযোগ্যের চেতনা স্বাভাবিক ভাবেই আরও বেশি মুখর হয়ে ওঠে৷ চাকরি হওয়াতেই যেমন অবৈধ ধারণা বৈধতা লাভ করে বা চাকরি হলেই তার যোগ্যতা প্রমাণিত হয় এরকম বদ্ধমূল ধারণা যে ঠিক নয়, মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয়ের রায়েই তা প্রতীয়মান৷ শুধু তাই নয়, পাকা চাকরি চলে যাওয়ার কথা দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারেনি৷ যেখানে চাকরি পাওয়ার চেয়ে তা হারানোকে আরও কঠিন বলে তার স্থায়িত্বকে অক্ষয় করার সযত্ন প্রয়াস চলে, সেখানে স্থায়ী চাকরি চলে যাওয়ার মতো আকস্মিকতা সাধারণের মনে ভয়ঙ্কর নিঃস্বতাবোধ অত্যন্ত স্বাভাবিক৷ বাঙালির চাকরিসর্বস্ব জীবনে চাকরিই তার অস্তিত্বের উৎকর্ষ, পায়ের নীচের মাটি থেকে সামজিক প্রতিষ্ঠা সর্বত্র তার বিস্তার৷ সেখানে ছাত্রজীবন থেকেই তার মনে চাকরিই ধ্যান-জ্ঞান, উচ্চতর যোগ্যতার মাপকাঠি৷ এজন্য একের পর চাকরি সোপান বেয়ে অনেকেই মোটা মাইনের বা বড় চাকরিতে থিতু হয়ে থাকে৷ সেখানে চাকরিহারাদের মধ্যে অনেকেই পুরনো চাকরি ছেড়ে শিক্ষতার চাকরিতে এসেছেন বা জায়গা পরিবর্তন করেছেন৷ তাদের সমস্যা আরও ভয়াবহ৷ কেননা চাকরি হারিয়ে তারা আর পুরনো জায়গাতে আল ফিরে যেতে পারবেন না৷

অন্যদিকে বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে বয়স, যোগ্যতা থেকে রেজাল্ট, অনুশীলন, স্বাস্থ্য সবেতেই পিছিয়ে থাকার প্রবল সম্ভাবনা৷ একে চাকরি হারানোয় পারিবারিক জীবনের আর্থিক বিপর্যয়, তার ওপরে সামাজিক সম্পর্ক ও সম্মানহানির ভয়, সর্বত্র আতঙ্ককে পুঁজি করে বেঁচে থাকার লড়াই জারি হয়৷ সেখানে অবৈধ পথে অযোগ্যদের চাকরির জন্য সেই সব যোগ্যদেরই আজ মূল্য দিতে হচ্ছে, ভাবা যায় ! আজ স্কুলের প্রাঙ্গণ ছেড়ে চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য যোগ্যদের আন্দোলনে নামতে বাধ্য করেছে৷ চাকরি হয়ে গেলেই কেউ আর তাদের অবৈধ বলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবে না-র বদ্ধমূল ধারণা থেকেই যোগ্যদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের চাকরি বিক্রি করার মতো ভয়াবহ দুর্নীতি যে ঘটেছে, কোর্টের রায়েই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ শুধু তাই নয়, সেই অবৈধ চাকরিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সরকারের সুপার নিউমারিক পদ সৃষ্টির অসাধু উপায়ও সংবদ্ধ দুর্নীতিকে চিনিয়ে দেয়৷

সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার স্বপ্নটাই আজ বাস্তব জীবনে দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক হয়ে উঠেছে৷ অন্যদিকে যারা সেই দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ওঠার স্বপ্নে বছরের পর বছর রাস্তায় পড়ে থেকে আন্দোলন চালিয়েছে, তারা জনতা করুণা পেলেও মর্যাদা পায়নি৷ তাদের অবিরত আন্দোলন ও আইনি পথের লড়াইয়ে যখন শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণে গোটা প্যানেলটাই বাতিল হওয়ায় চাকরিহারা শিক্ষকেরা পথে নেমে এল, তখন তাদের দাবি-দাওয়ার চেয়ে হারানো চাকরি ফেরতের কথা জোরদার হয়ে ওঠায় তারাই ব্রাত্য হয়ে গেল৷ অথচ তারাই সবচেয়ে উপেক্ষিত হয়েছে৷ কতগুলো বছর তাদের জীবন থেকে চলে গেছে, জীবনের প্রতি জেগে উঠেছে অবিশ্বাসের নিবিড় হাতছানি৷ আর্থিক প্রতিষ্ঠা, সামাজিক নিরাপত্তা, জীবন গড়ে তোলার আয়োজন সবটাই তাদের অধরা মাধুরী হয়ে থেকে গেছে৷ অন্যদিকে যোগ্য চাকরিহারা থেকে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীর বাইরেও রয়েছে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী যারা সেই অনিশ্চিত অজানা ভবিষ্যতের দিকে অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ এক যুগের বেশি সময় ধরে কর্মক্ষেত্রের অকর্ষিত জমিতে ফস্লের কোনো চিহ্ন নেই, তার বদলে দুর্নীতির আগাছায় তা পরিপূর্ণ, কোথাও ফসলের আশা নেই,জমির চাষযোগ্যতাই হারিয়ে গেছে৷

স্বাভাবিক ভাবে একে কর্মসংস্থানের তীব্র আকাল, তার মধ্যে দুর্নীতির লাগামহীন নৈরাজ্য, সবদিক থেকেই বর্তমান অনিশ্চয়তায় ভোগা কর্মপ্রার্থী থেকে দিশাহীন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷ তার কুপ্রভাব গোটা সমাজজীবনকে অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রে নেমে এসেছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব৷ সেখানে পড়াশোনা করে কী হবে’র প্রশ্নটি অবিরত ঘুরপাক খায়৷ এজন্য শুধু চাকরি ফিরিয়ে দিলেই হবে না, বঞ্চিতদেরও সব সুদে আসলে ফিরিয়ে দিতে হবে৷ তাহলেই সব হবে না, অবৈধ দুর্নীতির কারবারি, তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে৷ তার সঙ্গে যোগ্যতার মানদণ্ডকে আবার ফিরিয়ে এনে সুশাসনে বিশ্বাসের ছবিকে জাগিয়ে তুলতে হবে৷ সেই বিশ্বাসের ছবি মনে জেগে উঠলেই সাধ ও স্বপ্ন আবার ফিরে আসবে, সোনালি সকাল তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ আত্মবিশ্বাস না থাকলে মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে না৷ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে সেই বিশ্বাসের ছবি ফিরিয়ে আনার বার্তা উঠে এলেও তা কতটা কার্যকরী হবে, সময় তা বলে দেবে৷