মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস

খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যে ভারতীয় অর্থনীতির কাছে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা, তা দিনকয়েক আগেই ফের স্পষ্ট করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক৷ মূলধারার অর্থনীতির লোকজনদের একাংশ সাধারণভাবে এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন যে বিকাশমান অর্থনীতিতে মুল্যবৃদ্ধির হার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে থাকে৷ অতএব মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অহেতুক বিতর্ক বাড়িয়ে লাভ নেই৷ নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকারও ঠিক এমন ধারণাই পোষণ করে থাকে৷ তাই এই জমানায় ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির হার বজায় থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকার কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি৷ বরং তথাকথিত বিকাশের নাম করে তেমন পদক্ষেপই নিয়েছে যেগুলি পণ্য ও পরিষেবা মূল্যবৃদ্ধিতে সাহায্য করে৷

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায়, বিকাশমান অর্থনীতিতে উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধির চাপ থাকে৷ তাহলে পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত হওয়া দরকার বিকাশমান অর্থনীতিতে শুধু জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়বে না, সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান বেড়ে বেকারির হার কমাবে এবং মানুষের আয় বা মজুরি বাড়িয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা ও সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়বে৷ সর্বোপরি সমাজে আয় ও সম্পদের বৈষম্যের হ্রাস ঘটাবে৷ অর্থনৈতিক বিকাশ যদি নতুন কর্মসংস্থানই তৈরি করতে না পারে, মানুষের আয় ও মজুরি বাড়াতে না পারে তাহলে সেই অর্থনীতি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে৷ কিন্ত্ত মোদিরা সেই বিকাশের পথকেই অাঁকড়ে ধরে বসে আছেন যেখানে উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য হলেও কাজের সুযোগ বৃদ্ধি বা প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির কোনও সুযোগ নেই৷

বিকাশের উচ্চ হার প্রত্যাশা করে মোদি সরকার৷ কিন্ত্ত বিকাশের ফলে যে সম্পদ তৈরি হয় তার বণ্টনে ন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না৷ তারা সেই সম্পদ কেন্দ্রীভূত করতে চায় উপরতলার মুষ্টিমেয় অংশের হাতে৷ সম্পদ যদি প্রায় সবটাই চলে যায় কর্পোরেট বিত্তবানদের ঘরে তাহলে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই প্রায় থাকে না৷ তাই মোদি জমানায় সম্পদ ও আয় বৈষম্য গ্যারান্টি সহকারে বেড়েই চলেছে৷ কর্পোরেট বিত্তবানদের জন্য মোদি সরকার দরাজহস্ত৷ তাদের জন্য কর্পোরেট কর এক-তৃতীয়াংশ কমানো হয়েছে৷ দশ বছরে তাদের জন্য ১৭ লক্ষ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করা হয়েছে৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ও জাতীয় সম্পদ জল-জমি-খনি ইত্যাদি সবই বিনামূল্যে বা জলের দরে তুলে দেওয়া হচ্ছে ধনকুবেরদের হাতে৷ অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও নানাভাবে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা৷ কর ছাড়সহ বকেয়া করও মকুব হয়ে যাচ্ছে৷ সম্পদ ও আয়ের বেশিটাই যাদের হাতে তাদের থেকে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ছে না, বাড়ছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে৷ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জিএসটি আদায় করা হচ্ছে হু হু করে৷ গত দশ বছরে পেট্রোপণ্য থেকে ২৮.৩৩ লক্ষ কোটি টাকা কর আদায় করেছে সরকার৷ এই কারণে বাজারে সব ধরনের পণ্য ও পরিষেবার মূল্য বেড়েছে অনিবার্যভাবে৷ বিকাশের নামে মোদিরা বিত্তবানদের ভারত বানাচ্ছেন৷


এ পর্যন্ত দু’দফায় ভোট হয়েছে মাত্র ১৯০ আসনে৷ আগামী পাঁচ দফায় হবে ৩৫৩ আসনের ভাগ্যপরীক্ষা৷ সাধারণ মানুষের রান্নাঘরে যদি নিত্যদিন মূল্যবৃদ্ধির আগুন জ্বলে, তার প্রভাব তো মোদির ম্যাজিক ফিগার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পড়বেই৷ তাই কীভাবে একটা মাস অন্তত নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে রাখা যায়, সেই উত্তর খুঁজতে বসেছে প্রধানমন্ত্রীর অফিস (পিএমও)৷ ‘ভারত’ ব্র্যান্ডের আটা, চাল, ছোলার ডাল সস্তায় সরবরাহ করেও কাজে দিচ্ছে না বলে রিভিউ বৈঠকে উঠে এসেছে৷ দেশের ৫১ শতাংশ মানুষ অবশ্য ভারত আটা বা চাল-ডালের কথা জানেই না৷ তাই টিভি, রেডিওতে প্রচার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ ভারত ব্র্যান্ডের চাল, আটা, ডাল সস্তায় বিক্রির জন্য ‘প্রাইস স্টেবিলাইজেশন ফান্ড’ থেকে ১ হাজার ১৯৬ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকাও বরাদ্দ করা হচ্ছে৷ অর্থাৎ মোদি সরার মনে করছে এইভাবে ৩০ জুন পর্যন্ত দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে৷

কিন্ত্ত সত্যিই কি সেটা হবে? অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু ভারত ব্র্যান্ড দিয়ে গোটা দেশের খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম টানা সম্ভব নয়৷ খাদ্যসামগ্রীর দাম কমানোর দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে৷ দেশবাসীর মাথাপিছু আয়ও একটা বড় ফ্যাক্টর৷ কেননা মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছুতেই আমজনতার উপার্জন বাড়ছে না৷ গত বছরের হিসাব ধরলেই দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে ১.৫৯ থেকে ৫৮.২৫ শতাংশ৷ আর এই উদ্বেগজনক তথ্য জানা গিয়েছে মোদি সরকারের আন্তঃমন্ত্রক বৈঠকের নোট থেকেই৷ তাই অশনি সংকেত নরেন্দ্র মোদির৷ ভোট এখনও বাকি আরও পাঁচ দফা৷