বাসুদেব ধর
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং জন্ম থেকে ভারতবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক বলে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কিছু সময় বিরতির পর আবার স্বরূপে ফিরেছে৷ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এবার তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনে নেমেছে৷ অন্যদিকে বিএনপির সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চালানো হচ্ছে ‘ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন’৷
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এক পর্যায়ে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখতে সেনানিবাসে বসে এই দলটি গঠন করেছিলেন৷ গোড়া থেকেই বিএনপির আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে এনে ফের পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হওয়া এবং চীনকে পাশে রেখে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো৷ অর্থাৎ পাকিস্তানি আমলের সেই ভারত-বিরোধী রাজনীতি ফিরিয়ে আনা৷ জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, একটা সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন৷ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, পাশে ছিল ভারত৷ কিন্ত্ত বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তড়িঘড়ি ভোল পাল্টাতে দ্বিধা করেননি৷ মুক্তিযুদ্ধের সময়েই অভিযোগ উঠেছিল, তিনি ছিলেন পাকিস্তানি চর, ভেতরে ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউরের স্ত্রী বর্তমান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে সেনানিবাসে পাকিস্তানি জেনারেল জানজুয়ার বাসায় ছিলেন বহাল তবিয়তে৷ কয়েক বছর আগে দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা কারাদন্ডে দন্ডিত হন৷ তবে সরকারের অনুকম্পায় সাজা স্থগিত করা হয়েছে, তাকে নিজ বাসভবনে অবস্থানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে৷ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জেনারেল জানজুয়ার মৃতু্যতে পাকিস্তানে শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন৷ কোনো পাকিস্তানি জেনারেলের মৃতু্যতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তা পাঠানো অস্বাভাবিক ঘটনা বলে তখনই সমালোচিত হয়েছে, বিশেষ করে যে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার হাতে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার রক্তের দাগ রয়েছে৷
সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি, সহিংস তৎপরতায় টানা আন্দোলন করেও নির্বাচন রুখতে পারেনি৷ বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ভারত আওয়ামি লিগের পাশে দাঁড়িয়ে একতরফা নির্বাচনে জিতে আসতে সহায়তা করেছে৷ একইভাবে ২০১৪ সালে এবং ২০১৮ সালেও ভারত আওয়ামি লিগকে ক্ষমতায় এনেছে৷ এই ক্ষোভে বিএনপি এখন ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনে নেমেছে৷
বলা যায়, এতোদিন রাখঢাক থাকলেও এবার প্রকাশ্যে এভাবে ভারতবিরোধিতায় নামলো৷
ভারতবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বিএনপির রাজনীতির মূল ‘দর্শন’ হলেও প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী প্রচারণায় এলো আশির দশকের পর৷ এখন প্রশ্ন উঠছে, বিএনপি কি তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবেই আবার ভারতবিরোধী অবস্থান নিল?
বিএনপি নেতা-কর্মীদের একাংশ ভারতীয় পণ্য বর্জনের জন্যে প্রচারে নেমেছেন, কোথাও কোথাও বাধ্য করার ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ আসছে৷ কয়েকদিন আগে বিএনপির প্রথম যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী পল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে নিজের গায়ের কাশ্মিরী শাল খুলে আগুনে নিক্ষেপ করেন এবং সমবেত নেতা-কর্মীদেরও তা-ই করতে বলেন৷ রিজভী দলের মুখপাত্র হিসেবে প্রায়ই গণমাধ্যমের সামনে আসেন৷ তিনি জিয়াপুত্র তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ও সরাসরি তার নির্দেশে চলেন বলে মনে করা হয়৷ তারেক লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন, দুর্নীতির কয়েকটি মামলায় দন্ডিত৷
তবে ভারত নিয়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যেও বিভ্রান্তি আছে বলে জানা যাচ্ছে৷ সবাই এক সুরে কথা বলছেন না৷ কয়েক নেতা বলেছেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনে দল আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ বিষয়টি সুরাহার জন্যে দলের স্থায়ী কমিটি শিগগিরই বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেবে৷ বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর অভিযোগ, গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা করায় দেশে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ জনগণের দল হিসেবে বিএনপি জনগণের দাবি, মতামত ও বিবেচনাবোধকে অগ্রাহ্য করতে পারে না৷
অন্যদিকে বিএনপির ভারতীয় পণ্য বর্জনের কর্মসূচিকে হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগের শীর্ষ নেতারা৷ তারা মনে করেন, এ কর্মসূচিতে দেশের মানুষের সাড়া মিলবে না৷ দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকার হতাশা থেকে এমন কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি৷ তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার প্রতি ভারতের অকুন্ঠ সমর্থন রয়েছে৷ ফলে বিএনপি ও তাদের বিদেশি মিত্ররা এ দেশে অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না৷ ফলে ক্ষোভ ও হতাশা থেকে বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিচ্ছে৷ এমন কর্মসূচি সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না৷ কারণ ভারত এ দেশের পরীক্ষিত বন্ধু এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা ভারতীয় পণ্য এ দেশের মানুষের পছন্দের তালিকায় রয়েছে৷
আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, রাজনৈতিক কোনো ইসু্য না পেয়ে বিএনপি ভারতবিরোধী রাজনীতিতে নেমেছে৷ তিনি বলেন, পাকিস্তান আমল থেকে অপপ্রচার শুনে আসছি, যখন কোনো রাজনৈতিক ইসু্য থাকে না তখন একটাই ইসু্য আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে নিয়ে আসে৷ আগে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনতো, এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনে৷ সেটা হচ্ছে ভারত-বিরোধিতার ইসু্য৷
ওবায়দুল কাদের কয়েক দিন আগে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে বাংলাদেশের পূজা সংগঠনসমূহের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেছেন, ভারত পাশে ছিল বলেই বাংলাদেশের নির্বাচনে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি৷
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দেওয়াল ছিল, তা ভেঙে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো বলে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৬৮ বছরের যে সমস্যা, তার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে৷ তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর জলের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে৷ এর সমাধানও অবশ্যই হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে৷ গায়ে পড়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত করে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়৷
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচালিত ‘ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন ‘সমীচীন নয় বলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক৷ তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ভারতবিরোধী মনোভাব কেন জাগ্রত করার চেষ্টা করা হচ্ছে? যারা নির্বাচনে আসেনি, এটি তাদের অপপ্রচারের একটা ঢাল৷ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন ভারত বিরোধিতায় লিপ্ত হয় একটি মহল৷ এখনো তারা সেটি করছে৷
রিজভীর ভারতীয় শাল পোড়ানো নিয়ে আওয়ামি লিগ সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেছেন, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য কে শাল পোড়ালো এ নিয়ে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই৷ এখন তারা শাল পোড়াচ্ছে, অথচ যখন ভারত থেকে পেঁয়াজ, চাল, ডাল নিয়ে আসি তখন তো কেউ কিছু বলে না৷ যারা রাজনৈতিক কারণে এসব করছে তারাই তো চিকিৎসার প্রয়োজন হলে সবার আগে ভারতে দৌড়ান৷ তিনি বলেন, আমাদের তিনদিকে ভারত, একদিকে সমুদ্র৷ পৃথিবীতে কোনো দেশ তার প্রতিবেশী ইচ্ছেমতো নিতে পারে না৷ ভারত একটি বড় দেশ৷ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত যে ভূমিকা রেখেছে তা আমরা ভুলতে পারি না৷ এ বিষয়টিকে তো মনে রাখতে হবে৷ সভাপতি মন্ডলীর আরেক সদস্য ও বস্ত্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেছেন, বিএনপির কর্মকান্ড আগেও এমন ছিল৷ কোনো ইসু্য না পেলে ভারতবিরোধিতা৷ এটা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার প্রমাণ৷
সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিএনপি নেতারা মনে করেন, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভারতের অবস্থানে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি৷ দুই দেশের জনগণের মধ্যকার যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা তার বদলে শুধু আওয়ামি লিগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর হয়েছে৷ একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর গুলশানের বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন৷ দলের নেত্রীর সঙ্গে কথার এক পর্যায়ে ভারতের বিষয়টি আনেন ওই নেতা৷ তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে খালেদা জিয়া নাকি ২০০৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত বিএনপির অনুসৃত ভারতবিরোধী অবস্থান অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন৷
ভারতে নরেন্দ্র মোদি প্রথম ক্ষমতায় আসার পর সবার আগে বাংলাদেশ থেকে অভিনন্দন জানিয়েছিল বিএনপি৷ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কয়েকজন নির্বাচনের ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে৷ বলা হয়, তাদের প্রত্যাশা ছিল, কংগ্রেস বরাবরই আওয়ামি লিগের ঘনিষ্ঠ৷ নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসায় হয়তো ভারতের অবস্থান পাল্টাবে৷ কিন্ত্ত ভারতের নীতিগত অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি৷ বরং নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার চেষ্টায় দুদেশের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে, বেড়েছে সহযোগিতা৷ বিএনপির হতাশার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই৷