ভোটের আগেই মধ্যপ্রদেশের গভীর জঙ্গল ঘেরা এলাকার কয়লা খনির দখল গেল আদানি গোষ্ঠীর হাতে৷ ভোটের দিন ঘোষণার ঠিক তিনদিন আগে গত ১২ মার্চ কয়লা মন্ত্রক মোদি-ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠীর মাহান ইন্টারজেন লিমিটেডের হাতে তুলে দিয়েছে ‘মারা-২ মাহান’ কয়লা ব্লক৷ অরণ্য ঘেরা এলাকায় ৯ হাজার ৯৫০ লক্ষ টন মজুত কয়লার এই ব্লক প্রায় জলের দরে তুলে দেওয়া হয়েছে আদানি গোষ্ঠীকে৷ এই কয়লাখনি থেকে মোট আয়ের মাত্র ৯ শতাংশ সরকারকে দেওয়ার বিনিময়ে এই ব্লকের দখল নিল আদানি গোষ্ঠী৷ দেশের যতগুলি কয়লাখনি ব্লক বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সব থেকে বেশি আয়ের ভাগ নিয়ে বিপুল মজুত কয়লা ভাণ্ডারের মালিকানা পেল আদানিরা৷
দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হবে বলে এই গভীর অরণ্য ঘেরা কয়লা ব্লকের কয়লা খননে প্রবল আপত্তি ছিল কেন্দ্রের পরিবেশ দফতরের৷ এমনকী কয়লা মন্ত্রকের নিজস্ব খনি বিশেষজ্ঞ সংস্থা ‘সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউট’, এই কয়লা খনিসহ দেশের আরও অন্য ১৫টি কয়লা খনি কোনওভাবেই চালু করা যাবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল৷ মূলত গভীর অরণ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে বলে এই আপত্তি জানায় ইনস্টিটিউট৷ কোনও আপত্তির তোয়াক্কা না করেই নিলামে আদানির হাতে এই কয়লা ব্লক তুলে দেওয়া হল৷ এভাবে দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেশের সম্পদের দেদার লুটে আদানিদের লাইসেন্স দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে৷
বিপুল মজুতের এই কয়লা ব্লক আদানিদের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে মোদি সরকারের আমলাদের এক অংশের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো৷ সংবাদ সংস্থা ‘রিপোর্টার কালেকটিভ’ এই তৎপরতার তথ্য তুলে ধরেছে৷ তারা জানাচ্ছে, কয়লা ব্লক দখলে লবির কাজ চালিয়েছে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব পাওয়ার প্রডিউসার্স’৷ এই অ্যাসোসিয়েশনের ডিরেক্টর হলেন আদানি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি অশোক খুরানা৷ তিনি হলেন কেন্দ্রের বিদু্যৎ মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব৷ গত ২০২১ সালের নভেম্বরে অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে তিনি বর্তমান কয়লা সচিবকে চিঠি লেখেন৷ তাতে তিনি কয়লা সঙ্কট নিয়ে বিভিন্ন সংবাদের কথা উল্লেখ করে, নতুন কয়লা খনি চালুর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণের অনুরোধ জানান৷ তিনি তাঁর চিঠিতে মধ্যপ্রদেশের সিংগৌলের বনাঞ্চলে মারা-২ মাহান কয়লা ব্লক চালু করার কথা লেখেন৷
প্রসঙ্গত, কয়লামন্ত্রী ২০২১ সালে সংসদে এক লিখিত প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, দেশে বর্তমানে যেসব কয়লাখনি চালু রয়েছে তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে কয়লা মজুত রয়েছে৷ ফলে কয়লার অভাবে সঙ্কট বলে যে কথা ছড়িয়েছে তা ঠিক নয়৷ এদিকে ২০১৮ সালে পরিবেশমন্ত্রক মারা-২ মাহান কয়লা ব্লক সহ ১৫টি কয়লা ব্লক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে চালু করা উচিত হবে না বলে সুপারিশ করে৷ অ্যাসোসিয়েশন কয়লা খনি দখলে পরিবেশ মন্ত্রকের সুপারিশ খারিজ করতে উদ্যোগী হয়৷ সেই সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশ মতো কয়লা মন্ত্রক সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউটকে ১৫টি কয়লা ব্লক চালু করার বিষয় পর্যালোচনা করার নির্দেশ দেয়৷ তবে ইনস্টিটিউট তার রিপোর্টে সেই কয়লা ব্লক চালু করা যাবে না বলে আবারও জানিয়ে দেয়৷ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার কারণেই তা চালু করা উচিত হবে না বলে তারা জানিয়ে দেয়৷
তবুও কিছুদিনের মধ্যেই ১৫টি কয়লা খনি চালুতে পরিবেশ মন্ত্রকের আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে তা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নিলাম ডাকার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় কয়লা মন্ত্রক৷ নিলামে মধ্যপ্রদেশের মারা-২ মাহান কয়লা ব্লকে আশ্চর্যজনকভাবে একটাই দরপত্র জমা পড়ে এবং সেটা ছিল আদানি গোষ্ঠীর৷ প্রথম দফায় একটিমাত্র দরপত্র জমা পড়ায় তা বাতিল হয়ে যায়৷ ফের দরপত্র ডাকা হলে মাত্র দুটি দরপত্র জমা পড়ে৷ এতে আদানি গোষ্ঠীর দরপত্রটি গৃহীত হয়৷
বর্তমানে আদানি গোষ্ঠীর হাতে রয়েছে আরও ৯টি কয়লা খনি, যেখানে মজুত কয়লার পরিমাণ ৩০ হাজার লক্ষ টন৷ বলা যায়, মোদি সরকারের বদান্যতায় দেশের কয়লা শিল্পে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করেছে আদানি গোষ্ঠী৷