পুলক মিত্র
বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রতিনিয়ত নিশানা করে থাকে বিজেপি৷ এমন অনেক বিরোধী নেতা রয়েছেন, যাঁদের একসময় দুর্নীতির ইসু্যতে হামেশাই কাঠগড়ায় তুলতেন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারা৷ কিন্ত্ত দলবদল করে বিজেপিতে যোগ দিতেই তাঁদের সব কলঙ্ক ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে৷ শুধু তাই নয়, দলত্যাগী এইসব নেতাদের পুরস্কৃতও করেছে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের দল৷
বিরোধী নেতারা বিজেপিকে ‘ওয়াশিং মেশিন’ বলে কটাক্ষ করে থাকেন৷ কেন্দ্রীয় সংস্থার হাত থেকে বাঁচতে ইদানিংকালে বিরোধী শিবিরের বহু নেতাই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন৷ এরকম একগুচ্ছ নেতার নাম এখানে তুলে ধরা যেতে পারে৷ এঁদের মধ্যে জাতীয় স্তরে ২ জন উল্লেখযোগ্য নেতা হলেন, জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি (অজিত পাওয়ার গোষ্ঠী)-র প্রফুল্ল প্যাটেল এবং জি জনার্দন রেড্ডি৷ প্রফুল্লর বিরুদ্ধে দুর্নীতির এবং রেড্ডির বিরুদ্ধে অবৈধ খনি কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷ দুজনই সম্প্রতি বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন৷ তারপরই তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত বন্ধ করার কথা জানিয়ে রিপোর্ট পেশ করেছে সিবিআই৷
২০২৩ সালের কর্নাটকে বিধানসভা ভোটের আগে জনার্দন রেড্ডি বিজেপি ত্যাগ করে কর্নাটক রাজ্য প্রগতি পার্টি তৈরি করেছিলেন৷ কিন্ত্ত গত মাসে তিনি তাঁর দলকে বিজেপির সঙ্গে মিশিয়ে দেন৷
কলঙ্কিত নেতাদের স্বাগত জানিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন বলেছেন, ‘দলের দরজা খোলা’ রয়েছে এবং ‘দলে প্রত্যেকে স্বাগত’৷ দলত্যাগী নেতাদের দুর্নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেছিলেন, দল সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে৷
এই নেতাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁদের লোকসভার টিকিট এবং তারকা প্রচারকের মর্যাদা দিয়েও পুরস্কৃত করা হয়েছে৷
প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মধ্য কলকাতার বাসিন্দা তাপস রায়৷ ৫ বারের বিধায়ক ছিলেন তাপসবাবু৷ পুরসভায় নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁর মধ্য কলকাতার বাড়িতে তল্লাশি চালায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট৷ সেই তল্লাশি প্রসঙ্গে রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ‘চোর’ বলে আক্রমণ করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, “চোরের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হবে৷ এঁরা সবাই চোর৷ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাঁদের কারাগারে নিক্ষেপ করবে৷” শুভেন্দুও একসময় তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী ছিলেন৷ ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে তিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন৷ তাপসবাবু কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে বিজেপি৷
অনেক জলঘোলা, জল্পনার পর বীরভূমে বিজেপি প্রার্থী করেছে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস দেবাশিস ধরকে৷ আয়-বহির্ভূত সম্পত্তি মামলায় ২০২২ সালে তাঁর বাড়িতে এবং রোজ ভ্যালি চিটফান্ড মামলায় অভিযুক্ত ব্যবসায়ী সুদীপ্ত রায়ের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিল সিআইডি৷
কোচবিহারের পুলিশ সুপার ছিলেন দেবাশিস৷ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের সময় সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে ৪ জনের মৃতু্যর ঘটনায় তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল৷
এবার ভিন রাজ্যের দিকে চোখ ফেরানো যাক৷ মহারাষ্ট্রে বিজেপির তারকা প্রচারকদের তালিকায় রয়েছেন অজিত পাওয়ার৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনে অজিতের দল এনসিপি-কে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আক্রমণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ গত বছরের জুলাই মাসে দাদা শরদ পাওয়ারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন অজিত এবং নিজেকে আসল এনসিপি বলে দাবি করেন তিনি৷ বর্তমানে তিনি মহারাষ্ট্রের উপ মুখ্যমন্ত্রী৷ রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে অজিতের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছিল৷ এর মধ্যে রয়েছে, সমবায় ব্যাঙ্ক এবং মহারাষ্ট্রে সেচ দুর্নীতি মামলা৷
অজিতের বিদ্রোহ এবং মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বাধীন সরকারে যোগদানের সপ্তাহখানেক আগে ভোপালে এক সভায় সেচ দুর্নীতি নিয়ে এনসিপিকে নিশানা করেছিলেন মোদি৷ গত মাসের গোড়ার দিকে ২৫ হাজার কোটি টাকার মহারাষ্ট্র সমবায় ব্যাঙ্ক দুর্নীতি মামলা বন্ধ করার কথা জানিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করেছে আর্থিক অপরাধ দমন শাখা৷
শুধুমাত্র অজিত পাওয়ার নন, গত ফেব্রুয়ারিতে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং প্রবীণ কংগ্রেস নেতা অশোক চবন৷ এরপর তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য করা হয় এবং বিজেপির তারকা প্রচারকদের তালিকায় নাম রয়েছে তাঁরও৷ অজিতের মতই তাঁর বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানিয়েছিলেন মোদি৷ ২০১৪ সালের এক নির্বাচনী সভায় চবনকে টিকিট দেওয়ার জন্য কংগ্রেসকে ‘নির্লজ্জ’ বলে আক্রমণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ চবনের নান্দেড় কেন্দ্রে নির্বাচনী সভায় তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
চবনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৯৯৯-এর কার্গিল যোদ্ধা এবং তাঁদের বিধবা স্ত্রীদের জন্য তৈরি তৈরি ৩১-তলার সমবায় আবাসনের প্রাথমিক সুবিধাভোগী হলেন, অশোক চবন এবং তাঁর পরিবার৷ ইডি এই কেলেঙ্কারির তদন্ত চালাচ্ছে এবং চবনকে অভিযুক্ত করেছে৷
প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এবং শিল্পপতি নবীন জিন্দলকে বিজেপিতে যোগদানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র থেকে প্রার্থী করা হয়েছে৷ ২০১৪ সালের অক্টোবরে সেসময়ের কংগ্রেস-শাসিত ওই রাজ্যের কুরুক্ষেত্রে এক নির্বাচনী সভায় মোদি বলেছিলেন, “কেলেঙ্কারি, লুঠ, দুর্নীতি এবং জমি কেলেঙ্কারি” সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে৷ ঝাড়খণ্ড এবং মধ্যপ্রদেশে কয়লা ব্লক বণ্টন-সংক্রান্ত অনিয়মের ৩টি মামলায় সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের স্ক্যানারে রয়েছেন নবীন৷
২০১৪-র নির্বাচনী প্রচারে কয়লা ব্লক বণ্টন সহ তদানীন্তন ইউপিএ সরকারের দুর্নীতিকে হাতিয়ার করেছিলেন মোদি৷ ২০১৪ সালের নভেম্বরে ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরে এক সমাবেশে মোদি বলেছিলেন, ঝাড়খণ্ডের খনিজ সম্পদকে তিনি লুঠ হতে দেবেন না৷ গত মাসে সংসদে পেশ করা ভারতীয় অর্থনীতি-সংক্রান্ত শ্বেতপত্রে কয়লা ব্লক কেলেঙ্কারিও ঠাঁই পেয়েছে৷
নির্বাচনী বন্ডে যে ১০ জন শীর্ষ দাতার নাম রয়েছে, সেখানে রয়েছে জিন্দাল গোষ্ঠীও৷ গত ৫ বছরে এই গোষ্ঠীর দেয় অর্থের পরিমাণ ২০২ কোটি টাকা৷
এবারের লোকসভা ভোটের মুখে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের একমাত্র কংগ্রেস সাংসদ গীতা কোড়া এবং তারপর তিনি ঝাড়খণ্ডের সিংভূম থেকে প্রার্থী হন৷ কে এই গীতা কোড়া? ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়ার নাম মনে আছে, যিনি কয়লা ব্লক বণ্টন মামলায় দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১৭ সালে জেলে গিয়েছিলেন? গীতা হলেন তাঁর স্ত্রী৷
২০১৮ সালে গীতা যখন কংগ্রেসে যোগ দেন, তখন তার তীব্র নিন্দা করেছিল বিজেপি৷ সেসময় বিজেপি বলেছিল, “দুর্নীতিতে অভিযুক্ত একজন মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রীকে দলে নিয়ে কংগ্রেস একে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দিল৷”
মনে পড়ে, ২০১৫ সালে এই রাজ্যের দায়িত্বে থাকা বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংয়ের সেই অতি পরিচিত উক্তির কথা? সিদ্ধার্থনাথ বলেছিলেন, “ভাগ মুকুল ভাগ” স্লোগান তুলেছিলেন৷ পরবর্তীকালে সেই মুকুল বিজেপিতে যোগ দিয়ে দলের সর্বভারতীয় সহ সভাপতি হয়েছিলেন৷ বিজেপির টিকিটে তিনি বিধায়কও হয়েছিলেন৷ আসলে বিজেপি যতই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুক, দুর্নীতিগ্রস্ত বিরোধী নেতাদের দলে টেনে তারা বারবার প্রমাণ করেছে, দ্বিচারিতার রাজনীতিতে অন্যদের কয়েক কদম পিছনে ঠেলে দিয়েছে মোদি-শাহের দল৷ বিজেপির ‘ওয়াশিং মেশিনে’ একবার ঢুকলেই, এক নিমেষেই সব কলঙ্ক ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়৷