প্রশান্ত দাস: শেষ হল চতুর্থ দফার নির্বাচন৷ এরমধ্যেই জোড়া জনসভা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের৷ বনগাঁ কেন্দ্রের প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসের সমর্থনে বনগাঁ উত্তরে এবং ব্যারাকপুর কেন্দ্রের প্রার্থী পার্থ ভৌমিকের সমর্থনে নোয়াপাড়ায় আয়োজিত জোড়া জনসভা থেকেই দফায় দফায় মুখ্যমন্ত্রী আক্রমণ শানান গেরুয়া বাহিনীকে৷ বনগাঁর মাটিতে দাঁড়িয়ে ঠাকুরবাডি়র সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে মঞ্চে বক্তৃতা শুরু করেন মমতা৷ এদিন বনগাঁ থেকেই ভোটযুদ্ধের ফলাফলের ভবিষ্যৎবাণী মমতার কণ্ঠে৷ লোকসভা ভোটে বিজেপি গোটা দেশে কত আসন পাবে তা চতুর্থ দফার ভোটের দিনেই জানালেন মমতা৷ মঞ্চ থেকে ‘মোদীবাবু জায়েগা’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন মমতা৷ দর্শকাসন থেকে উত্তর এল ‘দিদি আয়েগা’৷ শুনে মমতা বললেন, “দিদি তো এখানে আপনাদের সঙ্গেই আছে৷ তবে দিদি দিল্লিতে বিরোধী জোট ইন্ডিয়াকে নিয়ে আসবে৷” এরপরেই মমতা সবিস্তার জানালেন কে কটি আসন পাবে দেশে৷ ইন্ডিয়া জোট গোটা দেশে পাবে ৩০০-৩১৫টি আসন, দাবি আত্মবিশ্বাসী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের৷ তিনি বলেন, “এখনও পর্যন্ত যা হিসাব, তাতে ভোট খুব ভাল হয়েছে৷ আর সেটা বুঝে বাবুদের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে৷ ওরা বুঝতে পেরেছে এ বার আর দিল্লিতে মোদীবাবু আসছেন না৷ আমার কাছে এ ব্যাপারে হিসাব আছে৷ এখনও পর্যন্ত যা ভোট হয়েছে তাতে বিজেপি ৪০০ তো দূর ২০০-ও পার করতে পারবে না৷” এবছর ৪০০ পার করার স্লোগান দিয়ে ভোটে নেমেছে বিজেপি৷ তাই নিয়েই কটাক্ষ মমতার৷ তিনি আরও বলেন, “আজকের যে ভোট হচ্ছে, তার হিসাব এখনও আমি জানি না৷ তবে এ পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে বলে দিতে পারি বিজেপি বড়জোর ১৯৫ আসন পাবে৷ আর ইন্ডিয়া গোটা দেশে পাবে ৩০০-৩১৫টি আসন৷” ব্যারাকপুরের মাটি থেকেও এ বিষয়ে কটাক্ষ মমতার, “ওরা বলছে, ইস বার ৪০০ পার৷ আমি বলি পগারপার৷ এবার ইন্ডিয়া জোট জিতবে৷ রাজ্যে শুধু তৃণমূলকে ভোট দেবেন৷ সিপিএমকে ভুলেও নয়৷ ওরা যা করেছিল৷ আর নয়৷”
দুই সভা থেকেই সন্দেশখালিকে হাতিয়ার করে মমতা বলেন, “সন্দেশখালি মোদির জঘন্য কেলেঙ্কারি৷ বিজেপি সন্দেশখালির মা বোনেদের অসম্মান করার জন্য টাকা খরচ করছে, মদ দিচ্ছে, বোমা-গুলি-পিস্তল দিচ্ছে৷ আমি ওদের বলি একটা মা বোনের সম্মান চলে গেলে সেই সম্মান ফিরবে না৷ মা বোনেদের নিয়ে এই চক্রান্তের খেলা খেলবে না৷ নরেন্দ্র মোদি জেনে রাখো, আমাদের এখানে মা বোনেদের গায়ে হাত দিতে গেলে সবাই ভয় পায়৷ হাত দিলে তাকে জেলে থাকতে হয়৷ এটা তোমাদের উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ নয়৷” বনগাঁর বিজেপির প্রার্থী শান্তনু ঠাকুরকে নাম না করে আক্রমণ মমতার৷ প্রশ্ন ছোড়েন তিনি, “এখানকার বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছেন, কী করেছেন?” দর্শকাসন থেকে সমস্বরে জবাব কিছু করেননি৷ শুনে মমতা বললেন, “না করেছে৷ আমরা ধরে ফেলেছি৷ নাগরিকত্ব দেব বলে কিছু কিছু জায়গায় টাকা তুলেছে৷” মতুয়াদের নিঃশর্তে অধিকার দিচ্ছে না কেন্দ্র, মন্তব্য মমতার৷ এ প্রসঙ্গেও বিঁধেছেন শান্তনুকে৷ তিনি বলেন, “মতুয়াদের নিঃশর্তে অধিকার দিচ্ছেন না কেন মোদি? আপনারা বরং এক কাজ করুন৷ এখানকার যে বিজেপি প্রার্থী তাঁকে বলুন ফর্ম ফিল আপ করতে৷ দেখবেন করবে না৷ কেন করেননি? তার কারণ তিনি বিদেশি হয়ে যাবেন৷ আসলে এটা একটা চক্রান্ত৷” বনগাঁ থেকে সিএএ প্রসঙ্গে গর্জে উঠে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সিএএ করতে দেব না৷ আপনাদের সংরক্ষণ কেউ আটকাতে পারবে না৷ কিছু করতে হলে আমার লাশের উপর দিয়ে যেতে হবে মোদিকে৷” ব্যারাকপুর থেকেও এনআরসি না করতে দেওয়ার ডাক মমতার৷ তিনি বলেন, “এনআরসি করতে দেব না৷ নিরাপত্তা আমাদের দায়িত্ব৷” এদিন বনগাঁয় দাঁড়িয়ে মমতা বালা ঠাকুরকে যোগ্য সম্মান দেওয়ার কথাও বললেন মমতা৷ তাঁর ভাষায়, “রাজ্যসভায় প্রার্থী করে সম্মান দেখিয়েছি৷”
রবিবার ভাটপাড়ার জনসভায় প্রধানমন্ত্রীকে উল্টো করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দেওয়া প্রসঙ্গে এবার অর্জুন গড়ে দাঁড়িয়ে অর্জুনকেই বিঁধলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ নাম না করে কটাক্ষের সুরে বলেন, “এখানকার প্রার্থীর বিষয়ে কথা বলতে চাই না৷ ছেলেকে দিয়ে উল্টো ছবি কেন দিলেন? রবীন্দ্রনাথের ছবিটাও চেনা যায় না? বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে দিতে হয়, রবীন্দ্রনাথের ছবি উল্টে দিতে হয়? সোজা করে দিতে পারেন না? ছবি যখন দেয়, বলে মোদিজি জিন্দাবাদ৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জিন্দাবাদ বলে না৷” তাঁর আরও সংযোজন, “দোষ প্রধানমন্ত্রীর নয়৷ উনি জানেন না৷ দোষ তাঁর, যাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে৷ যাঁর কথায় প্রার্থী করা হয়েছে৷” বাংলার সংস্কৃতি বিজেপি নেতৃত্বরা জানেন না, বলেও কটাক্ষ মমতার৷ পাশাপাশি মোদী গ্যারান্টি কে ‘ফোর টুয়েন্টি’ বলেও উল্লেখ করেন মমতা৷ এসএসসি প্রসঙ্গেও বিজেপিকে খোঁচা মুখ্যমন্ত্রীর, “চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই, কিল মারার গোঁসাই৷ ” বিজেপির মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন নিয়েও সরব মমতা৷ তিনি বলেন, “এত বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কী করে? সকাল থেকে মোদির মুখ আর প্রচার৷ এ দিকে ১০০ দিনের কাজের টাকা নেই৷ আমরা দেব৷ ভাটপাড়া মিলও আমরা খুলিয়েছি৷ জলের ৭০ শতাংশ টাকা, জমি এবং রক্ষণাবেক্ষণ সব রাজ্য সরকার করে৷ মোদিবাবু কিচ্ছু করেনি৷ আপনারা নাকি বিনা পয়সায় বিদু্যৎ পান৷ বিনা পয়সা গ্যাস পাচ্ছেন? এ হল গ্যাস বেলুনের থেকেও বড় বেলুন৷” রেশনের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকা নিয়ে তোপ দাগেন মমতা, “আমরা গত ২ বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা দিয়েছি৷ কেন্দ্র টাকা দেয়নি৷ ওদের ভাগের ১২ হাজার কোটি টাকা দেয়নি৷ তাহলে মোদির ছবি কেন থাকবে?” প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, মাছ ভক্ষণকারীরা হিন্দুবিরোধী৷ এবার সেই প্রসঙ্গে টেনেই কটাক্ষের সুর মমতার গলায়৷ নিজে রান্না করে খাওয়ানোর কথা বললেন প্রধানমন্ত্রীকে৷ মমতার ভাষায়, “মোদিবাবু আপনি খেয়ে দেখুন না স্বাদটা কেমন? কথা দিচ্ছি, কাউকে দিয়ে করাব না, নিজে রান্না করব৷ ছোট থেকে রান্না করি৷ আমার কাছে জাতপাত বলে কিছু নেই৷ আসল মানুষ৷”
কেন্দ্রের দিকে ইছাপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরি বন্ধ নিয়ে আঙুল মমতার৷ মমতা বলেন, “ইছাপুর কারখানা বন্ধ করে দেশের বরাত কেন বিদেশে দিয়েছো? সৌধ, রাস্তাঘাট, জল করেছি৷ কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ছয় লেনের করা হয়েছে৷ ডানকুনি থেকে কল্যাণী পর্যন্ত ইকোনমিক করিডোর হচ্ছে৷ ওরা বলে, এইমস করেছি৷ আমরা ১৮০ একর জমি দিয়েছি বিনামূল্যে৷ ওরা কি বলে? বলে না৷ এই জলে আমরাও টাকা দিই৷ কিন্ত্ত ওরা বলে না৷” অন্যদিকে, বনগাঁয় সীমান্ত বাণিজ্য সংক্রান্ত ল্যান্ডপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের অধীনে নিয়ে আসায় এবং রাজ্য সরকার তার ট্যাক্স নেওয়ায় বনগাঁ পুরসভার তরফে ল্যান্ডপোর্টের তরফে যুক্ত হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পডে়ন৷ এ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বনগাঁবাসীকে আশ্বস্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ ব্যারাকপুর থেকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে স্মরণ মমতার৷ তাঁর ভাষায়, “জ্যোতিবাবুর নাপিত কানের কাছে বলতেন, মমতা৷ চুল খাড়া হয়ে যেত জ্যোতিবাবুর৷ মানুদা বলতেন সেই গল্প৷ মোদির এখন এক হাল৷ আমার নাম নেয়৷” ইচ্ছেকৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে, আগেই মৃতু্য হবে মমতার, এমনই মন্তব্য করলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই৷ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “২০২১ সালের ভোটের আগে লক্ষ্মীর ভান্ডার, বিনামূল্যে রেশন, স্মার্টকার্ড করেছি৷ সবুজসাথী ম্যানিফেস্টোয় ছিল না৷ তবু দিই৷ কথা দিয়ে কথা না রাখলে আগেই মৃতু্য হবে আমার৷ যেটা পারব, ততটাই বলব৷” পাশাপাশি এদিন গত লোকসভা নির্বাচনের স্মৃতিচারণা করে মমতা প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি দেন প্রধানমন্ত্রীকে৷ তিনি বলেন, “গত বছরের লোকসভা নির্বাচন মনে আছে? দাঙ্গা লাগিয়েছিল৷ আমি ছুটে এসেছিলাম৷ আমায় গালাগাল দিয়েছিল৷ আমি থামিনি৷ সব পার্টি অফিস রং করিয়েছি৷ সব জায়গায় একা ঘুরে বেডি়য়েছি৷ আয়, কত ক্ষমতা আছে? আমি একা লড়তে পারি৷”
সোমবার ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিকের হয়ে প্রচার করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ওই কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী অর্জুন সিংহ৷ এরপর বিজেপিকে একের পর এক তোপ দেগেছেন মমতা৷ কেন্দ্র ১০০ দিনের কাজের টাকা থেকে বিনামূল্যে রেশন, কোনওটাই দেয়নি বলে দাবি করেছেন মমতা৷ তিনি আরও জানিয়েছেন, এনআরসি তিনি করতে দেবেন না৷
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘পার্থকে আপনারা সকলে চেনেন? ওঁকে ভোট দেবেন৷ ও রাজ্যের মন্ত্রী৷ কিন্ত্ত ও বলেছে, আমার মন্ত্রিত্ব চাই না৷ মানুষের হয়ে কাজ করতে চাই৷ সংসদে তাঁদের কথা তুলে ধরতে চাই৷’
মমতা আরো বলেন, ‘হাজার টাকার বিনিময়ে মায়েদের দিয়ে যা ইচ্ছা লিখিয়ে নিচ্ছে৷ সন্দেশখালি মোদির জঘন্য কেলেঙ্কারি৷ মনে রাখবেন, এ জিনিস যেন না হয়৷ বাংলা এ সব বরদাস্ত করে না৷ আমাদের ভাই-বোনেরা একে অপরকে সম্মান করে৷ যদি কোথাও কোনও ঘটনা ঘটে, আমরা ব্যবস্থা নিই৷ যদি দাঙ্গা না চান, একটি ভোটও নয় বিজেপিকে৷ ভোট চলছে৷ গরমে ভোটের হার একটু কম৷ যাঁর যাঁর ভোট নিজে দেবেন, যাতে ভোটার তালিকায় নামটা থাকে৷ ভোট গণতান্ত্রিক অধিকার৷’
মমতা বলেন, ‘এনআরসি করতে দেব না৷ নিরাপত্তা আমাদের দায়িত্ব৷ মোদি হটাও৷ বিজেপি হটাও৷ জয় হিন্দ৷ তৃণমূল কংগ্রেস জিন্দাবাদ৷ বঙ্কিমচন্দ্র এই নৈহাটির মানুষ, যিনি ‘বন্দে মাতরম’ লিখেছিলেন৷ বাংলাই পথ দেখাবে৷ সরকার তৈরি করতে মদত দেবে৷ দেখতে হবে, দেশ যাতে বিক্রি না হয়, মায়ের অসম্মান যাতে না হয়৷’