মঙ্গলবার ছাত্রদের পূর্ব ঘোষিত নবান্ন অভিযান ঘিরে শহরজুড়ে ছিল কড়া নিরাপত্তা। তার মধ্যেই ঘটে গেল একাধিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কয়েক জায়গায় হিংসাত্মক হয়ে ওঠে এই আন্দোলন। কোথাও ভাঙা হয় পুলিশের ব্যারিকেড, আবার কোথাও আক্রমণ করা হয় পুলিশকে। যা নিয়ে শহর জুড়ে ধুন্ধুমার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শহরের ১৯ জায়গায় ব্যারিকেড করা হলেও সেই ব্যারিকেড টপকানোর চেষ্টা করে আন্দোলনকারীরা। কোথাও কোথাও পুলিশের ব্যারিকেড বালির বাঁধ হয়ে ওঠে। একদিকে পুলিশ ব্যারিকেড দিচ্ছেন, অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা সেই ব্যারিকেড সরিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে শহরজুড়ে শুরু হয় এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
ফলে রাজ্য পুলিশের দৃষ্টিতে ‘বেআইনি’ ঘোষিত এই আন্দোলন আটকাতে পুলিশকে লাঠিচার্জ ও জলকামান ব্যবহার করতে হয়। অনেক জায়গায় আন্দোলনকারীরা যেমন আহত হন, তেমনি মিছিল আটকাতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের হাতে আক্রান্ত হন অনেক পুলিশ কর্মীও। কোথাও কোথাও ব্যারিকেড সরাতে গিয়ে পুলিশের উদ্দেশ্যে হাতে থাকা ব্যানারও ছুঁড়ে মারে আন্দোলনকারীরা। আদতে ছাত্রদের এই অভিযান বলা হলেও মূলত বিজেপি-র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে এই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও একাধিক সংগঠন এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এমনকি সরকারি কর্মচারীদের একটি অংশও এই আন্দোলনে অংশ নেয়।
এই আন্দোলন আটকাতে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত মোট ১২৬জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদিকে পুলিশের ওপর আন্দোলনকারীদের জুলুম ও মারধর করার প্রতিবাদে বুধবার রাজ্যজুড়ে ১২ ঘন্টার বনধ ডাকল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। পাশাপাশি, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নবান্ন অভিযানে ধৃতদের ছাড়াতে আইনি এবং আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা করেছেন।
প্রসঙ্গত মঙ্গলবারের নবান্ন অভিযানে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন চিত্র ধরা পড়ে। আন্দোলনকারীদের কারও হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড, কারও হাতে ব্যানার। কেউ প্ল্যাকার্ডে লেখেন ‘মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’, কেউ ব্যানারে লেখেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। কেউ আবার হাতে নেন ভারতের জাতীয় পতাকা। কলেজ স্কোয়ার থেকে একটি মিছিল প্রথমে শুরু হয়। সেই মিছিল এগিয়ে চলে নবান্নের দিকে। আবার হেস্টিং থেকে নির্ধারিত আরও একটি মিছিল দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ দিয়ে নবান্নের দিকে যাত্রা শুরু করে। এই মিছিল আটকাতে পুলিশ অনেক জায়গায় আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে ফেরৎ পাঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন।
জানা গিয়েছে, সাঁতরাগাছির কাছে ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। পাল্টা পুলিশের রেপিড অ্যাকশন ফোর্স (র্যাফ) জলকামান ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। নাছোড় আন্দোলনকারীরা সেখানে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোঁড়ে। আন্দোলনকারীদের ছোঁড়া সেই ইটের ঘায়ে আহত হন এক পুলিশ কর্মী। এই ঘটনায় প্রদীপ ঘোড়ুই নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ধৃত ওই ব্যক্তি পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। এখানে দফায় দফায় বিক্ষোভ শুরু করে আন্দোলনকারীরা। সেই বিক্ষোভ হটাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় পুলিশকে। অবশেষে সাঁতরাগাছিতে পিছু হটে আন্দোলনকারীরা। পাশাপাশি তারা ঘোষণা করে নবান্নে একটি ডেপুটেশন দেবে। এই ডেপুটেশনের কপি পুলিশ আধিকারিক মারফত নবান্নে পৌঁছে দেওয়ার দাবি জানায়। ফলে কোনও আন্দোলনকারীর উপর লাঠিচার্জ বা গ্রেপ্তার না করার আহ্বান জানায় আন্দোলনকারীরা।
একই পরিস্থিতি হয় হাওড়া ব্রিজের কাছেও। সেখানেও গার্ডরেল ভাঙার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা। এদিকে হেস্টিংস থেকে নবান্নের দিকে যাওয়া মিছিল আটকাতে রাস্তার মুখে কন্টেনার দিয়ে আটকে দেয় পুলিশ। যার ফলে হেস্টিংস মোড়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ শুরু করে। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ জলকামান নিয়ে আসে। ফাটানো হয় কাঁদানে গ্যাসের সেল। এখানে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারীকে আটক করে পুলিশ।
একইভাবে হাওড়া ব্রিজে আন্দোলনকারীরা তুমুল বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের হঠাতে জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। এমনকি আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের সেলও ফাটানো হয়। ফোরশোর রোডেও ব্যারিকেড ভাঙতে এলে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস চার্জ করে পুলিশ। ব্যবহার করা হয় জলকামানও। হাওড়া ময়দানেও পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। পুলিসকে লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোঁড়ে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের ছোঁড়া ইটের আঘাতে জখম হন আইজিপি ট্রাফিক সহ তিন পুলিস আধিকারিক। গুরুতর জখম হন চণ্ডীতলা থানার আইসি।
এদিকে পিটিএস থেকে নবান্নের দিকে যাচ্ছিল আরও একটি মিছিল। দ্বিতীয় হুগলি সেতু যাওয়ার রাস্তায় পুলিশের দেওয়া ব্যারিকেড খুলে ফেলে আন্দোলনকারীরা। পিটিএস চত্বরের এই আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা পুলিশ। কিন্তু এখানেও বেপরোয়া ছিল আন্দোলনকারীরা। তারা পুলিশের কথায় কোনও কর্ণপাত করেনি। বাধ্য হয়ে পুলিশ একজন আন্দোলনকারীদের আটক করে। চিড়িয়াখানা যাওয়ার রাস্তায় জিরাট ব্রিজের মুখে পথ আটকায় বিক্ষোভকারীরা।
আবার ফোরশোর রোডের উপর রামকৃষ্ণপুর ঘাটের কাছে মাইকিং করে আন্দোলনকারীদের সচেতন করার চেষ্টা করে পুলিশ। পুলিশ আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, এই আন্দোলন বেআইনি। আপনারা চলে যান। তবে এখানেও পুলিশের সেই উপদেশে কর্ণপাত করেনি আন্দোলনকারীরা। উল্টে তাঁদের বাধা পেরিয়ে ব্যারিকেড টপকানোর চেষ্টা করে। এখানেও দফায় দফায় উত্তপ্ত পরিস্থতির সৃষ্টি হয়। পুলিশ আন্দোলনকারীদের হঠাতে কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে। একইভাবে মহাত্মা গান্ধী রোডেও আন্দোলনকারীদের হঠাতে কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটানো হয়। শুরু হয় ধরপাকড়। এমজি রোড-রবীন্দ্র সরণি ক্রসিং সংলগ্ন এলাকায় ইটের আঘাতে জখম হন অমিত রায় নামে এক কর্মী।
এদিকে এই নবান্ন অভিযানকে ঘিরে বিভিন্ন আশঙ্কা করে ঝুঁকি নিতে রাজি হননি বড়বাজারের ব্যবসায়ীরা। অধিকাংশ দোকান এদিন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। কার্যত বনধের চেহারা নেয় রাজ্যের বিখ্যাত এই পাইকারি বাজারে।