বাংলায় এনআরসি হবে না, সিএএ করতে দেব না: মমতা

মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া এবং সুতির জনসভায়

নিজস্ব সংবাদদাতা, বহরমপুর, ১৯ এপ্রিল— শুক্রবার মুর্শিদাবাদে জোড়া জনসভা করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যাপাধ্যায়৷ প্রথম সভা করেন মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত হরিহরপাড়ার কিষাণমাণ্ডির মাঠে৷ দ্বিতীয় সভা করেন জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের সুতিতে৷ প্রথম সভায় মুর্শিদাবাদ এবং বহরমপুর কেন্দ্রের দুই প্রার্থী আবু তাহের খান, ইউসুফ পাঠানের সঙ্গে ভগবানগোলা উপ নির্বাচনের প্রার্থী রিয়াত হোসেন সরকারও ছিলেন৷ এছাড়া ছিলেন বহরমপুর-মুর্শিদাবাদ সাংগঠনিক জেলার প্রথম সারির নেতৃবর্গ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা৷ দ্বিতীয় সভার মঞ্চে ছিলেন প্রার্থী খলিলুর রহমান সহ জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলার নেতৃবর্গ থেকে বিধায়করা৷ দুটি সভা থেকেই এদিন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী চরম আক্রমণ করেন বিজেপি’কে৷ বাদ দেননি কংগ্রেস ও সিপিএমকেও৷ জানিয়ে দেন, বাংলায় এনআরসি হবে না৷ সিএএ করতে দেবেন না৷ যাদের প্রচুর টাকা রয়েছে এবং ইডি, সিবিআই, এনআইএ দেখে ভয় পায়, তারাই বিজেপিপ করে বলে এদিন মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ বাংলায় কংগ্রেস এবং সিপিএম বিজেপির দালালি করে বলেই তাদের সঙেঅগ কোনওরকম জোট হয়নি বলে এদিন তৃণমূল নেত্রী উল্লেখ করেন৷ নরেন্দ্র মোদি শুধু প্রচারই করেছে, কোনও কাজ করেনি বলেও এদিন অভিযোগ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷

এদিন মঞ্চ থেকে মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ভোটটা কষ্ট করে দিতে হবে৷ যারা পরিযায়ী শ্রমিক আছেন, যারা ইদে বাড়ি এসেছেন, ভোট না দিয়ে এক পা নড়বেন না৷ যদি আপনি ভোট না দেন, আগামী দিন আধার কার্ড থেকে আপনার নামটা বাতিল করে দেবে৷ এনআরসিতে ঢুকিয়ে দেবে৷ সিএএ’তে ঢুকিয়ে দেবে৷ এই সুযোগটা দেবেন না৷ দরকার হলে আপনাদের যারা বাইরে নিয়ে যায়, তাদের বলবেন, দাদা মাফ করবেন৷ আমার অধিকার রক্ষা করবার জন্য, আমার পরিবার বাঁচাবার জন্য আমাকে ভোটটা দিতে হবে৷ এটা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার৷ আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, বাংলায় এনআরসি হবে না৷ সিএএ আমি করতে দেব না৷ বাংলায় এনআরসি কি হয়েছে? আসামে ১৯ লক্ষ লোককে বাদ দিয়েছিল৷ যেই আপনি আবেদন করলেন, ব্যাস সব গেল৷ আপনি বিদেশি হয়ে গেলেন৷ মনে রাখবেন, আপনারা সবাই নাগরিক৷ কোনও ভয় পাবেন না৷ যার রেশন কার্ড নেই, যার আধার কার্ড নেই, হতাশায় ভুগবেন না৷ ভয় পাবেন না৷ নির্বাচনের পরে দুয়ারে সরকার করিয়ে দেবো৷ ওখানে আবেদন জানাবেন৷ আপনার যা আছে তাই দিয়েই হবে৷ আপনি যে এখানে বসবাস করছেন, এটাই আপনার বড়ো পরিচয়৷’


এরপরই তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো বলেন, ‘সবাই এমএ পাশ করতে পারে না৷ সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কোটিপতি হতে পারে না৷ কিন্ত্ত মনে রাখবেন, ভোটে একটা গরীব মানুষের যে অধিকার, একটা কোটিপতিরও সেই অধিকার৷ আপনাদের সকলের অধিকার সমান৷ যদি সিএএ, এনআরসি আটকাতে হয়, একন আবার ইউনিফর্ম সিভিল কোর্ট করে দিয়েছে ম্যানিফেস্টোয়৷ আদিবাসী, তপশিলী, রাজবংশী, মতুয়া ভাই বোনেরা জানেন, হলে এটা কি হবে? আপনাদের কোনও পরিচয় থাকবে না৷’

এদিনের সভা থেকেও বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলা, মীরজাফর এবং পলাশীর যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আনেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী৷ তিনি বলেন, মুর্শিদাবাদের মানুষ মনে রাখবেন, সিরাজ উদ দৌলা পলাশীর প্রান্তে গদ্দার মীরজাফরকে তার মাথার মুকুট তুলে দিয়ে বলেছিলেন, তুমি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করো৷ আমার মুকুট নিয়ে নাও৷ কিন্ত্ত সেদিন মীরজাফর কথা শোনেনি৷ ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলাকে হারিয়ে দিয়েছিল৷ মনে রাখবেন, সেরকম আজও রয়েছে৷ বিজেপি কারা করেয় যারা প্রচুর টাকা করেছে৷ তারা ইডি, সিবিআই, এনআইএ, ইনকাম ট্যাক্সকে ভয় পায়৷ বিজেপি দশ বছরে একটা কাজও মানুষের জন্য করেনি৷ কিন্ত্ত দাঙ্গা লাগিয়েছে৷ যুদ্ধ লাগিয়েছে৷ অশান্তি করেছে৷ অত্যাচার করেছে৷ জিনিসের দাম বাড়িয়েছে৷ বেকারি বাড়িয়েছে৷ কৃষকদের নূ্যনতম সহায়ক মূল্য দেয় না৷ আমরা কৃষকদের বার্ষির ভাতা দশ হাজার টাকা দিই৷ এত বড়ো সাহস কয়েকদিন আগে বিজেপি বলেছে, তিন মাস পরে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার উঠিয়ে দেবো৷ আমরা বলছি, তিনমাস পরে তোমাদের ভারতবর্ষ থেকেই একদম গুটিয়ে দেবো৷ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কথা মুখে আনবে না৷ বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও৷ একটা মেয়েকে কিছু দাওনি৷ শুধু মোদি মুখে প্রচার করে গিয়েছো৷ আর কিছু করোনি৷ রোজ মোদির ছবি৷ মানুষের জন্য কিছু নয়৷ আর বাংলায় দেখুন, শুধু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নয়, মা বোনেরা যাদের ষাট বছর বয়স হয়ে যাবে, তারাও কিন্ত্ত লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাবেন৷ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যতদিন বেঁচে থাকবেন, সারাজীবন পাবেন৷ সমস্ত সরকারি স্কুলের মেয়েরা আজকে কন্যাশ্রী৷ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা কন্যাশ্রী৷ শিক্ষার সাথী, সবুজশ্রী৷ নাইনে উঠলেই সবার সাইকেল৷ বিনা পয়সায়৷ বারো ক্লাসে উঠলেই বিমা পয়সায় স্মার্ট ফোন৷ কেউ দেবেয় কেউ দেয় না৷ আমরা দিই৷ কারণ আমরা মনে করি, মানুষ ছাড়া তৃণমূুল কংগ্রেস নয়৷ মানুষ আছে বলেই তৃণমূল আছে৷’

এ রাজ্যে কংগ্রেস এবং সিপিএম বিজেপির দালালি করে বলেই তাদের সঙেঅগ কোনওরকম জোট হয়নি বলে এদিন উল্লেখ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি বলেন, ‘ইন্ডিয়া জোটকে আমরাই সাহায্য করব৷ নেতৃত্ব দেবো৷ বাংলা নেতৃত্ব দেবে৷ এখানে সিপিএম এবং কংগ্রেস বিজেপি-এর দালালি করে৷ তাই আমাদের সাথে ওদের কোনও সম্পর্ক নেই৷ কংগ্রেস ও সিপিএম তো কেরালেও লড়াই করছে৷ আমার এখানে দেখুন কংগ্রেস-সিপিএম শেয়ারিং করেছে৷ বিজেপির কাছ থেকে কিছু কিছু নিচ্ছে, আর দিচ্ছে৷ আপনাদের বলি, পরশুদিন ছোট্ট একটি ঘটনা ঘটিয়েছিল৷ আমি জায়গাটার নাম বললাম না৷ কালকে আবার ঘটিয়েছিল৷ তাতে ওসি এবং আমার এক ভাইও আহত৷ ১৯ জন আহত হয়েছে৷ কেন অস্ত্র নিয়ে মিছিল করবেন আপনারা? কে আপনাদের অধিকার দিয়েছে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার? কে অধিকার দিয়েছে মণিপুরে দুশোটি চার্চ পুড়িয়ে দেওয়ার? কে অধিকার দিয়েছে মসজিদে গিয়ে বোমা মারার? কে অধিকার দিয়েছে দলিতদের উপর অত্য্যাচার করার? কে অধিকার দিয়েছে সংখ্যালঘু দেখলেই তাঁদের বাড়িতে এনআইএ ঢুকিয়ে দেওয়ার? বলে না যত গর্জে, তত বর্ষে না৷ শূন্য কলসি বাজে বেশি৷’

এরপর তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো বলেন, ‘মোদির গ্যারান্টি কী? বিজেপি নেতারা দিল্লিতে গিয়ে বলছে, একশো দিনের টাকা দেবেন না৷ বাংলার বাড়ি দেবেন না৷ গঙ্গার ভাঙনে টাকা বন্ধ করে দিয়েছে৷ সুতি, ধুলিয়ানে সমস্যা৷ কান্দি মাস্টার প্ল্যান পাঁচশো কোটি টাকা দিয়ে আমরা করে দিয়েছি৷ সুতিতেও আমি আগে প্রায় দেড়শো-দুশো কোটি টাকা খরচ করেছি৷ কিছুদিন আগে আমি এসেছিলাম৷ বলে গিয়েছিলাম৷ আরও একশো কোটি টাকার কাজ হচ্ছে৷ এগুলি নিয়ে আগামী দিনে আমাদের ভাবতে হবে৷ আগামী বিশ বছর কী পরিকল্পনা নেওয়া যায়৷ যাতে বিশ বছর পর্যন্ত মানুষের জীবনটা সুরক্ষিত থাকে৷ গঙ্গার মুখ তো আমরা সরাই না৷ গঙ্গা একদিক গড়ে, অন্যদিক ভাঙে৷ তাই এগুলি গঙ্গা থেকে দূরে করতে হবে৷ সেজন্য পরিকল্পনা বানাতে হবে৷ এগুলি নিয়ে আমরা ভাবনা-চিন্তা করছি৷ মুর্শিদাবাদ জেলায় মেডিকেল কলেজ তৈরি হয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে৷ মাল্টি সুপার হাসপাতাল তৈরি হয়েছে৷ সাগরদিঘিতে চার নম্বর ইউনিট হয়ে গিয়েছে৷ পাঁচ নম্বর ইউনিট হচ্ছে৷ পলিটেকনিক হয়েছে৷ আইআইটি হচ্ছে৷ প্রায় ২৮ লক্ষ বয়স্ক লাকদের ভাতা আমরা আগের মাসে করে দিয়েছি৷ সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে যাঁরা আবেদন করেছিলেন৷’

মোদি এবং বিজেপিকে আক্রমণ করে তিনি এদিন আরও বলেন, ‘বলছে ইসবার চারশো পার৷ সারা ভারতবর্ষে দুশো সিটও পাবে না৷ নিশ্চিন্তে থাকুন৷ ওটা কাগজের সার্ভে৷ বিজেপির সার্ভে৷ টাকা খাওয়ানোর সার্ভে৷ মিথ্যে কথা বলার সার্ভে৷ কারণ বিজেপি মানুষের পকেট কাটে আর নিজের পকেট ভরে৷ এটা ওদের কাজ৷ ওই সার্ভেতে বিশ্বাস করবেন না৷ মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন৷ মাটির দিকে তাকিয়ে দেখুন৷ তাহলে বুঝবেন, এবার বিজেপি আসছে না৷ এবার বিজেপি আসবে না৷’