শোভনলাল চক্রবর্তী
বাংলাদেশে এ যাবৎ কোনও অভ্যুত্থানেই কোনও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি দেশ ছেড়ে পালাননি। সে তিনি বেগম খালেদা জিয়াই হোন বা মহম্মদ এরশাদ। জেল খেটেছেন। কিন্তু পালাননি! সে জন্য তাঁরা টিকেও গিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন! শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা পালিয়ে গেলেন! রাস্তাঘাটে পুলিশ নেই। প্রশাসন নেই। শাসন নেই। চারদিকে উন্মত্ত জনতা। ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবের বিশাল মূর্তির গলায় দড়ি বেঁধে টান মারছে ক্ষিপ্ত মানুষ। কোথাও গা বেয়ে উঠে হাতুড়ির বাড়ি মারছে বিগ্রহের মুখে-চোখে-মাথায়। পরাচ্ছে জুতোর মালা। কোথাও পিছন থেকে বুলডোজ়ার এনে দৈত্যাকার আঁকশি দিয়ে ঘা মারছে মূর্তির ঘাড়ে। উপর্যুপরি ধাক্কায় ঘাড়টা লটরপটর করছে। একটা সময়ে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মাথাটা। ভূলুণ্ঠিত সেই মুন্ডুর উপর ছ্যারছেরিয়ে মূত্রবিসর্জন করতে শুরু করল কিছু চেহারা। মনে হচ্ছিল, এ সব কী দেখছি? এগুলো কি সত্যিই ঘটছে? ঘটছে বাংলাদেশে?‘নৈরাজ্য’, ‘অরাজকতা’ শব্দগুলো জেনে এসেছি। ইতিউতি লঘু অর্থে প্রয়োগও করেছি। কিন্তু সেটা কখনও এ ভাবে গায়ের উপর এসে পড়েনি। ওই দৃশ্যগুলো কলার ধরে দেখিয়ে দিচ্ছিল, নৈরাজ্য কাকে বলে! অরাজকতা কাকে বলে!
এই বাংলাদেশকে আমরা চিনতাম না। চিনি না। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক প্রথম গিয়েছিলাম বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডিতে। সেই কবে থেকে ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসে মুজিবের হত্যার বর্ণনা গজগজ করেছে মগজে। ধানমন্ডির বাড়ির পিছনে তখনও আলাদা সংগ্রহশালা হয়নি। শুধু মূল বাড়িটাই ছিল। এখন ঘরগুলোর দরজা সলিড কাচ দিয়ে আটকানো। কিন্তু তখন দিব্যি ভিতরে যাওয়া যেত। দেওয়ালে দেওয়ালে বুলেটের ব্রাশ ফায়ারের গর্ত। সেগুলো ছোট ছোট কাচে ঢাকা। গুলির আঘাত সিলিং ফ্যানের ব্লেডে। ১৯৭৫ সালের সেই রাতের পর থেকে প্রায় অবিকৃত রেখে দেওয়া হয়েছে ঘরগুলো। দোতলা থেকে এক তলায় নামার সিঁড়ি। ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়ালে দোতলায় সিঁড়ির শুরুতে মেঝের উপর গুলিবিদ্ধ মুজিবের একটা ফ্রেমে বাঁধানো সাদা-কালো ছবি। নিহত মুজিবের চোখ বোজা। চশমা নেই। চুলগুলো ঈষৎ আলুথালু। দুটো হাত মেঝেতে রেখে হাঁটু ভেঙে বসে আছেন। গুলি খেয়ে ওই ভাবেই থপ করে পড়ে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই। পরনে সাদা ফতুয়া আর চেক-কাটা লুঙ্গি। ফতুয়ার বুকের কাছে দু’পাশ বরাবর লম্বালম্বি গোটা চার বা ছয়েক গুলির ফুটো। গর্তগুলো থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। গায়ে কাঁটা দিয়েছিল! তার পরেও অন্তত বার তিনেক বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডিতে গিয়েছি। কিন্তু ছবিটা আর চোখে পড়েনি। সিঁড়িটাও আর ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল! নীচের পোর্টিকোর দেওয়ালে গাঁথা মুজিবের বহুবর্ণ ম্যুরাল ক্ষতবিক্ষত করা হল শাবল দিয়ে! এই বাংলাদেশকে আমরা চিনতাম না। চিনি না।আমাদের আবডালে ঘাপটি মেরে থাকা এই বাংলাদেশকে আমরা চিনতাম না।
এটা ঠিক যে, গত কয়েক বছর ধরেই শুনছিলাম, হাসিনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। শুনতাম, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে হাসিনা শপথ নেওয়ার পরে ১৫ বছর ধরে ভোটের নামে ‘প্রহসন’ হয়েছে বাংলাদেশে। প্রতিটি ভোটেই, বাংলাদেশের বর্ণনায়, ‘ভূমিধস বিজয়’ পেয়েছে হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। বিরোধী বলে কোনও বস্তু নেই। বিএনপি নেতাদের ধরে ধরে জেলে ভরা হয়েছে। সঙ্গে শাসকদলের বিপুল দুর্নীতি। হাসিনাই সম্প্রতি বলেছিলেন, তাঁর পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক! তিনিও হেলিকপ্টার চড়েন! তার সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অত্যাচার। তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। বললেই কোতল। গুমঘরে ঠাঁই। জেদ, দম্ভ এবং স্বৈরাচারের এক বিপজ্জনক ককটেল। তবে একই সঙ্গে এ-ও ঠিক যে, হাসিনার আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সজুত হয়েছিল। তাঁর আমলেই পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো, চট্টগ্রামে সমুদ্রের তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে বিপুল।
তবু এত ক্রোধ, এত ঘৃণা কেন? কেন সারা দেশ জুড়ে এমন জনগর্জন? কেন নির্বিচার হত্যা? কেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইতিহাস-বিধৃত ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা? কেন জাতির জনক মুজিবের প্রতি এই ভয়াবহ জিঘাংসা? তার চেয়েও বড় কথা, কেন একে ‘গণরোষ’ বলে বৈধতা বা ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা? বাংলাদেশের বন্ধুবান্ধবেরা বলেছেন, ১৫ জুলাইয়ের পর থেকেই ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়েছিল জামাতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির এবং হেফাজতিরা। তারাই দাপিয়ে বেড়িয়েছে অরাজকতার জমিতে। স্বৈরাচার থেকে বেরিয়ে কি বাংলাদেশ তা হলে এখন মৌলবাদের দিকে হাঁটছে? যে ছাত্রীরা জিন্স-টপ পরে আন্দোলন করলেন, সেই আন্দোলনই শেষে তাঁদের জিন্স পরার অধিকার কেড়ে নেবে না তো?নোবেলজয়ী ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। একটা প্রশাসন তৈরি হয়েছে। থানা খুলেছে। ছাইয়ের গাদা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে একটা দেশ। একটা জাতি। ঘোর কেটে যাওয়ার পরে ছাত্রসমাজের একটা অংশ লুটের জিনিসপত্র ফেরত দিতে যাচ্ছেন। প্রকাশ্যেই অনুতাপ করছেন। অন্যায় কবুল করছেন। তাঁরা রাস্তায় ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁরাই সাফ করছেন ধ্বংসস্তূপ। তাঁরা কি বুঝেছেন যে, তাঁরা যে আন্দোলনে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ এনেছেন, তা জলে যেতে দেওয়া যাবে না? জ্বলেও যেতে দেওয়া যাবে না! তাঁরা যে ‘প্রলয়বিষাণ’ বাজিয়েছিলেন, সেই বিষাণ বাজতে থাকুক। কিন্তু সেই বিষাণের সুরে প্রলয় যেন না ঘটে।
মনে পড়ে গেল কাঁচা-পাকা হস্তাক্ষরে বাংলাদেশের দেওয়ালে মওলানা ভাসানির প্রশ্ন— ‘শুনো, ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যায়ো না। পরে ফুলের নাম কী দিবা? ফাতেমা চূড়া?’ আমরা এই বাংলাদেশকেই চিনতাম, এই বাংলাদেশকেই চিনতে চাই।
মুসলিমরা রাত জেগে মন্দির পাহারা দিচ্ছেন। দেশের সংখ্যালঘুদের পাশে বুক চিতিয়ে লাঠিসোঁটা হাতে দাঁড়িয়েছেন সংখ্যাগুরুরা। কিন্তু তার সমান্তরালে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় ভিড় বাড়ছে নাচার, অসহায়, শঙ্কিত মানুষের। এখনও।মন্থন চলছে। তাকিয়ে আছে অমৃত-বুভুক্ষু মানুষ।কোনও দেশের সমাজ বা রাজনীতি একমাত্রিক নয়। উভয়ই বহুগামী এবং বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক মহম্মদ ইউনূসের সরকার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে অরাজকতা অনাসৃষ্টির অচিরেই অবসান ঘটানোয় নিশ্চিত উদ্যোগী হবে। এই সময় প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের রাজনীতির নয়। প্রয়োজন পুনরুদ্ধারের, নবনির্মাণের রাজনীতির। এই পুনরুদ্ধার ও নবনির্মাণ সংবিধানের, আইনের। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির এবং পরমতসহিষ্ণুতার। না হলে আবেগের নৌকা অল্প সময়েই তলিয়ে যায়।
বাংলাদেশে সঙ্কট হলে এই উপমহাদেশও সঙ্কটাপন্ন হবে। সে দেশের মাটিতে বর্তমানে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার তুল্যমূল্য বিচারের সময় এটা নয়। শাসনের ক্রমহ্রাসমাণ বৈধতার নিরিখে সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ভেদরেখাটি মুছতে বসেছিল কি না, অনেকেই খেয়াল করেননি। তবে এই মৃত্যু উপত্যকা কোনও ভাবেই বাংলাদেশের হতে পারে না। অবিলম্বে অনিশ্চয়তার অন্ধকার কাটিয়ে দেশবাসী নতুন ভোরের সন্ধান করবে, সেই বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই প্রত্যয়ী। নয়াদিল্লিও উদ্যোগী হলে সেই নতুন সকালে ঢাকার হাত ধরতে সক্ষম। শপথের পরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির যথাযথ পর্যালোচনার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন তরী বাওয়ার এই সুযোগ। দ্রোহকালে যে কোনও সঙ্কটই কিন্তু নতুন সুযোগ। এমনিতেই গত মাসাধিক কাল ধরে বাংলাদেশে যা ঘটছে, সেই ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপহীন। বহু শত প্রাণ বিনষ্ট। বিশেষ যন্ত্রণার বিষয়— অধিকাংশ নিহতই তরুণ, এমনকি কিশোর। সরকারি সংরক্ষণ নীতিকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলনে প্রশাসনের নির্মম গুলিচালনা ও ছাত্রছাত্রী-সহ অন্যান্যের প্রাণহানি— এই ভয়াবহ ঘটনা থেকে শুরু করে সে দেশে বিক্ষোভ-প্লাবন ঐতিহাসিক আকার নিল।
মনে রাখা ভাল, এই সঙ্কট কোনও একটি মাত্র ঘটনার ফল নয়, হতে পারে না। স্পষ্টতই, পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিরুদ্ধে বহু দিন ধরে ক্ষোভের বারুদ জমছিল। তাঁর ও তাঁদের বিরুদ্ধে ছিল কর্তৃত্ববাদী অপশাসনের অভিযোগ, লাগামছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ, বিরোধীদের উপর তীব্র দমন ও নিষ্পেষণের অভিযোগ, একের পর এক নির্বাচনে বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেওয়ার অভিযোগ। মানুষের রাগ পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল— বামে, দক্ষিণে, মধ্যগামীদের মধ্যে। আসল কথা, গণতন্ত্রের আবরণে কর্তৃত্ববাদ প্রবেশ করলে তার পরিণতি কেমন হয়, এবং কত দ্রুত তা ঘটতে পারে, ইতিহাস বার বার তা দেখিয়েছে। আবারও দেখাল। ভারতের অতি আস্থাভাজন নিকট প্রতিবেশী দেশ— বাংলাদেশ। ফলে ভারতের পক্ষেও এ এক অস্থির মুহূর্ত।
পলাতক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এখনও দিল্লির আশ্রয়ে আছেন— স্বভাবতই দিল্লিকে অতি সতর্ক পদক্ষেপ করতে হচ্ছে। সতর্ক থাকতে হবে ভারতীয় নাগরিক সমাজকেও, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে। বুঝতে হবে যে, অনেক আগুন জ্বলা, অনেক প্রাণের দাম দিয়েছে বাংলাদেশ। এ বার সে দেশে দ্রুত স্থিরতা ও স্থিতি ফিরুক। ফিরুক গণতন্ত্র। ভারতীয় রাষ্ট্র ও ভারতের নাগরিক সমাজের দিক থেকে এটাই এখন প্রধান কাম্য।