বাসুদেব ধর, ঢাকা, ২২ মে– বাংলাদেশের আওয়ামি লিগ দলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কলকাতায় খুন হয়েছেন৷ তিনি কলকাতায় যাওয়ার পর টানা ৯ দিন নিখোঁজ ছিলেন৷ আজ কলকাতার নিউটাউন এলাকায় সঞ্জিভা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাট থেকে বাংলাদেশি এই সংসদ সদস্যের খন্ড বিখন্ড লাশ উদ্ধার করেছে রাজ্য পুলিশ৷ আনোয়ারুল আজিম বাংলাদেশের ঝিনাইদহ ৪ আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ৷ ঢাকায় প্রাপ্ত খবরে এসব তথ্য জানা গেছে৷ সাংসদকে খুন করেছে বাংলাদেশিরাই৷
জানা গেছে, সাংসদের সম্পূর্ণ লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি৷ দেহের মূল অংশ ট্রলিতে ভরে পাচার করা হয়েছে, বাকি দেহাবশেষ উদ্ধার করা গেছে৷ এ ঘটনায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য৷
বলা হয়েছে, মোট ছয়জন এ হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল৷ তাদের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক৷ সাংসদকে হত্যার পর পাঁচজন দেশে ফিরে আসে এবং একজন এখনো ভারতেই অবস্থান করছে৷ তবে বাংলাদেশে ফিরে আসা পাঁচজনের মধ্যে একজন অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছে বলেও জানা গেছে৷ আর ভারতে অবস্থান করা ব্যক্তিকে আটক করতে চেষ্টা করছে ভারতের পুলিশ৷
ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আজ জানিয়েছেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে বাংলাদেশিরাই হত্যা করেছে৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে তিনি জানান৷
পশ্চিমবঙ্গে আনোয়ারুল আজিমের হত্যাকান্ডের খবর নিশ্চিত হওয়ার পর আজ ঢাকায় নিজ বাসভবনে সংবাদ ব্রিফিং করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ এ সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন৷
আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার ঘটনায় তিন আসামিকে ধরা হয়েছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আরও কয়েকজনকে ধরার চেষ্টায় আছি৷ এটা খুন৷ তাঁকে (আনোয়ারুল আজিম) হত্যা করা হয়েছে৷ এখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরবে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ কারণ, ভারতের কেউ এখানে জড়িত নন৷ এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে আমাদের দেশের মানুষই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এমপি আনোয়ারুল আজিমকে কলকাতার এক বাসায় পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে৷ খুনের উদ্দেশ্য, কারা খুন করেছে, এসব জানতে ভারতের পুলিশ কাজ করছে৷
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, তা তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রকাশ করছি না৷ তদন্ত শেষ হলে জানানো হবে, তিনি কেন খুন হয়েছেন, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে৷ মরদেহ এখনো আসেনি৷ দুই দেশের পুলিশ তদন্ত করছে৷ ভারতের পুলিশ আমাদের জানিয়েছে যে তিনি খুন হয়েছেন, এটা নিশ্চিত৷
এ ঘটনায় আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তদন্ত চলছে৷ যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত, তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, আমরা পরে সেগুলো প্রকাশ করব৷
আনোয়ারুল আজিম ১২ মে চিকিৎসার জন্য দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান৷ ১৬ মে থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন৷ মূলত নিখোঁজের অভিযোগ পাওয়ার পর এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুজনকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ৷ আটক হওয়া ওই দুই ব্যক্তি সম্প্রতি কলকাতা থেকে ফিরেছেন৷ আটক হওয়া দুজনের মধ্যে একজনের নাম আমানুল্লাহ৷
পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার রাতে বলেন, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগের একটি দল কেরানীগঞ্জ থেকে শুরুতে আমানুল্লাহ নামের একজনকে আটক করে৷ পরে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যগুলো ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে জানালে তারা জানায় যে আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন৷
জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুজন জানান, লাশ আছে সঞ্জিভা গার্ডেনে৷ সে খবর দেওয়া হয় কলকাতা পুলিশকে৷ পরে আজ বুধবার এই লাশ উদ্ধার করে ভারতের পুলিশ৷
আরও জানা গেছে, যে ফ্ল্যাট থেকে আনোয়ারুল আজিম আনারের খন্ডবিখন্ড লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার মালিকও একজন বাংলাদেশি৷ তিনি ভারতে গিয়ে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ওই ফ্ল্যাট কিনেছেন৷ কলকাতার পুলিশ তাকেও খুঁজছে বলে জানানো হয়েছে৷
কলকাতা বিধাননগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা বলেছেন, ক্যাব চালক স্বীকারোক্তি দিয়েছে ১৩ মে যে ব্যক্তিকে সে গাড়িতে তুলেছিল তাকে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে লাশ ছড়িয়ে দিয়েছে৷
পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যে ফ্ল্যাটে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে; সেটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে৷ সেখানে কাউকে এখনো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷
পুলিশের সূত্র বলেছে, ওই ফ্ল্যাটে তিনজনকে ঢুকতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে৷ তাদের মধ্যে একজন নারী৷ তবে ওই তিনজনকে সেখান থেকে বের হতে আর দেখা যায়নি৷
আজ সকালে রাজধানীর বাড্ডায় এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, আনোয়ারুল আজিমের ঘটনায় বাংলাদেশের পুলিশ কলকাতার পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে৷ তারা যোগাযোগ রাখছে৷ কোনো অগ্রগতি থাকলে জানানো হবে৷
পূর্ববর্তী খবরে বলা হয়, পুলিশ সূত্র জানায়, ভারতে গিয়ে ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ারুল কলকাতায় তাঁর পূর্বপরিচিত বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন৷ গোপালের সঙ্গে তাঁর ২৫ বছরের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে৷ ১৩ মে বেলা ২টার (কলকাতার স্থানীয় সময়) দিকে আনোয়ারুল চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা বলে গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বের হন৷ তখন গোপালকে বলে যান, তিনি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসবেন৷ এরপর আর বাসায় না ফেরার কারণে ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় গোপাল বিশ্বাস একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন৷
গোপাল বিশ্বাস জিডিতে উল্লেখ করেন, আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে তাঁর ২৫ বছর ধরে পারিবারিক সম্পর্ক৷ ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আনোয়ারুল আজিম কলকাতার মন্ডলপাড়া লেনে তাঁর (গোপাল বিশ্বাস) বাড়িতে আসেন৷ তিনি কলকাতায় আসেন ডাক্তার দেখাতে৷ পরদিন ১৩ মে স্থানীয় সময় (কলকাতা) বেলা পৌনে ২টার দিকে ডাক্তার দেখানোর জন্য গোপাল বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বের হন আনোয়ারুল আজিম৷ যাওয়ার সময় তিনি (আনোয়ারুল) বলে যান, দুপুরে খাবেন না৷ সন্ধ্যায় ফিরে আসবেন৷ পরে তিনি কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে এসে নিজেই গাড়ি ডেকে চলে যান৷
জিডির তথ্য অনুযায়ী, আনোয়ারুল আজিম সন্ধ্যায় গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ফেরেননি৷ আনোয়ারুল আজিমের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে গোপালকে একটি বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, বিশেষ কাজে তিনি দিল্লি যাচ্ছেন৷ সেখানে পৌঁছে তিনি ফোন করে গোপাল বিশ্বাসকে জানাবেন, গোপাল বিশ্বাসের ফোন করার দরকার নেই৷ পরে ১৫ মে স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ২১ মিনিটে আনোয়ারুল আজিমের নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরেকটি বার্তা আসে৷ তাতে আনোয়ারুল আজিমের দিল্লি পৌঁছানোর কথা জানিয়ে বলা হয়, আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন, ফোন করার দরকার নেই৷ আনোয়ারুল আজিমের নম্বর থেকে একই বার্তা বাংলাদেশে তাঁর বাড়ির লোকজন এবং ব্যক্তিগত সহকারীকে পাঠানো হয়৷