নিহতদের মধ্যে রয়েছেন একজন সাংবাদিক
ঢাকা, ১৮ জুলাই: ক্রমশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। আন্দোলনের জেরে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে চলেছে ওপার বাংলায়। তবুও কোটা সংস্কারের দাবিতে অনড় আন্দোলনকারীরা। আর সেই আন্দোলন ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বৃহস্পতিবার সংরক্ষণ বিরোধী ছাত্র-যুবদের ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ (কমপ্লিট শাটডাউন) কর্মসূচির ফলে আন্দোলনের মাত্রা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ফের হিংসার হাতছানি রাজধানী ঢাকায়। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উঠে এসেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত সেদেশে মোট ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর উত্তরায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও র্যাবের সংঘর্ষ শুরু হয় বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পর থেকে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘শাটডাউন’ ঘিরে রাজধানীর মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে হামলা চালানো হয়। ব্যাপকভাবে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকারীরা। সেখানে থাকা বেশ কিছু সরকারি গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এই তাণ্ডব চলে। পরে আগুন ওই ভবনের অন্য ফ্লোরেও ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের অর্থাৎ বিটিভি-র প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিটিভি কার্যালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে বিক্ষোভকারীরা। সেখানে থাকা দুটি মাইক্রোবাস ও কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নরমপন্থী মনোভাবই বজায় রেখেছেন। তিনি বারবার আন্দোলনকারীদের আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।
এদিকে ভারত সরকার প্রতিবেশী ও বন্ধু দেশের এই অস্থির পরিস্থিতির ওপর প্রতি মুহূর্তে নজর রাখছে। বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লি বাংলাদেশে থাকা ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে একটি নির্দেশিকাও জারি করেছে। সেখানে থাকা ভারতীয়দের বলা হয়েছে, বাড়ির বাইরে না বেরতে। কেন্দ্র সরকারের তরফে বাংলাদেশে প্রবাসী ভারতীয়দের এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নয়াদিল্লি আপৎকালীন একাধিক হেল্পলাইন নম্বরও চালু করেছে। জরুরি সেই হেল্পলাইন নম্বরগুলি হল: ভারতীয় হাই কমিশন, ঢাকা ৮৮০ ১৯৩৭৪০০৫৯১। সহকারী হাই কমিশন, চট্টগ্রাম ৮৮০ ১৮১৪৬৫৪৭৯৭/৮৮০ ১৮১৪৬৫৪৭৯৯। সহকারী হাই কমিশন, রাজশাহী ৮৮০ ১৭৮৮১৪৮৬৯৬। সহকারী হাই কমিশন, সিলেট ৮৮০ ১৩১৩০৭৬৪১১। সহকারী হাই কমিশন, খুলনা ৮৮০ ১৮১২৮১৭৭৯৯। সমস্ত নম্বরগুলি হোয়াটসঅ্যাপেও উপলব্ধ বলে জানা গিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর সংবাদ পত্র প্রথম আলো সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে প্রথমে নিহত হন তিনজন। আহত হন আরও শতাধিক। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ–যুবলীগের সংঘর্ষ চলার মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত আরও চারজনের মরদেহ-এর উদ্ধার হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন সাংবাদিক রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। নিহত ওই সাংবাদিকের নাম হাসান মেহেদী। তিনি ঢাকা টাইমসে কর্মরত বলে জানা গিয়েছে। এদিন সন্ধ্যার পর তাঁকে আহত অবস্থায় যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকা থেকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে আনা হয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁর শরীরে অসংখ্য ছররা গুলির ক্ষত রয়েছে। নিহত অপর তিনজনের মধ্যে ওয়াসিমকে (৩০) আনা হয় যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ত এলাকা থেকে। তাঁর মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া আনুমানিক ২০ থেকে ২২ বছর বয়সী নিহত নাজমুলকে আনা হয়েছে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে। তাঁর শরীরে একাধিক কোপের চিহ্ন রয়েছে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, নাজমুল ব্যবসায়ী। ঘটনার ঘণ্টা দুয়েক আগে তিনি বাড়ি থেকে বের হন। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গিয়ে তাঁকে খুন হতে হয়েছে।
এছাড়া নিহত মোহাম্মদকে আনা হয়েছে আজিমপুর এলাকা। তাঁর আনুমানিক বয়স ২০ বছর। মোহাম্মদের শরীরে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন রয়েছে। বৃহস্পতিবার উত্তরা এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে দুই আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে। বাড্ডা এলাকায় এক পথচারীকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। মৃত ওই পথচারী পেশায় মিনিবাসের একজন চালক বলে জানা গিয়েছে। শুধু তাই নয়, পথচারীর পাশাপাশি, আন্দোলনকারীদের পাল্টা হামলায় বেশ কয়েকজন পুলিশকর্মীও জখম হয়েছেন। চট্টগ্রামের নগর এলাকাতেও সংঘর্ষে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। বিকেলে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দার হাট এলাকায় এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বিকেলে এই দুই জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) আলাউদ্দিন তালুকদার সংবাদ মাধ্যমকে এই তথ্য দিয়েছেন বলে প্রথম আলো দাবি করেছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় সকাল থেকে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় এক রিকশাচালককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তাঁকে পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। তাঁর আনুমানিক বয়স ৩০ বছর। নিহত ওই রিকশাচালকের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
এদিন এখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষের মধ্যে তাঁরা গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের একজন পটিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। তাঁর নাম মোহাম্মদ ইমাদ (১৮)। আরেকজনের এখনও পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাঁর বয়স আনুমানিক ২২ বছর। এদিকে নরসিংদীতে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাহমিদ তামিম (১৫) ও মো. ইমন মিয়া (২২) নামে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রথম আলো জানিয়েছে, সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় নরসিংদী সদর হাসপাতালে ইমন এবং জেলা হাসপাতালে তাহমিদের মৃত্যু হয়েছে। এই আটজনকে নিয়ে আজ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে মোট ১৯ জন নিহত হওয়ার তথ্য সামনে এসেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩ জন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ–যুবলীগ নেতা–কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন। সব মিলিয়ে উত্তরায় ছয়জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে হাসপাতাল সূত্রে। এ ছাড়া ধানমণ্ডিতে সংঘর্ষে ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থী, রামপুরায় এক পথচারী, যাত্রাবাড়ীতে এক রিকশাচালক, সাভারে এক শিক্ষার্থী ও মাদারীপুরে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।