বাংলার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বিপ্লবীকেন্দ্র মানিকতলার মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়ি

কবিতা রায়

স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূতরূপে সমগ্র ভারতবর্ষে জাগরণ ও বিস্ফোরণের ঢেউ তুলেছিল কলকাতার উপকণ্ঠে মানিকতলার মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়ির ঘটনাবলি৷ ঠিকানা ছিল ৩২, মুরারিপুকুর রোড৷ এই ইতিহাস-প্রসিদ্ধ স্থানটি ছিল বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবের মূল কেন্দ্র যেখান থেকে বেপরোয়া বিপ্লবী মনোভাব চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ সাত বিঘা জমির উপর এই বাড়িটি ছিল শ্রী অরবিন্দের পারিবারিক সম্পত্তি; কেন্দ্রস্থলে ছিল তিনটি ঘর, বাইরে বারান্দা৷ প্রচুর নারকেল, সুপারি, আম গাছ চারপাশে; মাঝখানে এঁদো পুকুর, শেওলা, কচুরিপানায় পরিপূর্ণ৷ নলিনীকান্ত গুপ্ত তাঁর ‘স্মৃতির পাতা’য় বাগানবাড়ির বর্ণনা দিয়েছেন ঃ ‘…বাগান না ত, জীবন্ত জঙ্গল—গাছপালা লতাগুল্ম একটা জট পাকিয়েছে, তার মধ্যে বিচরণ করে যতরকমের পোকামাকড় সরীসৃপ৷ তারপর যে বাড়িখানা ছিল বসবাসের জন্য তাও পোড়োবাড়ি ছাড়া বড় কিছু নয়৷ অথচ জায়গাটি ছিল দারুণ শান্ত নীরব— একটা কারণ এই যে স্থানটি প্রায় লোকালয় বহির্ভূত৷’ ‘দি টাইমস’ পত্রিকায় (১ মার্চ, ১৯০৯) এই বাগানবাড়ি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে ‘It was so secluded that one wonders that it was ever discovered.’
বাংলার বিপ্লবীদের এই প্রধান কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ১৯০৭ সালের প্রথম দিকে৷ সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ আছে যে, এই কেন্দ্রটির প্রধান পরামর্শদাতা এবং সম্ভবত প্রধান সংগঠক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, যদিও তিনি কখনও এখানে বসবাস করেননি৷ বারীন্দ্র ঘোষ ছিলেন সক্রিয় নেতা যাঁর তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রটি বিপ্লবীদের কর্মভূমি হয়ে ওঠে; স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্যে এখানে যুবকদের বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মকাণ্ড শুরু করেন বারীন্দ্র৷ প্রথমে প্রধানত যুগান্তর দলের ১৪-১৫ জন ত্যাগী যুবক এখানে জড়ো হন৷

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, প্রথমদিকে কেন্দ্রটির উদ্দেশ্য ছিল একটি সৈন্যদল গঠন এবং ইংরেজ সৈন্যদলে বিদ্রোহের বীজ বপন করা; কিন্ত্ত পরে সেটি সামরিক সংগঠন থেকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়৷ এই বিপ্লবী গোষ্ঠী, বিপ্লবী তত্ত্বকে বিপ্লবী তৎপরতায় রূপ দিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী ঘটনাতেও যুক্ত ছিলেন৷


১৯০৭ সালের শেষের দিকে এই বাগানে প্রায় ২০ জন যুবক বসবাস করতেন যার মধ্যে সাধারণত ১৫ জন উপস্থিত থাকতেন৷ অন্যান্যরা দলের অথবা ব্যক্তিগত কাজে স্থানান্তরে যেতেন৷ পরে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৫৷ কয়েকজন মেধাবী ছাত্রও এই বাগানে যোগ দেন যাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের উল্লাসকর দত্ত৷ রংপুরের দুই ছাত্র প্রফুল্ল চক্রবর্তী ও নলিনী গুপ্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে তিন বছর পড়াশোনা করার পর ১৯০৭ সালে বাগানে যোগ দেন৷ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের ছলে বিপ্লবী যুবকেরা এই বাগানে যুক্ত হতেন৷ বাগানটি আশ্রম নামে পরিচিত হলেও এখানে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করা হত৷ বাগান থেকে পাওয়া বারীন্দ্রের একটি নোটবইয়ে বসবাসকারী সদস্যদের দৈনিক রুটিনের উল্লেখ থেকে তাদের জীবনধারা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়৷ সকল নতুন সদস্যকে সাধারণ এবং নৈতিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হত৷ তাদের ক্ষেত্রে সংস্কৃত, হিন্দি এবং ইংরেজি (ঐচ্ছিক) জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল৷ মিশনারিদের জন্য প্রয়োজন ছিল বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ এবং সংস্কৃত, হিন্দি এবং ইংরেজি (বাধ্যতামূলক) জ্ঞান; এছাড়া ভারতের ইতিহাস, ভূগোল এবং অন্যান্য দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান আবশ্যিক ছিল৷ কেবলমাত্র বিশেষ শ্রেণির ছাত্র এবং সাধারণ সহযোগীদের লাইব্রেরি/কারিগরি বিদ্যার প্রশিক্ষণ নিতে হত৷ বাগানে কয়েকশো বইয়ের সংগ্রহ ছিল৷

সাধারণত বাগানে ধর্মচর্চা এবং শরীর-ব্যায়াম চর্চা করা হত৷ প্রথমে ধ্যান ও যোগাভ্যাস বাধ্যতামূলক থাকলেও পরে এই নিয়ম শিথিল করা হয়৷ উপেন্দ্রনাথ গীতা-উপনিষদ পাঠ দিতেন এবং বারীন্দ্র ও অবিনাশচন্দ্র যুদ্ধবিদ্যার আধুনিক টেকনিক বিষয়ে ক্লাস নিতেন৷ প্রতিদিন সকালে গৈরিক বসন পরিহিত শিক্ষক এবং ছাত্রদের সংস্কৃত শ্লোকের পাঠ থেকে মনে হত যে এটি একটি আশ্রম৷ সরকারি নথিতে এই আশ্রমকে ‘semi-religios in character’ বলে অভিহিত করা হয়েছে যা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এর প্রতিরূপ ছিল৷

বিভিন্ন উপায়ে বোমা, বন্দুক, রিভলবার, ডিনামাইট, বিস্ফোরক ইত্যাদিও সংগ্রহে তৎপর হয়ে ওঠে এই গোষ্ঠী৷ বন্দুক, পিস্তল চালনাও প্র্যাকটিস করা হত৷ বাগানের মধ্যে পুকুরের ধারে একটি শতছিন্ন গুঁড়ি থেকে তা প্রমাণিত হয়৷

১৯০৭ সালে দ্বিতীয়ার্থে উল্লাসকর দত্ত বাগানে যোগদান করলে বোমা তৈরি হয়ে দাঁড়ায় এই কেন্দ্রের প্রধান উদ্দেশ্য৷ প্যারিস থেকে বোমা বানানোর কৌশল শিখে এসে হেমচন্দ্র কানুনগো ১৯০৭-এর নভেম্বর মাসে বারীন্দ্রের দলে বোমা তৈরির বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগদান করেন৷ সিডিশন কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে হেমচন্দ্র ও উল্লাসকরের যৌথ পরিচালনায় বোমা এবং বিস্ফোরক তৈরি হতে থাকে৷ বাগানে একটি চালাঘর নির্মাণ করে সেখানে বিভিন্ন আকারের বোমা তৈরির ছাঁচ ও বোমার খোল তৈরি হতে থাকে৷ গীতাপাঠ ও আলোচনায় যোগ দিতে আসা সাধারণ মানুষেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে এই বাগানবাড়ির নিভৃত কক্ষে মারণাস্ত্র তৈরি হয়৷ ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ‘এককথায় গীতা-পাঠ হইতে বোমা তৈরির মন্ত্রণা সবই এই বাগানে চলিত৷’

বিপ্লবীদের বোমার নিশনায় ছিলেন চারজন— পূর্ববঙ্গের ছোটলাট ব্যামফিল্ড ফুলার, বাংলার ছোটলাট অ্যান্ড্রূ ফ্রেজার, চন্দননগরের ফরাসি মেয়র তার্দিভেল এবং কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ড— যদিও তাঁদের প্রাণনাশের চেষ্টা ব্যর্থ হয়৷

এই বাগানের গৃহস্থালীর ব্যবস্থা ছিল অতি সরল, সহজ ও সাধারণ৷ এই প্রসঙ্গে নলিনীকান্ত গুপ্ত তাঁর ‘স্মৃতির পাতা’য় লিখেছেন ঃ ‘…নিজেরাই রান্না করতাম, নিজেরাই ধোয়া পাখলা করতাম৷’ উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য় এই মৃতু্যপাগল বিপ্লবীদের খাওয়াদাওয়া সম্পর্কে লিখেছেন ঃ ‘…আর আমাদের খাইতেও বেশি খরচ নয়— দুই-চারিটা আলু ফেলিয়া দিয়া তরকারির অভাব পুরাইয়া লওয়া হইত৷ সময়াভাব হইলে খিচুড়ির ব্যবস্থা…৷’
‘আমাদের বাজে খরচের মধ্যে ছিল চা, ওটা না থাকিলে সংসার নিতান্তই ফিকে ফিকে, অনিত্য মনে হইত৷ বিশেষত বারীন চা বানাইতে সিদ্ধহস্ত৷ তাহার হাতের গোলাপী চা, ভাঙ্গা নারিকেলের মালায় ঢালিয়া চক্ষু বুজিয়া তারিফ করিতে করিতে খাইবার সময় মনে হইত যে, ভারত উদ্ধারের যে কয়টা দিন বাকি আছে, সে কয়টা দিন যেন চা খাইয়াই কাটাইয়া দিতে পারা যায়৷’
থালা বাটি বলতে ছিল প্রত্যেকের একটি একটি নারিকেল মালা আর একটি মাটির পাত্র, খাওয়ার পর যা ধুয়ে মুছে রেখে দিতে হত৷ নিজের হাতে সকলেই কাপড় কেচে নিত৷

নেতা হিসাবে এই বিপ্লবী কেন্দ্রটির পরিচালনার দায়িত্ব ছিল বারীন্দ্রের উপর৷ স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেন যে, বসবাসকারীদের ভরণপোষণের জন্য তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন৷ তাদের শিক্ষাদান করে মিশনারি হিসাবে সন্ত্রাসবাদী কাজে পাঠানো ছিল তার উদ্দেশ্য৷ বাগান থেকে পাওয়া কাগজপত্রে মধ্যে এক টুকরো কাগজে কয়েকজন অর্থপ্রদানকারীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়— AB-৩০, BG-১০০, Cch-২০, SB-৫, Sashi-১, Nandi-৫০৷ এটা নিঃসন্দেহে BG-র অর্থ বারীন ঘোষ, যদিও উল্লিখিত অর্থ তার ব্যক্তিগত প্রদত্ত অংশ ছিল না; এটি একটি সময়ের সমগ্র আদায়ীকৃত অর্থ৷
৩০ এপ্রিল ১৯০৮-এ ভারত-কাঁপানো মজঃফরপুরের বোমা-বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে৷ নির্মমতার প্রতীক কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডি এইচ কিংসফোর্ড (যিনি বিহারের মজঃফরপুরের সেশনস জজের পদে বদলি হন) হত্যার উদ্দেশ্যে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী মজঃফরপুরে পেঁৗছন৷ কিন্ত্ত কিংসফোর্ড ভ্রমে কেনেডিদের নিধনের ঘটনা, ক্ষুদিরামের গ্রেফতার ও প্রফুল্লর আত্মহত্যার পর বিপ্লবীদের প্রধান ঘাঁটি মুরারিপুকুর ও আরও পাঁচটি কেন্দ্র পুলিশ ঘেরাও করে৷ ২ মে প্রতু্যষে চারটের সময় পুলিশ মানিকতলার বাগানবাড়িতে তল্লাশি চালায়৷ মজঃফরপুরের বোমা বিস্ফোরণের আগেই মুরারিপুকুর বাগানের কেন্দ্রটি সম্বন্ধে পুলিশের সন্দেহ জন্মেছিল৷ ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তারা বাগান চৌকি দিতে শুরু করে৷ নলিনীকান্ত গুপ্তের একটি উক্তি থেকে তার কিছুটা প্রমাণ মেলে ঃ

‘‘কিছুদিন থেকে আমরা প্রায় সকলেই একটা জিনিস লক্ষ্য করতে শুরু করলাম৷ আমরা বাইরে যখন যাই… কেউ যেন আমাদের পিছনে চলেছে একটু দূর থেকে, তবে বেশ স্পষ্টই বোঝা যায় অনুসরণ করছে৷ থামলে সেও থেমে যায়; দেরি করলে সেও একটা ছুতো নিয়ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখে৷… সুতরাং এখন থেকে আমাদের বিশেষভাবে সাবধান হতে হবে৷’’
খানাতল্লাশির অভিশপ্ত ভোররাতের ঘটনা উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের \স্মৃতিচারণায় ঃ
‘‘রাত্রি যখন প্রায় চারটা, তখনও গ্রীষ্মের জ্বালায়, কতকটা মশার কামড়ে শুইয়া শুইয়া ছটফট করিতেছি৷ এমন সময় শুনিলাম যে কতকগুলো লোক মস্মস্ করিয়া সিঁড়িতে উঠিতেছে; আর তাহার একটু পরেই দরজায় ঘা পড়িল— গুম্ গুম্ গুম্৷ বারীন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিতেই একটা অপরিচিত ইওরোপীয় কণ্ঠে প্রশ্ন হইল—
‘Your name?’
‘Barindra Kumar Ghosh’
হুকুম হইল— ‘বাঁধো ইসকো’
বুঝিলাম, ভারত উদ্ধারের প্রথম পর্ব এখানেই সমাপ্ত৷
………..

ক্রমে কাক ডাকিল; কোকিলও এক-আধটা বোধহয় ডাকিয়াছিল৷ পূর্বদিক একটু পরিষ্কার হইলে দেখিলাম বাগান লাল পাগড়িতে ভরিয়া গিয়াছে৷ কতকগুলো গোরা সার্জেন্ট হাতে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড চাবুক লইয়া ঘুরিতেছে৷ … পুকুরঘাটের একটা প্রকাণ্ড আমগাছের তলায় আমাদের হাতবাঁধা ছেলেগুলা জোড়া জোড়া বসিয়া আছে;

…ভাবিলাম, এ যাত্রা বুঝি কর্তারা আমাকে ভুলিয়া যায়! কিন্ত্ত সে বৃথা আশা বড় অধিক্ষণ পোষণ করিতে হইল না৷ … আার হাত বাঁধিবার হুকুম হইল৷’’
মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে তল্লাশির পর গ্রেফতার হন বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, বিভূতিভূষণ সরকার, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দুভূষণ রায়, উল্লাসকর দত্ত, নলিনীকান্ত গুপ্ত, পরেশ মৌলিক, বিজয় নাগ, শচীন সেন, শিশির ঘোষ, নরেন বক্সী, কুঞ্জলাল সাহা, পূর্ণ সেন, হেমেন্দ্র ঘোষ— এই ১৪ জন৷

পরবর্তীকালে তদন্তের ফলে আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়৷
তল্লাশির খবর আগেই পাওয়া গিয়েছিল৷ থানার একজন পুলিশ কর্মচারীর সতর্কবাণী সত্ত্বেও তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনা হয়নি৷ শ্রী অরবিন্দ এ খবর পাওয়া মাত্র বারীন্দ্রকুমারকে ডেকে এনে আদেশ দেন দলের সকলকে এ সংবাদ জানাতে আর সব আড্ডা থেকে তৎক্ষণাৎ সরিয়ে দিতে৷ কিন্ত্ত মানিকতলার কয়েকটি বন্দুক, রিভলবার, গুলি, সেল ইত্যাদি সামান্য মাটি চাপা দিয়ে লুকোনা ছাড়া আদেশমতো আর কিছুই করা হয়নি৷

বাগানবাড়ি তল্লাশি করে পুলিশ বাক্সবন্দি করা বা মাটিতে পোঁতা বন্দুক, রিভলবার, রাইফেল (সব মিলিয়ে ছ-সাতটা), বোমা, ডিনামাইট, ইলেকট্রিক ব্যাটারি, কার্তুজ, ফিউজ এবং বিপ্লবীদের চিঠিপত্র হস্তগত করে৷ দশটি গৈরিক বসনও পাওয়া যায়৷ এছাড়া বোমা তৈরির মালমশলা যেমন পিকরিক অ্যাসিড, ক্লোরেট অফ পটাশ, তামা, টিন, পিতল এবং অন্যান্য ধাতুনির্মিত নানা ধরনের বোমার খোল, বোমার খোল তৈরির ছাঁচ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি পাওয়া যায়৷ এছাড়া পাওয়া যায় সাইক্লোস্টাইল করা একটি ম্যানুয়াল যা Bomb Manual বা Manual of Explosives নামে সরকারি নথিপত্রে উল্লিখিত আছে৷ বিস্ফোরক পদার্থ নির্মাণের সহজ প্রণালী এখানে বুঝিয়ে দেওয়া আছে৷ এখানে উল্লেখ করা যায় যে Bomb Manual-এর অবিকল একটি সাইক্লোস্টাইল কপি ১৯০৯ সালের ২ মার্চ নাসিকে গণেশ দামোদর সাভারকারের গৃহতল্লাশির সময় পাওয়া যায়৷ বাগানে তল্লাশিতে একটি সাইক্লোস্টাইল কাগজে ৩২টি বিস্ফোরক পদার্থের নাম পাওয়া যায়৷
আর যে সকল বস্ত্ত পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে তার মধ্যে ছিল তিন কপি ‘ভাগবদগীতা’, ‘বর্তমান রণনীতি’ গ্রন্থের (অবিনাশ ভট্টাচার্য কর্তৃক আগে বছর প্রকাশিত) ৩৯৪টি কপি, বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতি গঠনপ্রণালীর নিয়মাবলি, সাংকেতিক ভাষায় লেখা একটি নোট বই উদ্ধার করা হয় যেখানে লেখা ছিল ঃ ‘11 January and onwards… U.D to be kept here. H.D. to be looked up. They spend a week together MSS from H.D.’ নির্দেশটির মানে করা হয়েছে এইভাবে ঃ হেমচন্দ্র দাস (H.D.) ফিরলে তিনি এবং উল্লাসকর দত্ত (U.D.) এক সপ্তাহ একসঙ্গে হেমচন্দ্রের আনা পাণ্ডুলিপি নিয়ে আলোচনা করবেন৷

J. C. Kar-ও এই বাগানকে ‘a regular school for practical instruction in revolutionary methods and in the manufacture of explosives…’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন৷

মানিকতলা বাগানবাড়ির কার্যকলাপ উদঘাটনের পর ইংরেজ সরকার বুঝতে পারে যে, ‘‘নিরীহ ‘গো-বেচারা’ অগ্নিগর্ভ বাঙালি-মন উত্ত্যক্ত হলে, আত্মসম্মান রক্ষায় বদ্ধপরিকর এবং দেশপ্রেম উদ্বেলিত হয়ে উঠলে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে সে আপনাকে উৎসর্গ করে দিতে পারে৷’’ এরপর শুরু হয় ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধোদ্যোগের ষড়যন্ত্র মামলা, যার পোশাকি নাম ‘Emperor vs Barindra Kumar Ghosh and others’, যা মানিকতলা বোমার মামলা বা আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা নামে অধিক পরিচিত৷ বিপ্লবী যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের মতে, মানিকতলা বোমার মামলাই ‘প্রথম রোমাঞ্চকর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র মামলা’৷ এই মামলার প্রত্যক্ষ পরিণতিতে মানিকতলার মুরারিপুকুরে গুপ্ত  আখড়া বন্ধ হয়ে যায়৷ অনেক বিপ্লবী ধরা পড়ার ফলে বিপ্লবী আন্দোলনে ধাক্কা লাগলেও তা বন্ধ হল না৷ ইংরেজ সরকার উপলব্ধি করে যে কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদন নীতির চাইতে অনেক ভয়ঙ্কর এই সশস্ত্র বিপ্লব৷ সামান্য কয়েকজন ‘বোমার আসামী’ যে পথ দেখিয়ে গেছে ‘সেই রক্তরাঙ্গা রেখা ধরে বছরের পর বছর বাংলা-মায়ের বীর যোদ্ধাদল অকুতোভয়ে জেল, কালাপানি আর ফাঁসিকে আলিঙ্গন জানিয়েছে৷’ এই বিপ্লবী কার্যকলাপ দমন করার জন্য সরকার নানান দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে৷ যদিও ভারতবাসীর স্বাধীনতা-স্পৃহাকে দমন করতে পারে এমন ক্ষমতা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের ছিল না৷