রবীন্দ্রনাথ যেন রাম, রামায়ণ ও রামরাজত্ব নিয়ে আমাদের মনের কথাই বলেছেন!

স্বপনকুমার মণ্ডল

কারও মূল্যায়ন করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা উঠে আসে৷ তাঁর মতাদর্শে বাঙালিরাই শুধু নয়, অবাঙালিরাও শ্রদ্ধাশীল৷ সবার কথা শোনার পর রবীন্দ্রনাথ সে বিষয়ে কী বলছেন, বা রবীন্দ্রনাথের মতামত দিয়ে নিজের অভিমত গড়ে তোলার সচেতন প্রয়াস পক্ষে-বিপক্ষের সবার মধ্যেই লক্ষ করা যায়৷ সেখানে তাঁর একাধিপত্য বিস্ময়কর৷ সর্বত্র রবীন্দ্রনাথের অবিসংবাদিত ভূমিকা প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নেওয়ার মধ্যেই তাঁর জীবনদর্শন ও আদর্শ সাহিত্যের পরিসর ছেড়ে সমাজের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে ক্রমশ বিস্তার লাভ করেই চলেছে৷ সেদিক থেকে তাঁর মনীষী ব্যক্তিত্ব তাঁর মৃতু্যর পরে ক্রমশ অপ্রতিদ্বন্দ্বী হতে শুরু করে৷ একালে যখন ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে চর্চার অবকাশ আপনাতেই মুখর হয়ে উঠেছে, স্বাভাবিকভাবেই তাতে স্বকীয় মত প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা উঠে আসে৷ শুধু তাই নয়, তাঁর মূল্যায়নই সেখানে প্রাধান্য লাভ করে৷ বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে রাম ও রামায়ণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ প্রথম থেকেই লক্ষ করা যায়৷ তাতে অনেকের তাঁকে রামভক্ত মনে হতে পারে৷ অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ব্যক্ত করলেও শ্রীরামচন্দ্রের অন্ধ ভক্ত ছিলেন না৷ সর্বগুণধর শ্রীরামচন্দ্রের মূল্যায়নেও তাঁর শ্রদ্ধাবোধে অন্ধত্ব নেই, বরং যুক্তির আলোর পরশেই তাঁর অসাধারণত্ববোধ প্রতীয়মান৷ শুধু তাই নয়, রামরাজত্ব নিয়েও তাঁর লক্ষ্যভেদী সমালোচনা বেরিয়ে এসেছে৷ সেখানে তাঁর প্রশংসা যেমন আমাদের মুগ্ধ করে, সমালোচনাও সম্বিত ফিরিয়ে দেয়৷ মহাকাব্যের রূপকের মধ্যেও সমাজ বাস্তবতার পরিচয়কে একালের আলোতেও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ৷ নিছক ভক্তির পরাকাষ্ঠায়, রাম ও রামায়ণ তাঁর কাছে মানবিক আবেদনে নতুন যুগের বার্তাবাহী৷ সেদিকে একবার দৃষ্টি দিলেই বিষয়টি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে৷

রবীন্দ্রনাথের মন ও মননে রামায়ণ-মহাভারতের প্রভাব ক্রমশ নিবিড় হয়ে ওঠে৷ তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে ক্রমশ সেই প্রভাবের ছায়া নানা রূপে কায়া বিস্তার করে৷ সেক্ষেত্রে ভারতের জীবনচেতনা ও দর্শনে শ্রীরামচন্দ্রের মানবিক গুণের সর্বোত্তম প্রকাশ থেকে রামায়ণের অতুলনীয় প্রভাবের কথা রবীন্দ্রনাথ বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন৷ তাঁর সৃষ্টিতেও সেই রামচন্দ্রের পরিচয় ক্রমশ প্রসারিত হয়৷ বাল্মীকি, রাম, রামায়ণ ও রামরাজত্বের বিস্তার তাঁর সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ক্রমশ ফুল-ফলে, শাখা প্রশাখায় বিকশিত হয়েছে৷ এভাবেই ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ (১৮৮১) গীতিনাট্যে, ‘পঞ্চভূত’ (১৮৯৭), ‘আত্মশক্তি’ (১৯০৫), ‘প্রাচীন সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘পরিচয়’ (১৯১৬), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬) বিচিত্র প্রকৃতির প্রবন্ধ গ্রন্থে, ‘জাভাযাত্রীর পত্র’ (১৯২৯) ভ্রমণ সাহিত্যে বা ‘কাহিনী’ (১৯০০) কাব্যে নানাভাবে রাম-রামায়ণের কথা উঠে এসেছে৷ সেখানে যেমন রবীন্দ্রনাথের সুগভীর শ্রদ্ধাবোধ নিবিড় হয়ে উঠেছে, তেমনই তাঁর বিরূপ মনোভাবও সংগুপ্ত থাকেনি৷ রাম চরিত্রের সূর্যদীপ্ত আলোর মধ্যেও গ্রহণের ছায়াও অত্যন্ত প্রকট৷ বিশেষ করে শূদ্র হয়ে তপস্যা করার অপরাধে শম্বুককে বধদণ্ড প্রদান ও অগ্নিপরীক্ষার পরেও সীতার বনবাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভাবিয়ে তুলেছিল৷ এজন্য বিষয় দুটি তাঁর লেখায় নানাভাবে উঠে এসেছে৷ শুধু তাই নয়, আকারে প্রকারে তিনি যে রামচন্দ্রের এই দুটি বিষয় যে মেনে নিতে পারেননি, তা তাঁর বক্তব্য থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না৷ দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’ বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে ‘প্রাচীন সাহিত্য’র সূচনা প্রবন্ধ ‘রামায়ণ’-এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ রাম ও রামায়ণের প্রতি তাঁর সুগভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন৷ সর্বগুণান্বিত পুরুষোত্তম রামের অতুলনীয় মহামানবের পরিচয়কে তিনি নিবিড় করে তুলেছেন সেখানে৷ শুধু তাই নয়, দীনেশচন্দ্র সেন ভক্তের মতো রামায়ণের কথাকে যেভাবে আবেগমিশ্রিত ব্যাখ্যায় তুলে ধরেছেন,তার প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থনেও রবীন্দ্রনাথের রামায়ণের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি লক্ষণীয়৷ সেখানে যথার্থ সমালোচনাকে পূজা ও সমালোচককে পূজারি বলেছেন তিনি৷ সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধেই রামায়ণের প্রতি তাঁর পূজাকে সবচেয়ে বেশি তন্নিষ্ঠ করে তুলেছেন৷ আর্য-অনার্যের ঐক্য গড়ে তুলতে শ্রীরামচন্দ্রের সমাজবিপ্লবীর ভূমিকাই শুধু নয়, রামায়ণের মধ্যে ভারত থেকে ভারতের মধ্যে রামায়ণের বিস্তৃতিবোধ তাঁর মূল্যায়নে অধিক গুরুত্ব লাভ করে৷ স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে ভারতের ‘পরিপূর্ণ মানবের আদর্শচরিত’ হিসেবে শ্রীরামচন্দ্রের চারিত্রিক মাহাত্ম্য সুদীর্ঘকাল ধরে যে প্রবহমান, সে কথাও রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন৷ অথচ সেই আদর্শ চরিত্রের প্রতি তাঁর ভক্তি অভাব না থাকলেও তিনি যে অন্ধভক্তির শিকার হয়ে ওঠেননি, তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে৷ সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের প্রদীপের নীচের অন্ধকারকে এড়িয়ে যাননি, বা, উপেক্ষা করে মেনে নেননি, বরং সচেতন ভাবে তার স্থিতিকে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন৷


১৮৯১-এ ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দেনাপাওনা’ গল্পে সমাজের পণপ্রথার শিকারে নারী জীবনের করুণ পরিণতিকে রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ মুন্সিয়ানায় তুলে ধরে শেষে ‘এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়’-এর নিদান দিয়ে তার ইতি টেনেছেন৷ তখনও রবীন্দ্রনাথ নারীদের প্রতি সমাজের রক্ষণশীলতার দৃষ্টি কাটিয়ে উঠতে পারেননি৷ সেক্ষেত্রে নারী জীবনের দুর্বিষহ যন্ত্রণায় বৈষম্যপীড়িত সমাজের ভূমিকাকে প্রকট করাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে৷ অন্যদিকে নারীদের প্রতি পুরুষশাসিত সমাজের দীনহীন ব্রাত্য দৃষ্টিভঙ্গি যে নারীনির্যাতনের মূলাধার,তা সময়ান্তরে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ ‘শাস্তি’র মতো গল্পেই তা প্রতীয়মান৷ অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষার আলো প্রসারিত হলেও নারীর প্রতি পুরুষশাসিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐতিহ্য বজায় রাখায় আরও বেশি উগ্র রূপ লাভ করে৷ সেখানে নারীনির্যাতনের বহুমুখী বিস্তার লক্ষণীয় হয়ে ওঠে৷ সেই নারীদের দুর্বিষহ জীবনের কথা রবীন্দ্রনাথ ১৯১৪-তে প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ পত্র’-এ একের পর এক গল্পে সবুজ করে তোলেন৷ ঐ পত্রিকায় অধিকাংশ গল্পেই নারীদের ট্র্যাজিক পরিণতিকে তুলে ধরেছেন তিনি৷ সেখানে ‘দেনাপাওনা’র উত্তরকাণ্ডই হল ‘হৈমন্তী’৷ পণের টাকা না পাওয়ায় নিরুপমাকে জীবনপণ করতে হয়েছিল৷ সেখানে নানাভাবে বিশ হাজার টাকা পণ দিয়েও হৈমন্তীর বাবা হৈমন্তীকে বাঁচাতে পারেননি৷ হৈমন্তীর শিক্ষাই সেখানে অশিক্ষার শিকার হয়ে ওঠে৷ গল্পটির শেষে গল্পকথক তথা হৈমন্তীর স্বামীর মুখেই রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের পুরুষশাসিত সমাজবাস্তবতাকে নিবিড় করে তুলেছেন৷ রামরাজত্বের মধ্যেই যে সীতার নির্বাসন লুকিয়ে ছিল, তাও তাতে বেরিয়ে আসে৷ বাবার নিষেধ অমান্য করে স্বামী হয়েও হৈমকে চিকিৎসা করে ভালো করতে না পারার কথা প্রসঙ্গে গল্পকথকের মুখে রবীন্দ্রনাথ রামরাজত্বের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে তার তীব্র সমালোচনার অবকাশ রচনা করেছেন : ‘যদি লোকধর্মের কাছে সত্যধর্মকে না ঠেলিব যদি ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহুযুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে আছে৷ জানো তোমরা? যেদিন অযোধ্যার লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে যে আমিও ছিলাম৷ আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও তাহাদের মধ্যে একজন৷ আর আমিই তো সেদিন লোকরঞ্জনের জন্য স্ত্রীপরিত্যাগের গুণবর্ণনা মাসিকপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়াছি৷’

‘হৈমন্তী’ গল্পটি ‘সবুজ পত্র’ প্রকাশিত হয় ১৩২১-এর জ্যৈষ্ঠে অর্থাৎ ১৯১৪-তে৷ তার অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথের মনে লোকরঞ্জনের স্বার্থে শ্রীরামচন্দ্রের মতো মহিমান্বিত চরিত্রের প্রতি মেনে নেওয়ায় দ্বিধাবোধ জেগে উঠেছিল৷ এজন্য তিনি বারবারই সে বিষয়টির অবতারণা করে তাঁর বিরূপ মনোভাবকে আলোচনার পরিসরে নিয়ে এসেছেন৷ ‘পঞ্চভূত’-এর মধ্যেও তার পরিচয় প্রকট৷ ‘অপূর্ব রামায়ণ’-এ ক্ষিতি সেই সীতার বনবাসের কথা তুলে ধরে৷ সেখানে অগ্নিপরীক্ষাতে সীতার আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠাও ধর্মশাস্ত্রের দলকে তুষ্ট করতে পারেনি৷ আর তাই ‘প্রেম-নামক সীতাকে’ ‘শাস্ত্রের কানাকানিতে অবশেষে এই রাজা’ নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন৷ রবীন্দ্রনাথ যে লোকরঞ্জনের জন্য শ্রীরামচন্দ্রের আত্মত্যাগকে স্বাভাবিক ভাবতে পারেননি, তা তাঁর সমালোচনা প্রকৃতির মধ্যেই প্রকট হয়ে ওঠে৷ সেখানে ত্রুটি বিচু্যতি সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে পরবর্তীতে সমাজরক্ষার বৃহত্তর ও মহত্ত্বর স্বার্থে প্রজানুরঞ্জক শ্রীরামচন্দ্রের অবতারণার কথাও রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন৷ তাঁর ‘আত্মশক্তি’র ‘স্বদেশী সমাজ’ ‘প্রবন্ধের পরিশিষ্ট’ প্রবন্ধে প্রসঙ্গক্রমে জানিয়েছেন: ‘রামায়ণের কবি রামচন্দ্রের পিতৃভক্তি, সত্যপালন, সৌভ্রাত্র, দাম্পত্যপ্রেম, ভক্তবাৎসল্য প্রভৃতি অনেক গুণগান করিয়া যুদ্ধকাণ্ড পর্যন্ত ছয় কাণ্ড মহাকাব্য শেষ করিলেন; কিন্ত্ত তবু নতুন করিয়া উত্তরকাণ্ড রচনা করিতে হইল৷ তাঁহার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক গুণই যথেষ্ট হইল না, সর্বসাধারণের প্রতি তাঁহার কর্তব্যনিষ্ঠা তাঁহার পূর্ববর্তী সমস্ত গুণের উপরে প্রতিষ্ঠিত হইয়া তাঁহার চরিত্রগানকে মুকুটিত করিয়া তুলিল৷’ সেক্ষেত্রে রামচন্দ্রের প্রজানুরঞ্জক মহিমা বিস্তার লাভ করলেও তা যে তাঁর মহৎ চরিত্রের পক্ষে আরোপিত সে বিষয়টিও রবীন্দ্রনাথ মনে করিয়ে দিয়েছেন৷ মেনে নেওয়া ও মনে না নেওয়ার পার্থক্য বিষয়ে তাঁর অভিমত অত্যন্ত স্পষ্ট৷ ‘পরিচয়’-এর ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’য় রবীন্দ্রনাথ সেকথা মনে করিয়ে দিয়েছেন৷ সেখানে রামচন্দ্রকে রাজার আদর্শ রোল মডেল করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর চারিত্রিক মাহাত্ম্যে নারীর প্রতি রক্ষণশীলতা ও শূদ্রের প্রতি বর্ণবিদ্বেষ তথা বর্ণবৈষম্যকে সমাজের স্বার্থে স্বাভাবিকতা লাভ করলেও তা রবীন্দ্রনাথের মননে আরোপিত মনে হয়েছে৷ তাঁর কথায়:‘ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র একদিন গুহক চণ্ডালকে আপন মিত্র বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন এই জনশ্রুতি আজ পর্যন্ত তাঁহার আশ্চর্য্য উদারতার পরিচয় বলিয়া চলিয়া আসিয়াছে৷ পরবর্তী যুগের সমাজ উত্তরকাণ্ডে তাঁহার এই চরিত্রের মাহাত্ম্য বিলুপ্ত করিতে চাহিয়াছে; শূদ্র তপস্বীকে তিনি বধদণ্ড দিয়াছিলেন এই অপবাদ রামচন্দ্রের উপরে আরোপ করিয়া পরবর্তী সমাজরক্ষকের দল রামচরিতের দৃষ্টান্তকে স্বপক্ষে আনিবার চেষ্টা করিয়াছে৷ যে সীতাকে রামচন্দ্র সুখে-দুঃখে রক্ষা করিয়াছেন ও প্রাণপণে শত্রুহস্ত হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, সমাজের কর্তব্যের অনুরোধে তাহাকেও তিনি বিনা অপরাধে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন৷ উত্তরকাণ্ডের এই কাহিনী সৃষ্টির দ্বারা স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায় আর্যজাতির বীরশ্রেষ্ঠ আদর্শচরিত্র রূপে পূজ্য রামচন্দ্রের জীবনীকে একদা সামাজিক আচার-রক্ষার অনুকূল করিয়া বর্ণনা করিবার বিশেষ চেষ্টা জন্মিয়াছিল৷’ স্বাভাবিকভাবেই তাতে যে নারীদের প্রতি রক্ষণশীলতাজনিত অন্যায়-অবিচার থেকে শূদ্রদের প্রতি অমানবিক বর্ণবৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে, রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকেও তা নিবিড় ভাবে উঠে এসেছে৷ সেদিক থেকে নিজেদের সুবিধামতো রবীন্দ্রনাথের শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধাভক্তিকে ব্যবহার করে তাঁর মূল্যায়নকে যথাযথভাবে তুলে না ধরায় তাঁকে অশ্রদ্ধার শিকার করার আয়োজন চলে৷ শুধু তাই নয়, তাতে রবীন্দ্রনাথকে রামভক্ত করে তোলার প্রবণতায় ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির অবকাশ আরও বিস্তার লাভ করে, ঘনীভূত হয়৷ যে রবীন্দ্রনাথ ‘সত্য রে লও সহজে’র পক্ষপাতী, সেই তাঁকেই নির্বিচারে ব্যবহারে অসত্যের সহজ শিকার করে তোলার প্রবণতা আসলে সত্যের অপলাপ৷ অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ রামচন্দ্রকে অনেক কাল থেকে অসংখ্য মানুষের গুণে গুণান্বিত মূর্তিতে দেখেছেন৷ তার ‘সাহিত্যের পথে’র ‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধে সেই সবগুণান্বিত রামচন্দ্রের কথা স্মরণ করে দিয়েছেন তিনি৷ সেখানে রামচন্দ্র ‘আমাদের মনের মানুষ’ থেকে ‘সত্যমানুষ’ বলে তুলে ধরেও রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মনের মানুষ বলতে যে বুঝতে হবে আদর্শ ভালো লোক তা নয়৷’ মনের কাছের মানুষের মনোহর মূর্তিতে রামচন্দ্রের পরিচয়কে তুলে ধরলেও তাঁকে কখনও আদর্শ প্রতিমায় মূল্যায়ন করেননি রবীন্দ্রনাথ৷ সেক্ষেত্রে রাম ও রামায়ণের মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথের ভক্তির প্রাবল্যে নয়, তাঁর যুক্তি ও সত্যনিষ্ঠ বাস্তবতায় দেখা সমীচীন৷ রামরাজত্বের সাধ ও স্বপ্নের মধ্যে সমাজের হিতে বিপরীত ছবিও উঁকি দেয়৷ সেখানে রক্ষণশীল সমাজের শাসনে ও শোষণে নারীনির্যাতন থেকে শূদ্রদের প্রতি বর্ণবিদ্বেষের ভয় জেগে আতঙ্কে পরিণত হয়৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর মূল্যায়নে বারবার সে কথাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরে আমাদের সচেতন করে তোলায় সক্রিয় হয়েছিলেন, ভাবা যায় !