কলকাতা, ৩১ মে: চলতি লোকসভা ভোটে দেশের শীর্ষ পাঁচ দাগি অপরাধী প্রার্থীদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিং। নির্বাচন কমিশনে পেশ করা বারাকপুরের প্রার্থী অর্জুন সিংয়ের হলফনামা থেকে এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সেই তথ্য থেকে লোকসভা ভোটে দেশের সমস্ত প্রার্থীদের নিরিখে বারাকপুরের বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অপরাধের মামলার তালিকা অনুযায়ী এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বারাকপুর কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে অর্জুন মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় যে হলফনামা পেশ করেন, তাতে দেখা যায়, এই কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদের বিরুদ্ধে এযাবৎ ৯৩টি অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
পাশাপাশি, দেশে অপরাধী প্রার্থীদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন গেরুয়া শিবিরের প্রার্থীরা। তৃতীয় স্থানে থাকা অর্জুন সহ সারাদেশে যে পাঁচজন অপরাধের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম দুইজনও বিজেপি-র প্রার্থী বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে। দেশে অপরাধে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা সেই দুই বিজেপি প্রার্থী যথাক্রমে কে সুরেন্দ্রন এবং ড. কে এস রাধাকৃষ্ণণ। এঁরা যথাক্রমে কেরলের ওয়েনাড় ও এর্নাকুলাম থেকে বিজেপি-র প্রার্থী হয়েছেন। এই দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগের তালিকা শুনলে রীতিমতো চোখ কপালে উঠবে। নির্বাচন কমিশনে এই দুই প্রার্থীদের পেশ করা হলফনামা থেকে জানা গিয়েছে, কে সুরেন্দ্রনের বিরুদ্ধে ২৪৩টি অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। যেখানে রাধাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে অপরাধের পরিমাণ কিছুটা কম। অর্থাৎ ২১১টি মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এই অপরাধী প্রার্থীদের তালিকায় চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছেন কংগ্রেসের দুইজন প্রার্থী। এই দুই কংগ্রেস প্রার্থীর একজন কেরল থেকে এবং অন্যজন তেলেঙ্গানা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কেরলের ইদুক্কি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আইনজীবী ডিন কুরিয়াকোজ এবং তেলেঙ্গানার তফসিলি উপজাতি সংরক্ষিত আসন আদিলাবাদ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আথরাম সুগুনা। ডিন কুরিয়াকোজ লোকসভা ভোটে সারাদেশে অপরাধী প্রার্থীদের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৮৮টি অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এবং পঞ্চম স্থানে থাকা আথরাম সুগুনার বিরুদ্ধে ৪৯টি অপরাধের মামলা রয়েছে।
সম্প্রতি দ্য এসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) এবং ইলেকশন কমিশন ওয়াচ (এনইডব্লিউ) সারাদেশে ৮৩৬০জন প্রার্থীর মধ্যে ৮৩৩৭ জন প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করে। এইসব প্রার্থীরা বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দল, অপরিচিত দল ও নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সেখানে কার কত অপরাধ আছে, এবং কী ধরণের অপরাধ আছে, সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা হয়। সেই বিশ্লেষণ থেকে দেশের মধ্যে সেরা পাঁচ দাগি অপরাধী প্রার্থীদের সনাক্ত করা হয়।
আরও চাঞ্চল্যকর বিষয় হল, এই শীর্ষ অপরাধী প্রার্থীদের মধ্যে পঞ্চম স্থানে থাকা আথরাম সুগুনা বাদে অধিকাংশই বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যের। অর্থাৎ পাঁচজন অপরাধী প্রার্থীদের মধ্যে প্রথম চারজনই বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিজেপি প্রার্থী কে সুরেন্দ্রন, ড. কে এস রাধাকৃষ্ণণ, চতুর্থ স্থানে থাকা কংগ্রেস প্রার্থী ডিন কুরিয়াকোজ বাঙালি অধ্যুষিত কেরলের প্রার্থী। এবং তৃতীয় স্থানে থাকা অর্জুন সিং বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা।
এডিআর এবং এনইডব্লিউ -এর পশ্চিমবঙ্গ চ্যাপ্টারের রাজ্য কো-অর্ডিনেটর ড. উজ্জয়িনী হালিম বলেন,”বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অপরাধের তালিকা খবরের কাগজে প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এবং সেটা মনোনয়ন তুলে নেওয়ার শেষ তারিখ থেকে ভোটের দুই দিন আগের মধ্যবর্তী সময়ে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে সেই তালিকা প্রকাশ করতে হবে। এই কন্টেন্টগুলি সংবাদপত্রে কমপক্ষে ১২ পয়েন্টের অক্ষরে ছাপাতে হবে। দেশের নির্বাচন কমিশনের জারি করা আদর্শ আচরণবিধি মেনে এই ঘোষণা করতে হবে।”
এডিআর এবং এনইডব্লিউ -এর বিশ্লেষণে আরও যে চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে, সেগুলি হল, ৮৩৩৭ জন লোকসভা প্রার্থীর মধ্যে ১১৯১ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, অপহরণ, এমনকি মহিলাঘটিত অপরাধের মতো মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে। যা শতাংশের বিচারে মোট প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোট প্রার্থীর নিরিখে এইরকম মারাত্মক অপরাধীদের সংখ্যা ছিল ১৩ শতাংশ।
দেশের ১৮তম এই লোকসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৫৪৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৮৮টি কেন্দ্র লাল সতর্কতা যুক্ত কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যা মোট আসনের মধ্যে ৫৩ শতাংশ। কারণ, নির্বাচন কমিশনে পেশ করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এইসব কেন্দ্রের প্রতিটিতে তিন অথবা তার চেয়ে বেশি প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
এডিআর এবং এনইডব্লিউ -এর পশ্চিমবঙ্গ চ্যাপ্টারের রাজ্য কো-অর্ডিনেটর ড. হালিমের উপলব্ধি,”এটা দেখা যাচ্ছে যে, সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেওয়া নির্দেশ সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলির কোনও হেলদোল নেই। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনেও দাগি অপরাধীদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে ২০ শতাংশের কোটা না মেনে তাদের পুরনো অভ্যাস মতো দেদার টিকিট দিয়ে যাচ্ছে।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশের শীর্ষ আদালত ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি একটি রায়ে বলে যে, যেসব প্রার্থীদের নামে অপরাধের অভিযোগ বা মামলা রয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলি ভোটে সেইসব প্রার্থীদের মধ্যে ২০ শতাংশকে প্রার্থী করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে কেন তাঁদের প্রার্থী করা হচ্ছে, টিকিট দেওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনে তাঁর উপযুক্ত কারণ দর্শাতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি সচরাচর শীর্ষ আদালতের সেই নির্দেশিকা মেনে চলছে না। উদাহরণস্বরূপ দেখা গেছে, গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে দাগি অপরাধীদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে যেসব হলফনামা পেশ করা হয়েছে, সেখানে কারণ হিসেবে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অবাস্তব যুক্তি দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রার্থীদের অপরাধের প্রেক্ষাপট এড়িয়ে গিয়ে মানুষের কাছে তাঁদের জনপ্রিয়তা ও সমাজকর্মী হিসাবে তুচ্ছ যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।