তর্কপ্রিয় রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র ও ইতিহাস চেতনা

শোভনলাল চক্রবর্তী

উনিশ শতকীয় রেনেসাঁর প্রধান পুরুষদের একটি সুলক্ষণ রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল৷ সেটি হলো – তর্কপ্রিয়তা, স্বীয়তত্ত্ব ও বক্তব্য প্রমাণে জোরালো পলেমিকসের আশ্রয় নেওয়া, এককথায় সমাজ সংস্কার জাতীয় বিষয়ে বাকবিতণ্ডা ও প্রয়োজনে তত্ত্বগত কাজিয়ায় নেমে পড়া খুব বেশি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না করেই৷ রামমোহন, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে বঙ্কিম, ভূদেব – সবার জন্যই এটা প্রযোজ্য৷ রবীন্দ্রনাথ যেহেতু দীর্ঘজীবনের অধিকারী ছিলেন তাই তাঁর গদ্য রচনা দেখলে মনে হবে তাঁর মতো তার্কিক সেই কালে খুব কমই ছিলেন৷ বলতে গেলে, স্বভাবসিদ্ধ বিতর্কবাদী ছিলেন তিনি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রসঙ্গে, এমনকি অপ্রতিরোধ্যভাবে নিরীহ নন্দন তাত্ত্বিক বিচারে প্রবৃত্ত হয়েও৷ প্রথম যুগের রবীন্দ্রনাথকে মনে হয় এ ক্ষেত্রে তীক্ষদৃষ্টি তার্কিক বঙ্কিমচন্দ্রের যোগ্য উত্তরাধিকারী৷ যে কারণে বঙ্কিমের পর বঙ্গদর্শনের সম্পাদনার দায়িত্ব বর্তায় রবীন্দ্রনাথের ওপরই৷ তবে বঙ্কিম সময়ে সময়ে সমালোচনার ক্ষেত্রে যতটা রূপ বা নির্দয় ছিলেন পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে তা অনেকটাই কমে আসে৷ এক পর্যায়ে তিনি কোনোভাবে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়লেও তা থেকে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করেই রাখতে চাইতেন৷ তারপরও এখানে যেটা প্রাসঙ্গিক, তর্কে প্রবৃত্ত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তি উদ্ভাবন করা বা কোনো সুদূর বা নিকট অতীতের বাস্তব বা কল্পিত উদাহরণ টেনে আনা রবীন্দ্রনাথের জন্য স্বভাব-বিরুদ্ধ কিছু ছিল না৷

ন্যাশনালিজম বক্তৃতামালায় বহুল আলোচিত তার ‘নেশন’ বনাম ‘নো-নেশন’ তুলনা, প্রতি তুলনা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে৷ পাশ্চাত্যের ইতিহাস রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এবং সে জন্য সেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘নেশন’-এর রাজনৈতিক নাগরিকবোধের সমসত্ত্বতা ও ঐক্যের ওপর গড়ে উঠেছে, অন্যদিকে প্রাচ্যের, পড়ুন ভারতের, ইতিহাস সমাজকেন্দ্রিক৷ সেখানে রাজশক্তির বিপর্যয়ে সমাজ বিপর্যস্ত হয় না; রাজা আসে-রাজা যায় তাতে পাখিদের কি এসে যায় একথা রবীন্দ্রনাথও বলতে পারতেন৷ ১৯০২ সালে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে তাঁর মূল বক্তব্য হল, ‘‘ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিই, তাহা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটি দুঃস্বপ্ন কাহিনী মাত্র৷ কোথা হইতে কাহারা আসিল, কাটাকাটি মারামারি পড়িয়া গেল, বাপে-ছেলে, ভাইয়ে ভাইয়ে সিংহাসন লাইয়া টানাটানি চলিতে লাগিল, এক দল যদিবা যায়, কোথা হইতে আর-এক দল উঠিয়া পড়ে- পাঠান-মোগল-পর্তুগিজ-ফরাসী-ইংরাজ সকলে মিলিয়া এই স্বপ্নকে উত্তরোত্তর জটিল করিয়া তুলিয়াছে৷ কিন্ত্ত এই রক্তবর্ণে রঞ্জিত পরিবর্তমান স্বপ্ন দৃশ্যপটের দ্বারা ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে যথার্থ ভারতবর্ষকে দেখা হয় না৷ ভারতবাসী কোথায়, এ সকল ইতিহাস তাহার কোনো উত্তর দেয় না৷ যেন ভারতবাসী নাই, কেবল যাহারা কাটাকাটি খুনাখুনি করিয়াছে তাহারাই আছে৷’’ এরপর তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বলতে পারতেন, ‘‘আইস, এক্ষণে আমরা সকলে মিলিয়া ইতিহাস লিখি!’’ তা না করে তিনি যেটা চাইলেন সেটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিকের সুখ-দুঃখ, তার জীবনচর্চা, তার দর্শন, তার অন্তরাত্মার ধারা-বিবরণী লিখতে৷ সেই জন্যই তিনি লিখছেন ‘‘ঝড়ের দিনে যে ঝড়ই সর্বপ্রধান ঘটনা, তাহা তাহার গর্জন সত্ত্বেও স্বীকার করা যায় না; সেদিনও সেই ধূলি সমাচ্ছন্ন আকাশের মধ্যে পল্লীর গৃহে গৃহে যে জন্ম-মৃতু্যর সুখ-দুঃখের প্রবাহ চলিতে থাকে, তাহা ঢাকা পড়িলেও মানুষের পক্ষে তাহাই প্রধান৷ কিন্ত্ত বিদেশী পথিকের কাছে এই ঝড়টাই প্রধান৷ এই ধূলিজালই তাহার চক্ষে আর-সমস্তই গ্রাস করে, কারণ সে ঘরের ভিতরে নাই, সে ঘরের বাহিরে৷ সেই জন্য বিদেশীর ইতিহাসে এই ধূলির কথা, ঝড়ের কথাই পাই; ঘরের কথা কিছুমাত্র পাই না৷’’


‘ঘরের ইতিহাস’ লিখতে গিয়ে তিনিও ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতো কোনো ‘স্বপ্নলব্ধ ইতিহাস’ লিখতে চেয়েছেন বলে মনে করলে ভুল হবে৷ হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যারেটিভে’ কল্পিত ইতিহাসের কিছু উপাদান রয়েছে, কিন্ত্ত তার চেয়ে বেশি আছে প্রথাগত ইতিহাস বিদ্যার সমালোচনা৷ রণজিৎ গুহ ইতিপূর্বেই এই দিকটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ আরও বলছেন, ‘‘ইতিহাস সকল দেশে সমান হইবেই৷ এ কুসংস্কার বর্জন না করিলে নয়৷… ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় দফতর হইতে তাহার রাজবংশমালা ও জয়পরাজয়ের কাগজপত্র না পাইলে যাহারা ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্বন্ধে হতাশ্বাস হইয়া পড়েন এবং বলেন, যেখানে পলিটিক্স নাই সেখানে আবার হিস্ট্রি কিসের, তাহারা ধানের ক্ষেতে বেগুন খুঁজিতে যান এবং না পাইলে মনের ক্ষোভে ধানকে শস্যের মধ্যেই গণ্য করেন না৷’’ ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে বিকল্প ধারার যে মৌলিক থিসিস রবীন্দ্রনাথ উত্থাপন করলেন তার যৌক্তিক পরিণতি_ পরবর্তীকালের ‘স্বদেশী সমাজ’ (১৯০৪), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬) ও ‘ন্যাশনালিজম’ (১৯১৭) প্রবন্ধ গুচ্ছ৷ এসব লেখায় ইতিহাস বিদ্যার রাজনীতিনির্ভর আখ্যায়িকার সমালোচনার মূলে রয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ভিন্ন ধরনের সমাজ প্রণালি ও ভিন্ন ধারার আধুনিকতা খোঁজা৷ এটা খুঁজতে গিয়ে সময় সময় তাঁকে ‘কল্পিত সমাজ’-এর দ্বারস্থ হতে হয়েছে, যার সত্যতা বা অসত্যতা ইতিহাস-উপাদানের আর্কিওলজির ওপর দাঁড়িয়ে নিরূপণ করা দুরূহ৷ যেমন- ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, ‘‘বিলাতের স্টেটের সঙ্গে আমাদের রাজশক্তির প্রভেদ আছে৷ বিলাত, দেশের সমস্ত কল্যাণকর্মের ভার স্টেটের হাতে সমর্পণ করিয়াছে – ভারতবর্ষ তাহা আংশিকভাবে মাত্র করিয়াছিল’’৷ সত্যই কি তাই করেছিল? একথা প্রথাগত ইতিহাসবিদ্যার নিরিখে নির্ণয় করার উপায় এখনও সীমিত৷

এর কারণ প্রাচীন ভারতবর্ষের সমাজ সম্পর্কে যা পাওয়া যায় প্রথাগত ইতিহাসের কল্যাণে, তা খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন উপাদানই কেবল-তাতে করে সেকালের পুরো সমাজ চিত্রটা আমাদের চোখের সামনে আজও পূর্ণভাবে দেখতে পাই না৷ কোশাম্বী থেকে রোমিলা থাপার, হাসান দানী থেকে ইরফান হাবিব ঘাঁটলেও এ সমস্যার সমাধান হয় না৷ ভাষা-বিজ্ঞানের মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস রচনাতেও এর সমাধান মেলে না, সে চেষ্টা ইতিপূর্বেই বঙ্কিমে আমরা দেখেছি৷ ফলে প্রাচ্যের ‘কল্পিত সমাজ’ জানতে গিয়ে বারবার ফিরে যেতে হয় ধর্মগ্রন্থে, পুরাণে, মহাকাব্যে, প্রবচনে, লোকগাথায়৷ রবীন্দ্রনাথ এ কাজটিই করেছেন তার বক্তব্যের সপক্ষে উদাহরণ টানার ক্ষেত্রে৷ ওয়েন্ডি ডনিজের-এর বিশালকায় ‘হিন্দুইজম’ গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতবর্ষীয় ইতিহাস রচনায় পুরাণভিত্তিক পর্যালোচনার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ৷

মোদ্দাকথা, রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চিন্তা ও স্বদেশ চিন্তা ভিন্ন এক ইতিহাস এবং ভিন্ন এক স্বদেশ-কল্পনাকে সামনে তুলে ধরে৷ একে আমরা জ্ঞানচর্চায় ‘পজিটিভিজম’-এর সমালোচনা হিসেবে দেখলে বাড়াবাড়ি করা হয় না৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি লেখায় ‘স্বদেশ কি’ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের জন্মভূমি তিনটি, তিনটিই একত্র জড়িত৷ প্রথম পৃথিবী৷ মানুষের বাসস্থান পৃথিবীর সর্বত্র৷ … মানুষের বস্তুত বাসস্থান এক৷ ভিন্ন ভিন্ন জাতির নয়, সমগ্র মানবজাতির৷ মানুষের কাছে পৃথিবীর কোনো অংশ দুর্গম নয়৷ পৃথিবী তাঁর কাছে হূদয় অবারিত করে দিয়েছে৷ … মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক৷ … মানুষ জন্মগ্রহণ করে সমস্ত পৃথিবীতে, জন্মগ্রহণ করে নিখিল ইতিহাসে৷… তাঁর তৃতীয় বাসস্থান আত্মিকলোক৷ সেটাকে বলা যেতে পারে সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ৷ অন্তরে অন্তরে সকল মানুষের যোগের ক্ষেত্র এই চিত্তলোক’’৷ গানেও এ কথা বলেছেন, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো’ সেখানেই দেখা হবে৷

‘জন্মভূমি’র এ সংজ্ঞাকে আমরা কী বলব? বিশ্বায়নের পরিস্থিতিতে নতুন সংজ্ঞা বললে বড় বেশি কেজো শোনাবে৷ যদি বলি, এর থেকেই ‘ন্যাশনাল’ ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ যেন হাবেরমাসের মতো কোনো ‘পোস্ট ন্যাশনাল’ পৃথিবীর কথা ভাবছেন, সেটাও হবে খণ্ডিত-পাঠ৷ রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বজ্ঞ মন থেকে যে জন্মভূমির পাঠ তার গদ্যে, পদ্যে বা গানে বেরিয়ে এসেছে, তার ব্রাত্য কমরেডরা সে যুগের এবং এ যুগের বাউল সম্প্রদায়ের কবি-দার্শনিকরা তাতে পুরোপুরি সায় দিতেন৷ কেননা তারাও সারা জীবন মনের মানুষকেই খুঁজে ছিলেন জাতি-সত্তা, নেশন-স্টেট ও নির্দিষ্ট ভূগোল ইতিহাসের গণ্ডির বাইরে৷ তবে উচ্চবর্গীয় সমাজের কানে রবীন্দ্রনাথের এই গান ‘অন্য ভুবনের’ বলেই ঠেকবে৷ মতাদর্শগত আলোচনার প্রচলিত বাম-ডান-মধ্যপন্থার ধারায় রবীন্দ্রনাথকে ঠিক আবদ্ধ করা চলে না৷ তিনি বাধা গণ্ডির বাইরে নিজের চিন্তাকে প্রসারিত করে আমাদের অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেন প্রায়ই৷ তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে প্রথাগত মতের সমর্থন মিলছে কি-না সেটি তাঁকে প্রভাবিত করে না৷ তিনি রাশিয়ায় গিয়ে প্রশংসার পাশাপাশি তিরস্কার করতে ভোলেন না, আবার আমেরিকায় গিয়ে প্রত্যাশার স্বীকৃতি জানিয়েও হতাশাকে স্পষ্ট করায় পিছুপা হন না৷ তাঁর মন সর্বত্রগামী না হলেও বহু বিচিত্র বিষয়ের অনুগামী-তাঁর সমসাময়িকেরা এই বিচিত্রবিধ অনুসরণের ‘গ্রামার’ বুঝতে অপারগ৷ তিনি ধর্মতত্ত্ব আলোচনায় উপনিষদের পাশাপাশি বাউল মতকে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দেন৷ আবার সনাতনপন্থীদের ধারণা ভেঙে বেঙ্গল স্কুল অব আর্টের পুরোধা অবনীন্দ্রনাথ – নন্দলালকে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের কথা স্মরণ করিয়ে দেন৷ তিনি সন্ত কবীরের গানের নিবিষ্ট অনুবাদ করেন ইংরেজিতে, আবার ইংরেজিতে লেখেন ‘ন্যাশনালিজম’ বক্তৃতামালা, যার বাংলা তর্জমা করতে কুণ্ঠাবোধ করেন জাতীয়তাবাদীরা৷ নেশনের ব্যাভিচার তাঁর রাজনৈতিক রুচির বিরুদ্ধে- তাই তিনি অন্য কোনো প্রত্যয় না পেয়ে ‘নেশন’ ও ‘নো-নেশন’-এর তুলনা টানেন৷ বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম’-এর সুরারোপ করেন তিনি, আবার এ গানে মুসলমানদের মনোকষ্ট হওয়ার যথেষ্ট পরিমাণে কারণ রয়েছে সঙ্গতভাবেই এ কথা গান্ধিকে স্মরণ করিয়ে দেন৷ তাঁর রচিত গান গেয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অবিভক্ত ভারতে ও পরবর্তী সময় বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের বা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হয়ে ওঠে৷ আবার ভারতের জন্য ন্যাশনালিজমের পথ সঠিক পথ নয় বলে আমাদের ভদ্র সম্প্রদায়কে বিচলিত করে তোলেন৷ কখনও তিনি আধুনিকের আধুনিক, সর্বাধুনিক চলতি হাওয়ারপন্থী, কখনও তিনি প্রাগ-আধুনিক, ‘সামাজিক প্রবন্ধের’ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতোই ভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রনৈতিক ঐতিহ্যের সমর্থক৷ গান্ধিকে ‘মহাত্মা’ আখ্যা তাঁরই দেওয়া, আবার ধর্মাশ্রিত রূপকের ভিত্তিতে গান্ধির গড়ে তোলা অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধিতা তাঁর থেকেই সবচেয়ে জোরালোভাবে আসে৷ ‘মেশিন’ (যন্ত্র-সভ্যতা) ও ‘অর্গানাইজেশন’ (দমনমূলক রাষ্ট্র) – ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলায় ও ইংরেজিতে অজস্র বার তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন, কিন্ত্ত গান্ধির চরকা এবং গ্রামজীবনকে মহিমান্বিত করতে চাননি এক মুহূর্তের জন্য৷ তিনি জমিদারি চালিয়েছেন, রায়তের কথা ভেবেছেন, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির পথ খুঁজেছেন, কিন্ত্ত সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন৷ তাঁর দাদাঠাকুর দ্বারকানাথ ছিলেন ১৮৩০-৪০ দশকের সর্বাগ্রগণ্য বাঙালি বুর্জোয়া, তাকে মনে রেখে এক লাইন কবিতাও লেখেননি তিনি৷ বরং বেন্থাম-মিলের বুর্জোয়া মন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘অন্যের ধনে লোভ করো না’ বলে বারবার মুনাফাকেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থা ও ব্যক্তি-স্বার্থপরতার সমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন৷ তাই বলে তাঁকে ঘোর সমাজতন্ত্রী বলারও জো নেই৷ রাশিয়ায় গিয়ে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘মানব-প্রকৃতি’-এর কথা৷ রাষ্ট্রের শাসনপ্রণালির বিপরীতে পুরসমাজের প্রতি পক্ষপাতিত্বে, পুরসমাজের অনুশাসনের বিপরীতে লোকসাধারণের সপক্ষে, লোকসাধারণের সংস্কারাচ্ছন্ন লোকাচারের বিরুদ্ধে সহিষ্ণু লোকধর্মের অন্বেষায় তিনি অটল ছিলেন৷ ‘মহাজাতি’ গঠনে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত ইতিহাসের স্বীকৃতি ও এ দুইয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘সমকক্ষতা’ আনার জন্য আজকের যুগের ভাষায় ‘এফারমেটিভ অ্যাকশন’-এর প্রয়োজনীয়তাকে তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন৷ তিনি নিজে প্রথাগত হিন্দু সমাজের কেউ ছিলেন না, ব্রাহ্মসমাজেও তার স্থান হয়নি৷ এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে বলেছেন কাদম্বিনী দেবীকে ১৯১০ সালেই ‘‘নানা কারণে ব্রাহ্মসমাজে আমাকে ঠিক ব্রাহ্ম বলে গ্রহণ করেননি এবং আমাকে তাঁরা বিশেষ অনুকূল দৃষ্টিতে কোনোদিন দেখেননি৷ এই ভূমিকাটুকু আবশ্যক৷ … যখন আমরা সত্যই ঈশ্বরকে চাই তখন আমরা নিজের বা অন্যের সঙ্গে লেশমাত্র চালাকি করতে পারিনে৷ এই রকম অবস্থায় আমি আমাদের দেশপ্রচলিত দেবপূজার প্রণালীকে কেন যে সমস্ত মন থেকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি, তা নিশ্চয়ই আমার সমস্ত শান্তিনিকেতনের লেখাগুলোর ভেতরে কতকটা প্রচ্ছন্ন ও কতকটা প্রকাশ্যভাবে ব্যক্ত হয়েছে৷’’ ‘প্রাচ্য’ বলতে তিনি কেবল ভারতবর্ষের পুরাকালের অতীতকে বোঝাননি, যেমন ‘পাশ্চাত্য’ বলতে শুধু বোঝাননি বিজ্ঞানভিত্তিক ইউরোপীয় সভ্যতাকে৷ প্রাচ্য তার কাছে প্রকাশিত হয়েছিল নানারূপে- পারস্য থেকে দূরপ্রাচ্য অবধি, আবার তার সংজ্ঞায়নও ঘটেছিল ভূগোলের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়৷ যেমন, তিনি ‘ভারত’কে ভেবেছিলেন ভৌগোলিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো সমাজ হিসেবে নয়, বরং নৈতিক ‘আইডিয়া’ বা ধারণা হিসেবে-যা পাশ্চাত্যের ছকের অন্ধ অনুকরণের বদলে আমাদের হয়তো বিকল্প-আধুনিকতার সন্ধান দিতে পারে৷ আধুনিকতার ওপর পাশ্চাত্যেরই কেবল একচেটিয়া অধিকার নেই- এ কথা রবীন্দ্রনাথই প্রথম বলেছিলেন৷ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন বা মধ্যযুগের ভারতবর্ষ বা মধ্যযুগের মুসলমান সভ্যতা বা সুপ্রাচীন চীন আধুনিক পাশ্চাত্যের চেয়ে পিছিয়ে ছিল না৷ আবার পাশ্চাত্যকে বাদ দিয়েও উত্তর-ঔপনিবেশিক মনের মুক্তি নেই৷ ভারতের ইতিহাস কেবল হিন্দুর ইতিহাস নয়, মুসলমানেরও ইতিহাস, তেমনি আবার ইংরেজেরও ইতিহাস৷ যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি সেই ‘ছোট ইংরেজদের’ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ‘বড় ইংরেজদের’ নিয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক মনকে পুনর্নির্মাণ করার প্রস্তাব ছিল তাঁর৷ এই সত্যনিষ্ঠা যেমন সহজ ছিল না তার স্বদেশীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষে গ্রহণ করা, তেমনি এই সত্যনিষ্ঠাই তাকে চালিত করেছিল প্রতিবাদের প্রকাশ হিসেবে ইংরেজদের দেওয়া নাইটহুড বর্জনের ক্ষেত্রে৷ দুটিই চলেছে পাশাপাশি৷ তাঁর প্রাচ্য যেমন তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত প্রাচ্য তেমনি, তাঁর পাশ্চাত্যও তাঁর স্ব-নির্মিত৷