আমেরিকা-ইজরায়েল-আরব অক্ষ ও প্যালেস্টাইন

ইজরায়েলের হামলায় যুদ্ধবিধ্বস্ত প্যালেস্টাইন। ফাইল চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

ইজরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ব কূটনীতিতে আমেরিকা আজ প্রায় সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েছে৷ শুধু ইউরোপের দেশগুলোই নয়, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশও চাইছে, এখনই যুদ্ধ বন্ধ হোক৷ আমেরিকার এই অবিচল সমর্থনের কারণ কী? প্রথম কারণ, সে দেশে ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিদের সংখ্যা আর গুরুত্ব৷ ১৯৩০-এর বছরগুলো থেকেই জার্মানি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে প্রবল জাতিবিদ্বেষের হাত থেকে পালিয়ে আমেরিকায় উদ্বাস্তু হিসেবে আসতে থাকেন ইহুদিরা৷ কেবল সংখ্যাই নয়, আমেরিকার ব্যবসাবাণিজ্য, অর্থব্যবস্থা এবং বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানে রয়েছেন ইহুদিরা৷ তাই ইজরায়েলের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কও বরাবর খুব ঘনিষ্ঠ৷ সারা পৃথিবী অন্য কথা বললেও আমেরিকা ইজরায়েলের পক্ষ সমর্থন করে গেছে, অন্তত ৪৭ বার নিরাপত্তা পরিষদে ইজরায়েলকে বাঁচানোর জন্য ভিটো প্রয়োগ করেছে৷ তাই এ বারের ঘটনায় নতুন কিছু নেই৷

এ ছাড়াও এখানে আরও গভীর এক সাংস্কৃতিক বন্ধন কাজ করে চলেছে৷ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় অভিবাসীদের উপনিবেশ হিসেবে৷ আদি জনগোষ্ঠীদের উচ্ছেদ করে, বহুলাংশে হত্যা করে, তারা বসতি স্থাপন করেছিল৷ তাতেই সৃষ্টি হয়েছিল সেই কল্পকথা যে আমেরিকা হল খ্রিস্টান ইউরোপীয়দের উদ্দেশে ঈশ্বরের দান৷ ইজরায়েলের সৃষ্টির পিছনে যে জায়নবাদ, তাতেও আছে বাইবেল-কথিত ‘মিথ’: ইজরায়েল ইহুদিদের ঈশ্বরদত্ত বাসভূমি, যেখান থেকে তাঁরা নির্বাসিত হয়েছিলেন প্রায় দু’হাজার বছর আগে৷ বিশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, যখন সারা দুনিয়ায় উপনিবেশবাদের অবসান হতে চলেছে, তখন পশ্চিম এশিয়ার ভূখণ্ডে সেখানকার দীর্ঘকালের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে, তাঁদের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে, এক শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী কলোনি স্থাপন করছে, এমন আখ্যান শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের হৃদয় স্পর্শ না করে যায় না৷ গত পঁচাত্তর বছর ধরে দুই দেশের নেতারা বলে আসছেন, আমরা তো এক, আমাদের ঐতিহাসিক অবস্থা এক, আমরা একে অপরকে বুঝি, তাই সমর্থন করি৷ সাম্প্রতিক কূটনৈতিক শলাপরামর্শেও আমেরিকা-ইজরায়েল জোটবন্ধন জোরদার হয়েছে৷ ডোনাল্ড ট্রাম্প চিরাচরিত আমেরিকান অবস্থান ছেড়ে বিতর্কিত জেরুসালেম শহরকে ইজরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেন৷ প্রবল ইরান-বিরোধিতার পাশাপাশি তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান যাতে ইজরায়েলের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলির কূটনৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হয়৷


বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের পথ থেকে এতটুকু সরেনি৷ বরং ওই অঞ্চলে রাশিয়া, চিন আর ইরানের প্রভাব কমানোর উদ্দেশ্যে ইজ়রায়েল-আরব সহযোগিতা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করেছে৷ তা থেকে অনেকের মনেই এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে প্যালেস্টাইন সমস্যাটা যেন পার হয়ে আসা গেছে, তা অতীত ইতিহাস, আগামী দিনে তার আর কোনও তাৎপর্য থাকবে না৷ কিন্ত্ত ৭ অক্টোবরের,২০২৩ – এর হামাস আক্রমণ সেই সুখস্বপ্ন ভেঙে চৌচির করে দিল৷ ইজরায়েল ও আমেরিকার বক্তব্য, হামাস বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার অধিকার ইজরায়েলের আছে৷ সেই নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে তখনই, যখন হামাস সম্পূর্ণ ভাবে নিষ্ক্রিয় হবে৷ কিন্ত্ত হামাসের সেনারা গাজার ঘনবসতি শহরগুলোয় সাধারণ মানুষের পিছনে আর মাটির নীচে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকে৷ কাজেই তাদের নির্মূল করতে হলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হবেই৷ এমনকি বহু লোক মারাও যাবে৷ কত লোক? ইজরায়েলি আর প্যালেস্টাইনি জীবনের বিনিময়মূল্য কত? ইজরায়েলের হিসাব অনুযায়ী ৭ অক্টোবরের হানায় ১,১৩৯ জন ইজরায়েলির মৃতু্য হয়েছিল৷ ইজরায়েলের প্রতি-আক্রমণে গাজ়ায় আজ পর্যন্ত ৩০,০০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে৷ আমেরিকার নেতাদের কথায় মনে হয়, বদলার বিনিময়মূল্য স্থির করার অধিকার ইজরায়েলের৷ তারা যে দিন বলবে, যথেষ্ট হয়েছে, সে দিন যুদ্ধ থামবে৷ তার আগে আমেরিকা যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করবে না৷ ইজরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে৷ প্যালেস্টাইনের মানুষের কি আত্মরক্ষার অধিকার নেই? এই প্রশ্নটা কেউ মুখ ফুটে উচ্চারণ করছে না৷

গাজ়া এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর— প্যালেস্টাইনের দুই অংশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শেষ কথা বলে ইজরায়েলের পুলিশ আর সেনাবাহিনী৷ তাদের দেশে ইজরায়েলের অন্যায় দখলদারির বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনিদের কোনও মিটিং-মিছিল-সমাবেশ-ধর্মঘট, অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলার এতটুকু সু্যোগও নেই৷ সুতরাং অনিবার্য ভাবেই গড়ে উঠেছে সশস্ত্র জঙ্গি প্রতিরোধ৷ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে এক সময় ছিল ফতাহ গোষ্ঠী, গাজায় এখন আছে হামাস৷ প্যালেস্টাইনিদের কোনও স্বীকৃত রাষ্ট্র নেই৷ অতএব কোনও স্বীকৃত সেনাবাহিনীও নেই৷ হামাসের জঙ্গিরা পেশাদার সৈনিক নয়৷ তাদের আলাদা কোনও ছাউনি, ব্যারাক বা ‘বেস’ নেই৷ সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থেকেই তারা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, সাধারণ মানুষের পিছনে লুকিয়ে নেই৷ সুতরাং গাজাকে হামাসমুক্ত করতে হলে তাকে জনশূন্য করে ফেলতে হয়৷ অথবা এমন অবস্থা তৈরি করতে হয় যে সেখানে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ ইজরায়েলের যুদ্ধনীতি থেকে মনে হয় সেটাই তার প্রধান উদ্দেশ্য৷ উত্তর গাজা এখন প্রায় সবটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, তা একেবারেই বাসের অযোগ্য৷ মধ্য গাজাও দ্রুত সেই দিকে যাচ্ছে৷ সেখানকার মানুষ নিরুপায় হয়ে দক্ষিণে পালিয়ে এসেছেন৷ যেখানে আগে হয়তো এক-দেড় লক্ষ মানুষ থাকতেন, সেখানে এখন আশ্রয় খুঁজছেন প্রায় বিশ লক্ষ৷ সমস্ত গাজ়া জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ, দোকান-বাজার বলতে কিছু নেই৷ খাদ্য নেই, জ্বালানি নেই৷ খোলা মাঠের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে হাজার হাজার মানুষ কোনও রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন৷
রাষ্ট্রপুঞ্জের ত্রাণ সংস্থা বলছে, গত দু’মাসে তাদের একশোর বেশি কর্মী গাজার বোমাবর্ষণে মারা গিয়েছে৷ যুদ্ধ বন্ধ না হলে তারা গাজার মানুষকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দিতে পারবে না৷ অথচ খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য সেখানে মহামারি আর দুর্ভিক্ষের আশু সম্ভাবনা৷ সকলের মুখে তাই মানবিকতার কথাটাই সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে৷ সন্দেহ নেই, টেলিভিশনের পর্দায় রোজ গাজার যে অবর্ণনীয় দৃশ্য দেখা যাচ্ছে— বোমার আঘাতে, ভাঙা বাড়িঘরের নীচে চাপা পড়া মৃত পঙ্গু রক্তাক্ত শিশুদের ছবি, তাতে সারা বিশ্বের মানুষ বিচলিত হয়ে দাবি করছে, ‘এই সর্বনাশা হত্যালীলা বন্ধ করো’৷ এমনকি আমেরিকাও দু’ফোঁটা কুম্ভীরাশ্রু ফেলে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে, যুদ্ধ চললেও সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য কিছু করা উচিত৷ এর পর হয়তো দেখা যাবে, গাজার বিপন্ন মানুষ আর সহ্য করতে না পেরে রাফা সীমান্তের গেট ভেঙে মিশরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন৷ তখন এই আমেরিকান নেতারাই হয়তো বলবেন, মানবিকতার খাতিরে মিশর বা জর্ডান যেন গাজ়ার দুর্গতদের আশ্রয় দেয়৷ ইজরায়েলের নেতারা বলবেন, আপদ বিদেয় হল৷ গাজা এখন জনশূন্য৷ ওখানে শ্মশানের শান্তি বিরাজ করবে৷

যুদ্ধবিরতি হল না৷ এর পর কী হবে? আমেরিকার নেতারা ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধ শেষ হলে ইজরায়েলের পাশে প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে৷ এই হল ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’৷ প্যালেস্টাইন থেকে নতুন করে কোনও উদ্বাস্তু অন্যত্র পাঠানো হবে না৷ ইংরেজিতে একটা কথা আছে, কুকুর লেজ নাড়ে, না লেজ কুকুরকে নাড়ায়? বাইডেন প্রশাসনের হাবভাব দেখে মনে হয়, তারা প্রকাশ্যে বা গোপনে যতই ইজরায়েলকে সংযত হওয়ার উপদেশ দিক না কেন, নেতানিয়াহু সরকার জানে আমেরিকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইজরায়েল-সমর্থকদের যা প্রভাব, তাতে তারা ইজরায়েলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না৷ অতএব যত দিন প্রয়োজন, তত দিন ইজরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে৷ অন্য দিকে প্যালেস্টাইনের মানুষ বিশ্বাস করেন, তাঁদের উপর ইজরায়েলি আধিপত্যের বিরুদ্ধে যে কোনও প্রয়োজনীয় উপায়ে প্রতিরোধের ন্যায্য অধিকার তাঁদের আছে৷ গত পঁচাত্তর বছর ধরে তাঁরা প্রতিরোধ করে আসছেন৷ এটা নিশ্চিত, আজ গাজ়ায় যে গণহত্যা চলেছে, তার মধ্যে দিয়ে প্যালেস্টাইনি মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম হল৷ আগামী দিনে তারাই সেই লড়াই চালিয়ে যাবে৷ প্যালেস্টাইনের মুক্তিযুদ্ধ থামবে না৷