সংসদে ‘সক্রিয়’ অভিষেক, দলের শক্তি বৃদ্ধি করছে যুবনেতার ‘নতুন’ রূপ

নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র থেকে রেকর্ড ভোটে জিতে তৃতীয়বারের সাংসদ হয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশে যেকোনও দলীয় কার্য সম্পাদন থেকে নিজ লোকসভা কেন্দ্রের উন্নয়ন সবক্ষেত্রেই অভিষেক তৃণমূলের ‘ফার্স্টবয়’ এবং একজন আদৰ্শ সাংসদ। তবে সংসদে তাঁর উপস্থিতি থাকত নামমাত্র। তাই সংসদে অভিষেকের উপস্থিতির হার ছিল বিরোধীদের কটাক্ষের বিষয়বস্তু। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ অন্য মেজাজে রয়েছেন তৃণমূল সেনাপতি।

মমতার নির্দেশে এবং পরামর্শে জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছেন অভিষেক। এরপর থেকেই লোকসভা অধিবেশনে তাঁর ধারাবাহিক উপস্থিতি যেন অবাক করছে বিরোধীদের। কখনও সংসদে কেন্দ্রীয় বাজেটের বিরোধিতা করে কেন্দ্র সরকারকে আক্রমণ করছেন, আবার কখনও শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিতে লোকসভা থেকেই ওয়াক আউট করে প্রতিবাদী রূপ প্রকাশ্যে আনছেন অভিষেক। তৃণমূলের অন্দরমহলই মানছে, গত ১০ বছরে এই ভূমিকায় কখনও দেখা যায়নি তাঁকে।

তাহলে দায়িত্ব বৃদ্ধি থেকেই কি বদল অভিষেকের রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিতে? লোকসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক হলেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভায় দলীয় গতিবিধির নিয়ন্ত্রণ মূলত সুদীপের হাতেই রয়েছে। কিন্তু লোকসভায় নয়া অধিবেশন শুরু হতেই ‘আক্রমণাত্মক’ ও ‘সক্রিয়’ রূপে প্রতিভাত হয়েছেন যুবনেতা অভিষেক। ফলে অভিজ্ঞ সুদীপের সক্রিয়তাও ম্লান করে দিচ্ছে অভিষেকের ‘নতুন’ রূপ।


সংসদের অধিবেশন শুরুর পর থেকেই অভিষেক নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কখনও স্পিকার নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেসের প্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়াকে সোজাসুজি একতরফা সিদ্ধান্ত বলে দিয়েছেন; আবার কখনও বলেছেন, বিজেপি তথা এনডিএ-র খাতায়কলমে যে সংখ্যা রয়েছে, তা আরও কমে যাবে; এই ভয়ে স্পিকার নির্বাচনে কেবল ধ্বনিভোট নেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, লোকসভার স্পিকার নির্বাচনের সময়ে কংগ্রেসের ঘোষণাকে অভিষেক কর্তৃক একতরফা বলা হলে, বেশ চাপ সৃষ্টি হয়েছিল কংগ্রেসে। যার জেরে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী সংসদ ভবনের ভিতরে বসে পৃথকভাবে কথা বলেছিলেন অভিষেকের সঙ্গে। এর থেকে প্রমাণিত, অভিষেক বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’তে বিভিন্ন বিজেপি-বিরোধী দলের সহাবস্থান হলেও কারও ‘দাদাগিরি’ কিংবা একতরফা সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না তৃণমূল। স্পিকার নির্বাচনের সময় সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেছিলেন, “বিজেপি স্পিকার নির্বাচনে ভোটাভুটি করতে ভয় পেয়েছে।”

সুতরাং, বিজেপি-বিরোধী অবস্থানে যে কোনও ফাঁক রাখতে চাননা অভিষেক, তাও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন পরোক্ষভাবে। অভিষেকের শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, তিনি ‘ফর্মে’ রয়েছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, এবার বাজেট বক্তৃতায় তৃণমূলের তরফে অভিষেকই ছিলেন প্রথম বক্তা। বক্তৃতার আগের দিন নিজেই তা ঘোষণা করেছিলেন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে। সেই বক্তৃতার ‘তেজ’ নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, “বিজেপি যে ভাষায় বোঝে, তাঁদের সেই ভাষাতেই আমি বোঝাতে এসেছি।” এমনকি বক্তৃতার মাঝেও লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার সঙ্গে সামান্য মতপার্থক্য হয় অভিষেকের। সেখানেও দক্ষতার সাথে নিজ যুক্তি দেন যুবরাজ। যার অর্থ হল, দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করতে যুক্তিতর্কে সর্বদাই প্রস্তুত অভিষেক।

এরপর কেন্দ্রের বাংলায় বরাদ্দ সংক্রান্ত শ্বেতপত্র প্রকাশ করা নিয়েও সংসদে আওয়াজ তুলেছিলেন অভিষেক। যা দলীয় শক্তি বৃদ্ধির নজির। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের প্রশ্নেও সংসদে অভিষেকের ভূমিকাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন দলেরই প্রথম সারির অনেকে। সংসদে সেনাপতির নতুন ভূমিকাকে তৃণমূলের অনেকেই জাতীয় রাজনীতির উঠোনে ‘অভিষেকের নবনির্মাণ’ বলে অভিহিত করছেন। অভিষেক স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রের জোট সরকারের মেয়াদ বেশি দিনের নয়। পাশাপাশি, আগামী বিধানসভা নির্বাচনেও যে বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়বে, তারও ভবিষ্যতবাণী শুনিয়ে দিয়েছিলেন। যে প্রখর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি এ কথা বলেছিলেন, তাতে স্পষ্ট, দুর্বল কেন্দ্র সরকারের বিরোধিতার অঙ্ক কষেই অভিষেক সলতে পাকানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন।