‘তিন মাসের মধ্যেই পদক্ষেপ করা হবে’,  ভোটে নিষ্ক্রিয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার বার্তা অভিষেকের

প্রশান্ত দাস:  একেবারে রাজকীয় ‘কামব্যাক’ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের। রাজনৈতিক ‘বিরতি’ মিটতেই সোজা একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে উপনীত হলেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দোপাধ্যায়, রাখলেন হাইভোল্টেজ বক্তব্য। একদিকে যেমন নবীন-প্রবীণদের সামঞ্জস্য বিধানের বার্তা দিলেন যুবরাজ, তেমনি অন্যদিকে ভোটে ‘নিষ্ক্রিয়’ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও সুর চড়ালেন। হালকা-মাঝারি বৃষ্টি কোনোরূপ সমস্যার সৃষ্টিই করতে পারলো না অভিষেকের বক্তৃতায়। দুপুর ১২ টা থেকে সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এদিন নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পূর্বেই ধর্মতলার সভাস্থলে পৌঁছান তৃণমূল সেনাপতি তথা তৃণমূলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।

পৌঁছেই শহিদবেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন এবং স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বেদির সামনে রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম জানান শহীদদের। তারপরই উঠলেন ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে। মঞ্চে উঠে তৃণমূল শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন। জড়িয়ে ধরেন তৃণমূল সাংসদ ইউসুফ পাঠানকে, তারপরে মিনিটখানেক কথা বলেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরে মঞ্চে উপবিষ্ট অভিষেকের সঙ্গে কথা বলে যান ইন্দ্রনীল সেনও। তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সির পাশেই এদিন বসে ছিলেন অভিষেক। ঠিক তারপরই নিজ আসন ছেড়ে বক্তব্য রাখতে যান। এদিন ভোটে ‘নিষ্ক্রিয়’ কর্মীদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়ে অভিষেক স্পষ্ট বলেন, “দল আপনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে। পর্যালোচনার কাজ শেষ। তিন মাসের মধ্যেই পদক্ষেপ করা হবে।”

২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করার বার্তা দিলেন অভিষেক। বললেন, “যাঁরা পুরসভা বা পঞ্চায়েতের দায়িত্বে আছেন, তাঁদের শুধু নিজের কথা ভাবলে চলবে না। কর্মীদের কথাও ভাবতে হবে। ভোটের আগে আমি জেলায় জেলায় গিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক করে বলেছিলাম, ভোটে কে, কী রকম ভূমিকা পালন করেছে, তা পর্যালোচনা করে দেখব ভোটের পরে। বলেছিলাম, পুরসভা আর পঞ্চায়েতের ভোটের সময় আপনারা নিজেদের টিকিটের জন্য লড়বেন আর যখন লোকসভা বা বিধানসভা ভোট আসবে তখন দল আশানুরূপ ফল করবে না, তবে দল আপনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে। পঞ্চায়েতে আপনি নিজের ভোটে খেটে জিতবেন আর লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের সময় ভাববেন যে পার্টি দেখে নেবে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক একটা সভা করে যাবেন, তা হলেই জিতে যাবেন! সেটা চলবে না। নিজের ভোটে যেমন পরিশ্রম করেন, তা-ই করতে হবে। যাঁরা করেননি, সেই সব পর্যালোচনার কাজ শেষ। তিন মাসের মধ্যেই পদক্ষেপ করা হবে।”


তাঁর আরও সংযোজন, “আমি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কথা দিচ্ছি, নির্বাচনে যাঁরা পঞ্চায়েত বা পুরসভার পদে থেকেও মানুষকে বোঝাতে অক্ষম হয়েছেন বা যাঁদের এলাকা থেকে প্রত্যাশিত ফল হয়নি তাঁদের বিরুদ্ধে এবং একই ভাবে আমরা টাউন সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব। গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে প্রধানের বিরুদ্ধে এবং অঞ্চল সভাপতির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা হবে।” এদিন তিনি আরও বলেন, “২০২১ এর নির্বাচনের আগে যাঁরা তৃণমূলে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে বলে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছিল! আবার যখন তাঁরা ফিরে আসতে চেয়েছেন আমরা কয়েকজনকে দলে নিয়েছি। কথা দিয়েছিলাম, যাঁরা দলে ঢুকছে তাঁদের কাউকে একটা তৃণমূল কংগ্রেসের সৈনিকের উপর ছড়ি ঘোরাতে দেবো না। আজ তিন বছর হয়ে গেছে, তাঁরা পারেনি।”

একেবারে ‘অন্যরকম অভিষেক’। দীপ্ত কণ্ঠে যেমন নিষ্ক্রিয় তৃণমূল নেতৃত্বদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন, আবার ‘দলীয় সেনাপতি’-র মতো দলীয় কর্মীদের ‘শৃঙ্খলাপরায়ণ’ হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “তৃণমূলের কর্মীরাই তৃণমূলের শক্তি। আমাদের কর্মীদের সংযত হতে হবে। কোনও রকম বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়াবেন না। বিজেপিকে ভোট দিয়ে মানুষ জেতাননি, মানুষ আপনাদের ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন। তার কারণ, আপনার পাড়া এবং আপনার এলাকায় আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই মানুষগুলো বিশ্বাস করেছেন। বিজেপির কর্মীদের বিশ্বাস করেননি। আমাদের সংযত থাকতে হবে।” এখানেই শেষ নয়, যুবরাজের মাত্র ২৪ মিনিটের বক্তৃতায় উঠে এসেছে দলের নবীন এবং প্রবীণদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের বার্তা।

স্নিগ্ধ কণ্ঠে যুবরাজ বলেন, “যাঁরা নতুন, তাঁদের ২১ জুলাইয়ের ইতিহাস, তৃণমূলের লড়াই এবং নেত্রীর লড়াই সম্পর্কে জানতে হবে। আর যাঁরা পুরনো রয়েছেন, তাঁদেরকেও নতুনদের সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলকে শক্তিশালী করার জন্য মাঠে নেমে লড়াই করতে হবে। সামঞ্জস্য রেখে লড়াই করতে হবে। পুরনোদের অভিজ্ঞতা আর নতুনদের উৎসাহ-উদ্দীপনা তৃণমূলের একই বৃন্তে দু’টি কুসুম।” লোকসভা ভোটে জয়ের মূল কারিগর কারা? মঞ্চ থেকে তাও জানালেন অভিষেক। সাথে তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসলো সমাজবাদী পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব অখিলেশ যাদবের নাম। তিনি বলেন, “এই জয়ের মূল কারিগর তৃণমূল সমর্থকদের পাশাপাশি সমস্ত দেশ জুড়ে এক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দুই, অখিলেশ যাদব।” এদিনের বক্তব্যের শুরুতেই অভিষেকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, “জয় বাংলা”। পাশাপাশি বলেছেন, “লোকসভা ভোটের জয় জনতা এবং তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ে অর্পণ করছি।”

এদিন দফায় দফায় বিজেপিকে আক্রমণ শানিয়েছেন অভিষেক। বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে তোপ দেগে তিনি বলেন, “বিজেপি ভুলে গিয়েছিল ইডি, সিবিআই এর হাতে যে স্ক্রু ড্রাইভার আছে তার থেকে মানুষের হাতের স্ক্রু ড্রাইভারের দম অনেক বেশি। যারা সাধারণ মানুষের জীবন অন্ধকার করে, মানুষ তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অন্ধকার করে দেয়।” ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে এবার রেকর্ড ভোটে জয়ী হয়েছেন অভিষেক। তাঁকে জেতানোর জন্য এদিন মঞ্চ থেকে জনগণকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তবে একই সঙ্গে লোকসভা ভোটের জয় নিয়ে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই।” এরপরই তাঁর সংযোজন, “যে সন্দেশখালিকে হাতিয়ার করে বিজেপি গোটা দেশের সামনে বাংলার বদনাম করেছিল, সেই সন্দেশখালির লোকসভা কেন্দ্র বসিরহাটে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ভোটে জিতেছে তৃণমূল।”

সন্দেশখালির পাশাপাশি নিট দুর্নীতির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে অভিষেকের বক্তব্যে। এ বিষয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেন, “রাজ্যে এসএসসি এবং টেট কেলেঙ্কারির সময় অভিযুক্তদের বাড়িতে গিয়ে গ্রেফতার করেছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি। পার্থ চ্যাটার্জীর বাড়িতে হানা দিয়ে টাকা উদ্ধার করে কেন্দ্রীয় সংস্থা, তারপর তাঁকে গ্রেফতার করে। যাঁরা অন্যায় করে তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হোক। কিন্তু স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি নিট কেলেঙ্কারি। সে ক্ষেত্রে কী হচ্ছে? সেখানে ইডি, সিবিআই কেন ধর্মেন্দ্র প্রধানের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করবে না? কেন এই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ?” এদিন লোকসভা ও রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদদের সংখ্যা মেলালে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হয় তৃণমূল কংগ্রেস, জানালেন অভিষেক।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রায় দেড় মাসের বিরতিতে ছিলেন অভিষেক। চিকিৎসাজনিত কারণ দেখিয়ে রাজনৈতিক ছুটি নিয়েছিলেন। তারপর চোখের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন বিদেশেও, তবে একুশে জুলাইয়ের আগেই ‘কামব্যাক’ করেছেন তিনি। তবে এই দেড় মাসের বিরতিতে কী করেছেন যুবরাজ? তা জানিয়ে দিলেন নিজেই। বলেন, “এই এক-দেড় মাস আপনারা আমাকে কোনও দলীয় কর্মসূচিতে দেখেননি। তার কারণ, আমি পর্যালোচনা করছিলাম। সেই পর্যালোচনার ফল আপনারা তিন মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন।” তাঁর ভাষায়, পর্যালোচনা শেষ, এবার কেবল পদক্ষেপ করা হবে। দলের জয় নিয়ে বরাবরই আত্মবিশ্বাসী বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতা অভিষেক।

এদিনের মঞ্চ থেকেই তিনি বলেন, “আমরা চব্বিশের একুশে জুলাইয়ে বাংলা থেকে বিজেপিকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছি। বিজেপি এই ধর্মতলায় ২০১৫ সালে সিদ্ধার্থনাথ সিং এবং অমিত শাহ সভা করে বলেছিলেন, ভাগ তৃণমূল ভাগ! আজ বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটিকে বাংলার প্রত্যেক প্রান্ত থেকে বাংলার মানুষ প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে।” তাঁর ভাষায়, “যা কথা দিয়েছি, সব পালন করব, আপনারা কথা দিচ্ছেন তো? আগামী দিনে আমরা জিতব, কিন্তু সেই জয় যেন ২০২১ এর থেকেও বড় হয়, ২০২৪ সালের থেকেও বড় হয়।”