২৬ -এর লড়াইয়ে অস্ত্র হিসেবে নবান্নে ‘ক্যামাক স্ট্রিট মডেল’ চান অভিষেক, ‘বিরতি’ নিয়ে ইঙ্গিত যুবরাজের

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

নিজস্ব প্রতিনিধি, ১৩ জুন– ‘পারফরমেন্স’-এ বিশ্বাসী যুব রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সামান্য বিরতি নিয়েছেন রাজনীতি থেকে। তারপর থেকেই বঙ্গীয় রাজনৈতিক মহলে যে জল্পনার উত্থান হয়েছে, তা শেষ হওয়ার নাম নেই। এই জল্পনা যাকে কেন্দ্র করে, তিনি আর কেউ নন। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায়। বুধবার নিজের এক্স হ্যান্ডেলে ট্যুইট করে অভিষেক জানান, চিকিৎসার কারণে সংগঠন থেকে ছোট বিরতি নিচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি রাজ্য সরকার তাঁর দায়িত্ব পালন করবে বলে নিজের বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করেছিলেন যুবরাজ। এরপরই অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের মধ্যে কেউ বলছেন, তিনি দলীয় কাজকর্ম নিয়ে অসন্তুষ্ট। আবার কেউ বলছেন, আসন্ন বিধানসভা উপনির্বাচনে যে প্রক্রিয়ায় প্রার্থী চয়ন হচ্ছে, তা নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট। বিবিধ আলোচনার মধ্যে তৃণমূলের আলোচনায় বড় করে উঠে আসছে নবান্নের কাজকর্ম নিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটের অসন্তোষ প্রসঙ্গ। অভিষেকের ঘনিষ্ঠেরা ঘরোয়া আলোচনায় জানিয়ে দিচ্ছেন, সরকারের কাজ, কিছু মন্ত্রী এবং আমলার কার্যে শ্লথগতি জনমানসে তৃণমূল সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে। যা ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের জন্য খুব ভালো সঙ্কেত নয়। আর সে বিষয়েই চিন্তিত যুবরাজ।

অভিষেকের রাজনৈতিক চিন্তাধারা সামান্য পৃথক। তিনি ‘পারফরমেন্স’-এ বিশ্বাসী। তাঁর ভাষায়, “নির্বাচন হওয়া উচিৎ উন্নয়নের নিরিখে, খাদ্য-বস্ত্র-পানীয়-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-র অধিকারের উপর ভর করে।” তাঁর স্পষ্ট নীতি, ‘কাজ করলে পদে থাকুন, নইলে রাস্তা দেখুন’। নিজ সংগঠনে অনেকাংশেই সেই নীতি কার্যকর করেছেন তিনি। এখন অভিষেক চান সেই নীতি সরকার এবং প্রশাসনেও কার্যকর হোক। নইলে সময়ের কাজ সময়ে হবে না এবং মানুষের চাহিদাও সময় মতো মেটানো সম্ভব হবে না। এর ফলস্বরূপ বঙ্গবাসীর ভরসা এবং বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে তৃণমূল।

তবে এই জল্পনার মাঝে অভিষেকের স্বাস্থ্যের বিষয়টিও একেবারে উপেক্ষিত নয়। তাঁর চোখে সমস্যা রয়েছে। যার অস্ত্রোপচারের জন্যই বিদেশ যাবেন তিনি। সেই চিকিৎসাজনিত কারণেই তিনি সংগঠন থেকে সাময়িক বিরতি নেবেন বলে বুধবার সমাজমাধ্যমে জানিয়েছেন। তবে এই জল্পনা কি এমনি এমনিই তৈরি হল? তা কখনই নয়। অভিষেক নিজে বিরতির কথা জানাতেই টেনে এনেছেন একাধিক প্রসঙ্গ। নবজোয়ার যাত্রার সফলতা, জনসাধারণের হকের টাকা আদায়ে দিল্লিতে তৃণমূলের আন্দোলন, লক্ষ্মীর ভান্ডারের বরাদ্দ বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি নিজ পোস্টে। পাশাপাশি রাজ্য সরকার নিজ দায়িত্ব পালন করবে, সেই আশাও প্রকাশ করেছেন। এইখানেই অভিষেক-ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন, দলের অন্দরে জল্পনা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁরা সবচেয়ে জোর দিচ্ছেন সরকারের একাংশের কাজকর্ম নিয়ে শাসকদলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের ‘অভিযোগ, অনুযোগ এবং খেদ’-এর উপর।


অভিষেক-ঘনিষ্ঠ এক জনের বক্তব্য, “কিছু মন্ত্রী দফতরের কাজ মনিটর করেন না। কিছু আমলাও নিজেদের মতো চলেন। কাজ শুরু হলে তা কবে শেষ হবে, তার ঠিক থাকছে না। এই সংস্কৃতির বদল দরকার। এতে মানুষ বিরক্ত হচ্ছেন।” পাশাপাশি অভিষেকের ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন এক নেতার কথায়, “উনি (অভিষেক) মনে করেন, ২০২৬ সালে মুখ্যসচিব বা স্বরাষ্ট্রসচিব ভোট চাইতে যাবেন না। ভোট করতে হবে সংগঠনকেই। কিন্তু তৃণমূল যখন পরের বিধানসভা ভোটে যাবে, তখন দলের মাথায় থাকবে ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। এখন থেকে যদি সময় বেঁধে কাজ না করা হয়, তাহলে শুধুমাত্র সংগঠন দিয়ে বিধানসভার বৈতরণী পার করা অসম্ভব!” এখান থেকেই স্পষ্ট, দলীয় কিছু নেতৃত্বের কার্যকলাপেই অসন্তুষ্ট অভিষেক। সূত্রের খবর, মাস দুয়েকের বিরতিতে যাচ্ছেন অভিষেক। যা খুব বেশি সময় না হলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুব কম সময়ও নয়। যা থেকে স্পষ্ট, আগামী ১০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য রাজ্যের চারটি বিধানসভার উপনির্বাচনে অভিষেক যুক্ত থাকছেন না।

উল্লেখ্য, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও খুব খুশি নন তিনি। বিজেপি-কে পরাজিত করে ২৯টি আসনে তৃণমূল জিতলেও, শহুরে অঞ্চলে ভোট ব্যবধান কমে তৃণমূলের ভিত আলগা হয়েছে এবার। যার জন্য ভোট পরবর্তী পর্যালোচনা বৈঠক করে প্রাপ্ত রিপোর্টও খতিয়ে দেখার নির্দেশ তৃণমূল নেতৃত্বদের দেওয়া হয়েছে দলের উচ্চস্তর থেকে। দলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, “অভিষেক চান, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি মেটাতে। যে চাহিদার কথা তিনি অনুধাবন করেছিলেন গত বছর নবজোয়ার যাত্রার সময়। মানুষ তাঁকে সেই কথাগুলোই সরাসরি বলেছিলেন।” আর সেই চাহিদাগুলিই সঠিক সময়ে মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে তৃণমূল। তাই বিরক্ত হচ্ছেন অভিষেক, এমনই মত অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের। শাসদকদলের এক নেতার বক্তব্য, জেলায় জেলায় প্রশাসনিক সভায় থেকে অনেক কাজের ঘোষণা হয়। কিন্তু নবান্নের সেই নির্দেশ কতটা কার্যকর হল, স্থানীয় স্তরে তার খোঁজ রাখা হয় না। যে যে দফতরে শ্লথতা ছিল, এখনও সেই দফতরগুলিতেই সমস্যা রয়ে গিয়েছে। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-আমলারা নিজেদের পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তাঁদের জবাবদিহির কোনও বন্দোবস্ত নেই। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অভিষেকের এক্স বার্তার নির্যাস অত্যন্ত স্পষ্ট। এইবার প্রশ্ন উঠেছে, নবান্নে কি তবে কায়েম হবে ক্যামাক স্ট্রিটের দর্শন? তৎপরতা দেখা যাবে প্রশাসনিক কাজে? অভিষেক ‘বিরতি’ নিয়ে যেন সেই ইঙ্গিতই দিলেন।