‘কেন্দ্রের সরকার এক বছরেই বিদায় নেবে’, দাবি অভিষেকের

দলীয় পদ থেকে অধীরের বিদায়ের পরে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনায় আপত্তি নেই অভিষেকের

নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: “আগামী এক বছরের মধ্যে যে সব রাজ্যে নির্বাচন রয়েছে, বিজেপি সর্বত্র ধুয়ে মুছে যাবে,” জোরালো দাবি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু কেন? কিসের ভিত্তিতেই বা তিনি এমন দাবি করলেন? নিজ বক্তব্যের সাপেক্ষে যুক্তিও শুনিয়েছেন। উল্লেখ্য, বুধবার দিল্লির সাউথ অ‌্যাভিনিউতে দলীয় দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে দীর্ঘ ঘরোয়া আলাপচারিতায় জাতীয় রাজনীতি থেকে একের পর এক রেল দুর্ঘটনা, রাজ্য রাজনীতির একাধিক বিষয়ে মুখ খুলেছেন অভিষেক। পাশাপাশি বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনা ও বাংলা ভাগ প্রসঙ্গে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন বিজেপিকেও। অভিষেকের যুক্তি, “আমার ধারণা এই সরকার বেশিদিন চলতে পারে না। খুব বেশি হলে একবছর টিকবে। এ বছরেই যে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে, সবকটিতেই বিজেপি হারবে।

আবার আগামীদিনে অসম বাদে দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিতেও বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত।” তাঁর ভাষায়, “একবার হারের ঢল নামতে শুরু করলে বিজেপি-বিরোধী হাওয়া তৈরি হবে। মানুষের মন একবার তৈরি হয়ে গেলে তা বদলানো প্রায় অসম্ভব। গণতন্ত্রে মানুষের রায়ই গুরুত্বপূর্ণ। তখন রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির বহু বিধায়ক নৌকো ডুবে যাওয়ার আগাম আঁচ পেয়ে দল ছাড়বেন।” নবগঠিত এনডিএ সরকারের দুই শরিক নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর অতীত স্মরণ করিয়ে দিয়ে অভিষেকের স্পষ্ট দাবি, যাঁদের ভরসায় মোদী সরকার চলছে, তাঁদের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এর কারণ হিসেবে তৃণমূল সেনাপতির দাবি, “চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতীশ কুমার যে আগেও বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু তাই নয়, চন্দ্রবাবু সারা দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধীদের একজোট করার চেষ্টা পর্যন্তও করেছিলেন।”


পাশাপাশি অভিষেকের ইঙ্গিত, লোকসভা নির্বাচনের পরে বাংলায় বিজেপির অনেকেই তৃণমূলের দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছেন। বিচক্ষণী অভিষেকের ভাষায়, “যথাসময়ে এঁদের নাম জানতে পারবেন!” একশো দিনের কাজ, কেন্দ্রীয় আবাস যোজনায় বাংলায় দশ পয়সাও দেয়নি বিজেপি সরকার, এই অভিযোগে ইতিমধ্যেই লোকসভায় শ্বেতপত্রের দাবি জানিয়েছেন অভিষেক। এবার সাংবাদিকদের সাথে ঘরোয়া আলোচনায় তাঁর দাবি, চব্বিশের লোকসভায় বিজেপি মেরুকরণের প্রবল চেষ্টা করেও পশ্চিমবঙ্গে ব্যর্থ হয়েছে মূলত আবাস যোজনা এবং একশো দিনের কাজের বকেয়া টাকা না দেওয়ার জন্যই।

নির্বাচনে দলীয় হাতিয়ারের বিষয় খোলসা করে অভিষেক বলেন, “আমরা গ্রামীণ এলাকায় গিয়ে বাংলার বিরুদ্ধে কেন্দ্রের অর্থনৈতিক বঞ্চনা নিয়ে প্রচার করেছি। বিজেপির পাল্টা ভাষ্য মানুষের সামনে সফল ভাবে হাজির করতে পেরেছি। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে কেন্দ্রীয় আবাস যোজনায় টাকা দেওয়া হলেও আমাদের টাকা দেয়নি মোদীর সরকার, তা স্পষ্ট করা হয়েছে। ভোটে তার ফল দেখা গিয়েছে।”

তবে শুধু লোকসভা নির্বাচন নয়, ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের হাতিয়ার হবে কেন্দ্রীয় বঞ্চনা, যার আভাস পাওয়া গিয়েছে অভিষেকের বক্তব্যেই। তাঁর ভাষায়, কেন্দ্রকে ফের আবেদন করা হয়েছে। টাকা না দিলে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে রাজ্যের তরফ থেকে আবাসের টাকার প্রথম কিস্তি আবেদনকারীদের কাছে চলে যাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একশো দিনের কাজে ২১ লক্ষ মানুষের মজুরি অর্থাৎ সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা নিজেদের কোষাগার থেকেই দিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এই বিষয়টি পূর্বেই স্পষ্ট করা হয়েছিল বাংলার শাসকদলের তরফ থেকে। এবার আবাস বাবদ ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার মানুষের টাকাও বছরের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে রাজ্যই দেবে। স্বাভাবিক ভাবে, এর ফলে রাজ্যের কোষাগার তৈরী হবে চাপ। যার সমাধান বাতলে দিয়ে অভিষেক বলেন, এক্ষেত্রে রাজ্যের কোষাগারে বাড়তি চাপ কমাতে নতুন অর্থনৈতিক নীতি আনা হবে, যাতে রাজস্ব বাড়ে অথচ বাড়তি কর না চাপে। মনরেগায় ন্যূনতম পঞ্চাশ দিনের মজুরির প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।

প্রদেশ সভাপতির পদ থেকে অধীর চৌধুরীর বিদায়ের পরে কংগ্রেস যদি তৃণমূলের সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় বসতে চায়, তাতেও আপত্তি নেই অভিষেকের। নিজেই এই বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন যুবরাজ। পাশাপাশি ‘ইন্ডিয়া’ জোটে দলীয় অবস্থান জানিয়ে অভিষেক বলেন, কেন্দ্রে বিজেপিকে হটাতে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া যাতে ঐক্যবদ্ধ থাকে, সেজন্য তৃণমূল কংগ্রেস সক্রিয় থাকবে।

তবে তা কোনও নির্দিষ্ট দলের রাবার স্ট্যাম্প হয়ে নয়। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসকে নিয়ে ব্যক্তিগত আপত্তির কোনো জায়গা নেই তৃণমূলের। এ বিষয়টিই বুঝিয়ে অভিষেক বলেন, “ত্রিপুরা হোক বা গোয়া, আমরা এমন জায়গায় দলের সম্প্রসারণ করতে গিয়েছি যেখানে বিজেপি শক্তিশালী, কংগ্রেস নয়। আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক দিন আগেই সূত্র দিয়েছিলেন, যে বিরোধী দল যে রাজ্যে শক্তিশালী, তার পিছনে দাঁড়াক অন্যান্য বিরোধী দলেরা। সেই হিসাবে আমরা কোনও রাজ্যে গিয়ে কংগ্রেসকে দুর্বল করার কথা ভাবিনি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আমাদের জোট প্রস্তাব কংগ্রেসের মানা উচিত ছিল।”

উল্লেখ্য, রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সংঘাতের রাজনীতি চললেও কেন্দ্রে ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় শরিক কংগ্রেসই। এই পরিস্থিতিকে নিজ আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করে অভিষেক বলেন, “অন্য সব জোট শরিকেরা কোনও না কোনও রাজ্যে কংগ্রেসের শরিক। একমাত্র আমরা কংগ্রেস, বিজেপি এবং বাম, এই তিন শক্তির সঙ্গেই লড়াই করেছি। কংগ্রেসকে বারবার জোটের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে আসন (দুটি) দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছি। কংগ্রেস তা গ্রাহ্য করেনি। তবে কেন্দ্রে আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে বিজেপিকে হারানোর জন্য লড়াই আরও জোরদার করব।”

অভিষেক কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণকে শ্বেতপত্র প্রকাশের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী তৃণমূলের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন বলে পাল্টা মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গ তুলে মন্ত্রীকে তুলোধোনা করেন অভিষেক। তিনি বলেন, “এসব বড় বড় কথা না বলে বাংলায় হারার পরে কি টাকা দিয়েছে সেই শ্বেতপত্রটা প্রকাশ করুক। আর দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে গেল তো আগে হিমন্ত বিশ্বশর্মা, অজিত পাওয়ার, শুভেন্দু অধিকারী, নারায়ণ রাণেদের সামনে এনে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে বিজেপিকে!” অভিষেকের আরও সংযোজন, “ভুঁয়ো জব কার্ডে তো উত্তরপ্রদেশ এক নম্বরে, তারা কী করে টাকা পাচ্ছে? আর আবাসে তো বিজেপির বিধায়কের স্ত্রীর নাম ছিল, আমরা কেটে দিয়েছি। বিজেপি কি দলগতভাবে কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে?”