• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 October, 2024

২১ জুলাই একটি আবেগ:  সেদিন এবং আজ

দেবাশিস দাস দিনটা ছিল ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন যুব কংগ্রেসের সভাপতি৷ তখনও তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়নি৷ সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে হাজার হাজার যুব কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক যোগ দিয়েছিল মহাকরণ অভিযানে৷ তাঁদের দাবি ছিল, ভোটার পরিচয়ত্রকেই ভোট দেওয়ার জন্য একমাত্র নথি হিসেবে গণ্য করতে হবে৷ তখনই নির্বাচনে সিপিএমের ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’ বন্ধ করা যাবে৷ যুব

দেবাশিস দাস

দিনটা ছিল ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন যুব কংগ্রেসের সভাপতি৷ তখনও তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়নি৷ সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে হাজার হাজার যুব কংগ্রেস কর্মী-সমর্থক যোগ দিয়েছিল মহাকরণ অভিযানে৷ তাঁদের দাবি ছিল, ভোটার পরিচয়ত্রকেই ভোট দেওয়ার জন্য একমাত্র নথি হিসেবে গণ্য করতে হবে৷ তখনই নির্বাচনে সিপিএমের ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’ বন্ধ করা যাবে৷ যুব কংগ্রেসের সেই অভিযানে সেদিন পুলিশ গুলি চালিয়েছিল৷ ফলস্বরূপ মৃতু্য হয়েছিল ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর৷

সেদিনের সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের কাছ থেকে জানা যায়, বিপুল সংখ্যক যুব কংগ্রেস সমর্থক হাওড়া স্টেশন থেকে ব্রেবোর্ন রোড ধরে মিছিল করে যাচ্ছিলেন মহাকরণের দিকে৷ টি-বোর্ডের অফিসের কাছে পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়৷ তাঁরা পুলিশের কর্ডন ভেঙে এগোনোর চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাসের সেল চার্জ করে৷ মিছিলের জনতা তাতে পিছু হঠতে বাধ্য হলেও, ছত্রভঙ্গ হয় না৷ তাঁরা টি বোর্ড এবং ক্যানিং স্ট্রিটের ক্রসিংয়ের মাঝখানে ছোট রাস্তায় বা গলিতে আশ্রয় নেন৷ পুলিশ তাঁদের তাড়া করে গলিতে ঢুকে পড়ে৷

সেখানে দু’পক্ষের পাথর ছোঁড়াছুঁড়িতে এক পুলিশকর্মী আহত হন৷ তাঁর মাথা থেকে রক্ত ঝরতে দেখা যায়৷ তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে তখন বেপরোয়া হয়ে ওঠে পুলিশ৷ ইতিমধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন পৌঁছে গেছেন টি-বোর্ডের ক্রসিংয়ে৷ তাঁর সঙ্গে যুব কংগ্রেসের আরও কয়েকজন নেতাও রয়েছেন৷ বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ট্রাফিক পুলিশের পোস্টের উপর উঠে দাঁড়ান৷ এদিকে পুলিশ লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে চাইছে৷ যুব কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রেখেছেন, পুলিশ যাতে তাঁকে আক্রমণ করতে না পারে৷ ততক্ষণে সৌগত রায় সহ অন্য নেতাদের উপর বেধড়ক লাঠি চালিয়েছে পুলিশ৷

পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে, মিছিল করে সমর্থকরা বিভিন্ন দিক থেকে গিয়ে মহাকরণ ঘেরাও করবে৷ এদিকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি কিছুতেই মহাকরণকে যুব কংগ্রেস কর্মীদের দখলে যেতে দেবেন না৷ এদিকে মিশন রো থেকে, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে এবং আরও অন্যান্য দিক থেকে হাজার হাজার যুবকর্মীদের মিছিল তখন মহাকরণের দিকে আসছে৷ মেয়ো রোড ধরেও আসছিল একটি বড় মিছিল৷ মেয়ো রোড এবং রেড রোডের ক্রসিংয়ে পুলিশ তাদের আটকে দেয়৷ সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল৷ পুলিশ তাদের উপর লাঠিচার্জ করতে থাকে৷ ভিড় ছত্রভঙ্গ হতে শুরু হলেও, শয়ে শয়ে লোক দৌড়তে থাকে কার্জন পার্কের দিকে৷ বোমাবাজি হয় বলেও অভিযোগ৷ তাদের াটকাতে আচমকাই পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে৷ পুলিশ পাল্টা প্ররোচনার অভিযোগ এনেছিল যদিও, কিন্ত্ত সেই গুলিতে মারা যান ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী৷ ব্রেবোর্ন রোডে ধাক্কাধাক্কি ও কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন মমতা৷

সেই ‘শহিদ’ কর্মীরা হলেন, মুরারি চক্রবর্তী, রতন মণ্ডল, বন্দনা দাস, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম দাস, বিশ্বনাথ রায়, শ্রীকান্ত শর্মা, কেশব বৈরাগী, মহম্মদ খালেক, ইনু, দিলীপ দাস, রঞ্জিত দাস ও প্রদীপ দাস৷ এই ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর মৃতু্যতে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজ্যের রাজনীতি৷ তবে কার নির্দেশে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ, সে প্রশ্নের আজও কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি৷ সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ পরবর্তীকালে সিবিআই-এর তদন্ত হলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ক্লিনচিট দেয় সিবিআই৷ উল্লেখ্য, তখনকার স্বরাষ্ট্রসচিব মনীশ গুপ্ত পরে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন এবং যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সাংসদ হন৷

যাই হোক, ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই এই ঘটনার পর থেকে প্রতি বছর দিনটিকে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস৷ পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ তেকেই বিপুল জনসমাবেশের মধ্যে দিয়ে এই দিনটিকে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে৷ তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠায় এই দিনের সভা সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে৷

এই দিনটির আরও একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা৷ কংগ্রেস নেত্রী মমতা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা, তারপর মুখ্যমন্ত্রী মমতা৷ মমতার এই উত্থানের পিছনে এই দিনটির একটি বি‌েএশষ গুরুত্ব আছে৷ ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একাই মমতা৷ আর এদিনের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির পর কার্যত পৃথক আন্দোলনের কথা তুলতে শুরু করেন তিনি৷ ডাক দেন ‘পরিচ্ছন্ন কংগ্রেস’ গড়ে তোলার৷ তাই অনেকেই মনে করেন, ২১ জুলাইয়ের মধ্যেই কি তাহলে লুকিয়ে ছিল তৃণমূল তৈরির বীজ!

পরবর্তীকালে রাজ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে পৃথক পরিচয় লাভ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ এমনকি শ্রমজীবী তৃণমূল স্তরের মানুষের মনেও জায়গা করে নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস৷ ২১ জুলাই দিনটিতে শহিদ তর্পণের পাশাপাশি দলনেত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শোনার জন্যও উৎসুক থাকে সমগ্র রাজ্য এমনকি দেশও৷ কারণ এই মঞ্চ তেকেই মমতা বারবার তাঁর নানান পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন, ঘোষণা করেছেন৷ এবারেও তিনি কী বলেন, এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা থাকবে সকলেরই৷

মাত্র মাস দেড়েক আগে লোকসভা নির্বাচনের ফলে তৃণমূল বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে৷ তারা পেয়েছে ২৯টি আসন আর বিজেপি নেমে গেছে ১২টি আসনে৷ কিন্ত্ত ফল প্রকাশের পর তৃণমূল কংগ্রেস কোনও বিজয় উৎসব করেনি৷ এছাড়া অতি সম্প্রতি রাজ্যের বিধানসভার চারটি আসনের উপনির্বাচনে চারটি আসনই দখল করেছে তৃণমূল৷ আগের বিজেপির তিনটি জেতা আসন এবার ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল৷ এই জয়ও তৃণমূলের পক্ষে যথেষ্ট শ্লাঘার বিষয়৷ তৃণমূলের প্রতিপক্ষ বিজেপির উপর রাজ্যের মানুষের ভরসা ততখানি নয়, যতটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর৷ সব মিলিয়ে তৃণমূলের পক্ষে বিজয় উৎসব করার যথেষ্ট কারণ ছিল৷

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিক থেকে যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিয়েছেন৷ নির্বাচনের এই সাফল্যে তিনি আত্মসন্ত্তষ্টিতে ভুগছেন না৷ বিগত কয়েকটি প্রশাসনিক বৈঠকে সে বার্তা তিনি দিয়েছেন৷ াগামী দিনে দলকে তিনি আরও সুসংহত, শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং জনমুখী হওয়ার বার্তা ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে৷ সেই সঙ্গে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং দুর্নীতি থেকে দলকে দূরে থাকারও নির্দেশ নিশ্চয়ই তিনি দেবেন৷ এছাড়াও, বছর দুয়েক বাদেই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন৷ বর্তমান সাফল্যকে ধরে রাখতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের জন্য দলকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশও যে তিনি দেবেন, তা অনুমান করা যায়৷

তিনি খুব স্পষ্টভাবেই ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, কোনওরকম অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা চলবে না এবং সারা বছরই মানুষের পাশে থেকে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে দলের নেতা-কর্মীদের৷ যেসব নেতা-কর্মী নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে দলকে ব্যবহার করবেন, তাঁদের দল থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধা করবেন না, সে বার্তা তিনি ইতিমধ্যে দিয়ে থাকলেও, সে ব্যাপারে আরও নির্দিষ্ট করেই হয়তো বলবেন৷ এবারের লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচনের জয়ের সাফল্য তিনি এই মঞ্চ থেকে উৎসর্গ করবেন রাজ্যের মা-মাটি-মানুষকে এবং ২০২৬-এর নির্বাচনের প্রস্ত্ততির নির্দেশ দেবেন৷

এবার ২১ জুলাই রবিবার৷ ছুটির দিনে এই সমাবেশে তৃণমূল কর্মী ও সমর্থকদের উপস্থিতি যাতে সুপর্যাপ্ত হয়, তার প্রস্ত্ততি দেখা গেছে তৃণমূল স্তরে৷ উত্তরবঙ্গ থেকেও এবার যথেষ্ট লোকজন আসবেন, আশা করা যাচ্ছে৷ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর চোখের চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন, ২১ জুলাইয়ের আগে তিনি ফিরতে পারবেন কিনা, এ বিষয়ে কিছুটা সংশয় থাকলেও, তিনি ফিরে এসেছেন এবং এই সমাবেশে তিনিও যে যুব সমাজকে উদ্দীপ্ত করবেন, তা বলাই বাহুল্য৷

সমাবেশ স্থলেই শুধু নয়, সারা কলকাতা শহর জুড়েই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকছে৷ ড্রোনেও চলবে নজরদারি৷ ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে মূল মঞ্চের মাপ ৫২/২৮ ফুট৷ এছাড়া আরও দুটি মঞ্চ হয়েছে মূল মঞ্চের পাশেই৷ তার মধ্যে একটি মঞ্চ ৪৮/২৪ ফুট এবং অন্যটি ২০/২৪ ফুট৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চের যেখান থেকে বক্তৃতা দেবেন, পোডিয়াম রাখা সেই জায়গাটি কিছুটা বিস্তৃত রাখা হয়েছে৷ এদিন বৃষ্টি হলেও সমাবেশে আগত মানুষদের যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সেদিকে বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছে৷

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ’২১ জুলাই আমি হারিয়েছিলাম আমার ১৩জন সহযোদ্ধাকে৷ তাই ২১ জুলাই আমার কাছে, আমাদের কাছে একটা আবেগ৷ ২১ জুলাই আজ বাংলায় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অন্তরঙ্গ অংশ৷’