সপ্তদশ লােকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপির অভাবনীয় সাফল্য ঘিরে সর্বস্তরে আলাপ-আলােচনা শুরু হয়েছে। একটা বড় অংশের মানুষের ধারণা, বামপন্থীদের ভােটের একটা বড় অংশ রামপন্থীদের দিকে ঝুকেছে। তাই রামপন্থীদের এই সাফল্য। আপাতদৃষ্টিতে শতাংশের হিসেবে বামপন্থীদের ভােটের হার যেভাবে কমেছে। তাতে প্রাথমিকভাবে এই ধারণায় শীলমােহর লাগানাের চেষ্টা হলেও গোটা বিষয়টি আমাদের একটু গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।
প্রথম প্রশ্ন হল, এই লােকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত আগেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে ৪২-এ ৪২টি আসনের দাবি করেছিলেন, সেই দাবি ঘিরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ কতটা রক্ষিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের ধারাবাহিকতা কতটা এ রাজ্যে বজায় থেকেছে, এই প্রশ্নটা প্রথমেই তুলতে হয়। কোনও রাজ্যের শাসক যদি প্রকাশ্যে সবকটি আসনেই তাঁরা জিতবেন বলে দাবি করেন, তাহলে গণতন্ত্রের হালহকিকত নিয়ে প্রথমেই একটা তীব্র প্রশ্ন থেকে যায়।
প্রত্যেক রাজনৈতিক দল চান তাঁরা। সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করুন, কিন্তু সেই সর্বোচ্চ সাফল্য মানেটা এই নয় যে, সেখানে অন্য কোনও বিরােধী দল থাকবে না। ৪২ এ ৪২টি আসন দাবির ভেতর দিয়ে অন্য কোনও বিরোধী দল না থাকার যে ভয়াবহ দাবিটি প্রচ্ছন্নভাবে ধ্বনিত হয়েছিল, সেই পানির ভেতর দিয়েই কিন্তু প্রতিধ্বনিত হয়েছে সদ্যসমাপ্ত লােকসভা নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের আসন সংখ্যা উল্লেখযােগ্যভাবে কমে যাওয়া এবং কেন্দ্রের শাসক দলের আসন সংখ্যা বৃদ্ধির প্রাথমিক প্রবণতার বিষয়টি।
তার পাশাপাশি উঠে আসে বামপন্থীদের ভােটের হার কমে যাওয়া এবং একটি আসন না পাওয়ার বিষয়টি। বস্তুত গত আটি বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে এ রাজ্যের শাসকদল বিরােধীশূন্য রাজনীতি করতে চেয়েছে। এ রাজ্যের বর্তমান শাসকেরা যখন ২০১১-তে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন প্রধান বিরােধী ছিল বামেরা। সেই বামেদের যে কোনও কৌশলে প্রধান বিরােধীর জায়গা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যে ধরনের অনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক উদ্যোগ এ রাজ্যের শাসকদের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে, তার জেরে খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতা হারানাে বামেরা তাঁদের সাংগঠনিক দিকগুলিকে আর আগের মতাে শক্তপােক্তভাবে বজায় রাখতে পারেননি। একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, বাম শাসনের শেষের দিকে বেশ কয়েক বছর বামেদের সংগঠনের একটা বড় রকমের বাড়বাড়ন্তের পেছনে সব থেকে বড় কারণ ছিল এই যে, বামেরা প্রশাসনে আছেন, পুলিশ তাঁদের হাতের মুঠোয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্ত রকমে অলিগলিতে তাঁদের অবাধ বিচরণ।
তাই বামেদের সঙ্গে একটা বিরাট সংখ্যক ‘লােক’, হ্যা এদেরকে ‘লােক’ বলেই উল্লেখ করলাম, ‘মানুষ’ বললাম না, কারণ বামের রাজ্যপাট থেকে সরে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই লােকেরা জার্সি বদল করে বর্তমান শাসকদলে ভিড়ে যেতে দেরি করেনি। এই প্রবণতার ভেতর দিয়ে ২০১১-তে অক্ষমতা হারানাের পর থেকেই বামের সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল যে, এই দুর্বলতাকে ভয়ঙ্কররকমভাবে ইন্ধন জুগিয়ে নিজেদের দল ভারী করার খেলায় রাজ্যের শাসকরা নেমে পড়েন। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালে কিন্তু এভাবে বিরোধী দল ভাঙিয়ে শাসক দল ভারী করার প্রবণতা আদৌ দেখতে পাওয়া যায়নি।
তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবার পরেই তাঁরা প্রধান টার্গেট করে বামপন্থী দলগুলিকে। বামপন্থী দলগুলির ভিতরে দীর্ঘদিন মতাদর্শগত চর্চার সম্যক অভাবের দরুণ একটা বড় অংশের কর্মী-সমর্থক, যারা সবসময়ই ‘শাসক’ হয়ে থাকতে চান শাসকের হয়ে গলা তুলতে চান, শাসকের হয়ে পাড়া থেকে মহল্লা সর্বত্রই নিজেদের দাপট বজায় রাখতে চান, তাঁরা খুব সহজেই ভিড়ে যায় নতুন শাসকদের সঙ্গে। কর্মীদের প্রবণতার পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নানা কৌশলে রাজ্যের শাসকেরা নিজেদের দিকে ভেড়াতে শুরু করেন।
রাজ্যের শাসকেরা বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে নেতাকর্মী, সমর্থক থেকে শুরু করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিজেদের দিকে ভেড়ানাের প্রবণতা তৈরি করেন, সেই প্রবণতার জেরে বিরােধীশুন্য রাজনীতির মানসিকতা নিয়ে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করতে শুরু করেছিলেন। সেই প্রবণতা আরও প্রলম্বিত হয় তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে যে দুটি পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং পুরসভার যে নির্বাচনগুলি হয় সেই নির্বাচনগুলির ভিতর দিয়ে।
স্থানীয় প্রশাসনের এইসব নির্বাচনগুলিতে কার্যত বিরােধী দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে রাখা হয় রাজ্যের শাসক দলের উদ্যোগে। তার ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া গ্রামীণ বাংলায় পড়ে। গ্রামের মানুষের একটা অংশ যারা সরাসরি জান কবুল করে বামপন্থী রাজনীতি করে চলেছেন, তাঁদের রাজনৈতিকভাবে পাদস্তা করতে রাজ্যের শাসক দল আইনি, প্রশাসনিক, নানা ধরনের হেনস্থা ঘটাতে শুরু করে। দুর্ভাগ্যজনক হল ভুমিস্তরের নিজেদের কর্মীসমর্থকদের একাংশের শাসকের হাতে ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হওয়া সত্ত্বেও উচ্চস্তরের বামপন্থী নেতৃত্ব সবসময় তাঁদের ভূমিস্তরের এইসব নেতাদের পাশে জান কবুল করে দাঁড়াতে পারেননি।
হয়ত কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা শহর থেকে কনভয় ছটিয়ে নেতারা এসেছে, ছবি তুলেছেন, সেই ছবি ফেসবুকের পাতায় ভরে গেছে, খবরের কাগজের পাতায় সেই ছবি ঠাই পেয়েছে কিন্তু তারপর সেই দলীয় কর্মীর পাশে থাকার যে ধারাবাহিক প্রবণতা দরকার ছিল, সেই প্রবণতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রক্ষিত হয়নি। ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেই শুন্যতাকে নানাভাবে আরএসএস তার নানা ধরনের তথাকথিত সামাজিক সংগঠনের ভেতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে পায়ের তলায় জমি করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
বিশেষ করে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় নদিয়া, পুরুলিয়া, বীরভূম ইত্যাদি জোলাগুলিতে একেবারে ভুমিস্তরে বামেদের নানা ধরনের সাংগঠনিক দুর্বলতা সত্ত্বেও শাসকদলের ভয়াবহ আত্যাচারকে উপেক্ষা করে যে সমস্ত বামপন্থী নেতাকর্মী ভূমিস্তরে কাজ করছেন তাঁদেরকে মামলা মােকদ্দমা, জেল, পুলিশ ইত্যাদিতে ফাঁসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রাজ্যের শাসক দল ভয়াবহ আকারে দেখিয়েছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে সরাসরি লড়াই করবার মতো জায়গায় বামপন্থীরা থাকতে পারেননি।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল যে, বেশিরভাগ ক্ষত্রেই একেবারে মাটি কামড়ে লড়াই করা নিজেদের সেইসব কর্মী-সমর্থকদের পাশে জেলা বা রাজ্যস্তরের বামপন্থী নেতৃত্ব ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দাঁড়াননি। তাঁরা হয়ত এই কর্মী-সমর্থকদের একাংশের কাছে এসেছেন, দেখেছে, তাদের দলের ফেসবুক করা কর্মী-সমর্থকরা এটাকেই বামপন্থীদের জান কবুল লড়াই বলে ফেসবুকে ছবি পোস্ট দিয়েছেন, কিন্তু এইসব আক্রান্তদের পাশে দিনরাত থাকেনি।
অতীতে চার, পাঁচ, ছয়, সাতের দশকে বামপন্থী নেতাকর্মীরা তাঁদের ভূমিস্তরের কর্মীদের পাশে এসে দাঁড়াতেন, সেভাবে আজকের নেতৃত্বের বেশিরভাগটাই দাড়াননি। ফলে একটা ভয়ানক শূন্যতা, হতাশা, মানসিক বিষাদ একেবারে ভূমিত্তরের বামপন্থী কর্মীদের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি হতে শুরু করে দিয়েছিল। নিজেদের ভূমিস্তবের এইসব জান কবুল কর্মী-সমর্থকদের মনােবেদনার বিষয়টি জেলাস্তরের বা রাজ্যস্তরে নেতাদের কর্ণকুহরে কতটা পৌঁছেছিল তা রীতিমতাে গবেষণার বিষয়।
পৃথিবীতে যেমন কখনই কোনও শূন্যস্থান থাকে না, তেমনি রাজনীতিতেও কখনও কোনও শূন্যস্থান থাকে না। রাজ্যের শাসক দল বিরোধীশুন্য রাজনীতির প্রচলন করার তাগিদে বামপন্থীদের খতম করার উদ্যোগে একাংশের বাম নেতা-কর্মী – সমর্থক সহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিজেদের দলে ভেড়ানাের দরুণ সদর মফসসলে রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হল, সেই শূন্যতাকে পূরণ করতে কিন্তু বিজেপি সরকার এগিয়ে আসেনি। এগিয়ে এসেছে আরএসএস তাদের হাজারাে রকমের সামাজিক সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে। রাজ্যের শাসক শিবির কিন্তু গোটা রাজ্যজুড়ে আরএসএসের এই বাড়বাড়ন্ত নিয়ে হিমশীতল নীরবতা পালন করে গেছে। সংঘের মুল লক্ষ্য কিন্তু নিজেদের এই সমস্ত সামাজিক সংগঠনের ভেতর দিয়ে একটা সামাজিক ভিত্তি তৈরি করে সাধারণ মানুষের ভেতরে একটা বিশ্বাসযােগ্যতার পরিবেশ তৈরি করা।
সেই পরিবেশ তৈরির ভেতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে পায়ের তলায় জমি তৈরি করে দেওয়াই ছিল আরএসএসের একমাত্র লক্ষ্য। বস্তুত রাজ্যের শাসক দল বিরোধীশূন্য রাজনীতি করবার যে ভয়াবহ প্রবণতা তৈরি করল এবং সেই প্রবণতার জেরে বামপন্থীদের সবরকমভাবে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাল তাদের সেই প্রচেষ্টার সুযোগ নিয়েই কিন্তু ঘােরতর হিদ সাম্প্রদায়িক বাজনৈতিক হিন্দু মােলবাদী সংগঠন আরএসএস তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের ভেতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে রাজ্যের আনাচেকানাচে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযােগ্য করে তুলল।
রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের তৈরি হওয়া ক্ষোভকে এভাবেই নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমেই উদঘাটনের একটি জায়গা হিসেবে মেলে ধরল আরএসএস। বিরােধীশূন্য রাজনীতি করার তাগিদ থেকে রাজ্যের শাসক দল যখন বাম-রাম কোনও দলকেই রাজনৈতিকভাবে মাথা তুলতে দেয়নি তখন কিন্তু বিজেপি তাদের মূল চালিকাশক্তি আরএসএসের ‘সামাজিক প্রযুক্তি’, যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা ‘সােশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বলে থাকেন, তার ভেতর দিয়ে নানা ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।
এমনকী বহু ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসকদের হাতে আক্রান্ত ভূমিরের বামপন্থী নেতাকর্মীদের পাশেও আরএসএসের এইসব হরেকরকমের সামাজিক সংগঠন কোনওরকম ব্যানার ছাড়া পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের আইনি পরিষেবা দিয়েছে, বিশেষ করে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় রাজ্যের নানা জেলায় সম্মিলিত বিরােধীরা, তাঁদের ভিতরে কংগ্রেস থেকে বামফ্রন্টের অনেক দলেরই কর্মসমর্থকেরা দলীয় নেতৃত্বের আদেশের তােয়াক্কা না করে, একদম ভূমিস্তরে কোনওরকম দলীয় পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার, প্রতীক ছাড়াই কার্যত রাজ্যের শাসকদলের নানা ধরনের সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচবার তাগিদে বামপন্থীদের সঙ্গে একটা অলিখিত বােঝাপড়া করতে বাধ্য হয়েছে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে এ জিনিসটা আমি নদিয়া এবং পুরুলিয়া জেলায় খুব বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলাম। যেসব বামপন্থীরা একেবারে ভূমিস্তরে থেকে লড়াই করছেন, তাঁরা যে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাল-হকিকত সম্বন্ধে সম্যকভাবে ধ্যানধারণা নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই ব্যানার ফেস্টুন ছাড়া বিজেপির সঙ্গে অলিখিত বােঝাপড়া করেছিলেন এমনটা কিন্তু নয়। একদম বাঁচবার তাগিদ থেকেই এটা তাঁরা করেছিলেন। জীবন-জীবিকার তাগিদ থেকে তাঁরা এটা করেছিলেন।
সেই সময়ের গ্রামবাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিরােধী দলগুলির উপরে যে ভয়াবহ শাসকের অত্যাচার চলেছিল, তাতে একদম ভুমিত্তরে নিজেদের কর্মীসমর্থকদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ানাের ক্ষেত্রে বামপন্থীরা যথােচিত দায়িত্ববােধের পরিচয় রাখতে পারেননি- বেদনাদায়ক হলেও এই বাস্তবতাকে স্বীকার করতেই হয়। তাঁদের এই দুর্বলতা সুযােগটি কিন্তু আরএসএস তাদের নানা ধরনের শাখা সংগঠনগুলির সাহায্য নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির প্রতি ব্যবহার করেছে।
মাত্র এক বছর আগে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এই যে সামাজিক-রাজনৈতিক একটা আঙ্গিক তৈরি হয়েছিল, সেই আঙ্গিককেই গত এক বছর ধরে আরএসএস তাদের নানা ধরনের সামাজিক প্রযুক্তির ভেতর দিয়ে অত্যন্ত সযত্নে লালনপালন করে সদ্যসমাপ্ত লােকসভা নির্বাচনে নিজেদের ঘরে ফসল তুলেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, বামপন্থীরা বড় বড় মিছিল করেছেন, জাঠা করেছেন, ব্রিগেড সমাবেশ সুনির্দিষ্ট ভােটব্যাঙ্ক অক্ষুন্ন করেছেন। সেই সমাবেশে উল্লেখযােগ্যভাবে ভিড় হয়েছে। এইসব মিটিং-মিছিল জমায়েতে আসা সহযােদ্ধারা একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার পরে শাসকের ভয়াবহ অত্যাচারের মুখে পড়ে কীভাবে বুঝবেন, তার কোনও ব্লু-প্রিন্ট কিন্তু বামেদের রাজ্য থেকে শুরু করে জেলা নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেননি। ফলে মিটিংয়ে মিছিলে ভিড় ফেসবুকের পাতাতেই, টুইটারের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।
নির্বাচনী সংগ্রামে নিজেদের নিবিড় সামাজিক কর্মকাণ্ডের যে ফসল আরএসএস তুলে দিয়েছে নিজেদের রাজনৈতি সংগঠন বিজেপির ঘরে তার পাল্টা সামাজিক সংগঠন বামেদের ছিল না। ফলে রাজ্যের শাসকদের বিরােধীনাশের প্রত্যক্ষ কর্মসূচিতে সবথেকে বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে বামেদের।
এবারের নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে একটা কথা বারবার উঠে আসছে, সেটি হল, বাম ভােট রামে যাওয়ার প্রসঙ্গ। এখানে একটা কথা খুব জোরের সঙ্গে বলা দরকার যে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ভােট থাকে, যাকে কমিটেড ভােট বলা হয়। এই কমিটেড ভােটের অংশটি কিন্তু খুব বেশি নয়। এটি একেবারে দলীয় সদস্য, গোঁড়া সমর্থক এবং তাঁদের খুব সুনির্দিষ্ট বন্ধুবান্ধব পরিবার-পরিজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
তার বাইরে যে ব্যাপক ভােটার থাকেন, সেই ভোটাররা কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের কেনা গােলাম নন। তাই যদি হত তাহলে ‘৬২ সালের বিধানসভার নির্বাচনে বিধান রায়ের প্রতি ব্যাপক সমর্থনকারী ভােটার, যাদেরকে সেই সময় কংগ্রেস মনে করত ‘কংগ্রেসের ভােটব্যাঙ্ক’, তারাই ‘৬৭ সালে সেই কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করত না, কিংবা পরবর্তীকালে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নির্বাচনে যতই জল মেশানাে থাকুক না কেন, তখনও যে নির্দিষ্টভাবে কংগ্রেসের একদম পকেট ভােট ছিল, সেই পকেট ভােট ধীরে ধীরে বামপন্থী ভােটে পর্যবসিত হত না। সেই বামপন্থী ভােটও কিন্তু চিরদিন বামপন্থীদের পৈতৃক সম্পত্তি থাকেনি।
বাম ভােট বলে শব্দটি ব্যবহার করে বিরােধীশূন্য রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করবার ভয়াবহ প্রবণতা থেকে আজকে পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় রাজনীতিতে বিজেপিকে যে একটা উল্লেখযােগ্য জায়গা করে দেওয়া হল সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করবার একটা প্রবণতা দেখা দিচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এটা অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় বলতে হয় যে, কোনও ভােট কোনও রাজনৈতিক দলের যদি চিরসঙ্গী হত, তাহলে কোনও রাজনৈতিক দলই কোনওদিন হারত না। বামপন্থীরাও ২০১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হতেন না।
যে বাম ভোটার দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বামপন্থীদের জিতিয়ে এসেছিলেন, সেই ভোটারই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর দলকে জিতিয়েছে। আজ সেই ভােটারই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি বিমুখ হয়ে একটা ভয়াবহ প্রতিষ্ঠান বিরােধিতার জেরে সাম্প্রদায়িক বিজেপির তৈরি করা বিভাজনে রাজনীতি এবং তার পাশাপাশি রাজ্যের শাসকদের তৈরি করা প্রতিযােগিতামূলক বিভাজনের মুখে দাঁড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে বেছে নিতেন না।
বস্তুত গণতন্ত্রে বিরােধীশূন্য রাজনীতির ভাবনাটাই ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। এই প্রবণতা একদিন হিটলারের ছিল। বস্তুত সেই প্রবণতার জেরেই হিটলার ধ্বংস হয়েছিলেন। বামফ্রন্টের ভরা জোয়ারে যখন একটা বড় অংশের মানুষ, বিশেষ করে যুবসমাজ তাঁদের পাশে ছিলেন, সেই সময় বামপন্থীরা যদি মনে করতেন ‘বিরােধীশূন্য রাজনীতি’ হবে, লােকসভায় রাজ্য থেকে ৪২-এ ৪২টা আসন তাঁরা পাবেন, আর বিধানসভায় ২৯৪-এর মধ্যে ২৯৪টিই তাঁরা পানে, তাহলে দীর্ঘদিন ধরে এ রাজ্যে বামপন্থী শাসনে কংগ্রেসের একটা সুনির্দিষ্ট ভােটব্যাঙ্ক অক্ষুন্ন থাকত না।
সর্বোপরি বলতে হয় এ কথা, আজ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা লড়াকু বিরােধী নেত্রী থেকে রাজ্যে প্রশাসক হিসেবে পেয়েছি তাও সম্ভব হত না। জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা,অভিজ্ঞতা, মননশীলতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা সর্বোপরি সবাইকে নিয়ে চলবার একটা অসাধারণ দক্ষতা– তার জেরে চড়াই-উৎরাই সত্ত্বেও এরাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষিত হয়েছিল। বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিরােধীরা গলা তুলে রাজনীতি করতে পেরেছিলেন। আশি সালের পর থেকে আমৃত্যু বামপন্থীদের ভরা বাজারেও গণিখান চৌধুরীর মতাে মানুষ এ রাজ্য থেকে জিততেন।
এই সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিযােগিতার পরিবেশটিকে গত ৮ বছরে পুলিশ আর প্রশাসন, বিচারব্যবস্থার সুযােগ নিয়ে এ রাজ্যের শাসক এমন একটা অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন, যার জেরে আরএসএস-বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আদর্শগত তাগিদকে অনুসরণ করার থেকেও অনেক বেশি এই দমবন্ধকর অবস্থা থেকে বাঁচবার তাগিদে একটা বড় অংশের মানুষ গরম তাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে গরম কড়াইতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।