কী প্রেমে, কী সাহিত্যে, তিনি ছিলেন গভীর আত্মপ্রত্যয়ী

বুদ্ধদেব বসুর ৫০তম মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে

গত শতকে বিশের দশক থেকে যে তরুণ কবি-লেখকরা রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসু তাঁদের অন্যতম৷ আধুনিক বাংলা কবিতার যাত্রাপথে তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকা এক উজ্জ্বল মাইল ফলক৷ তাঁর মৃতু্যর ৫০তম বছরে এই বৈচিত্রময় সাহিত্যব্রতীকে নিয়ে লিখেছেন অন্বেষা বসুরায়

বুদ্ধদেবের জন্মের ২৪ ঘণ্টা পরই তাঁর মা বিনয়কুমারীর মাত্র ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কারে মৃতু্য হয়৷ তাঁর বাবা ভূদেব বসু ছিলেন আইনজীবী৷ স্ত্রীর অকালমৃতু্যতে তিনি এতটাই শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে তিনি পরিবার ত্যাগ করে চলে যান৷


বুদ্ধদেব বসুর জন্ম ১৯০৮ সালের ৩০ নভেম্বর কুমিল্লায়৷ তাঁর দাদু অর্থাৎ মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার৷ এই দাদু ও দিদিমা স্বর্ণলতার কাছে প্রতিপালিত হন বালক বুদ্ধদেব৷ শৈশব থেকে তাঁর যৌবনের প্রথম ভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালি ও ঢাকায়৷ বুদ্ধদেব বরাবরই ছিলেন মেধাবী ছাত্র৷ ১৯৩১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করেন৷ ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় তিনি ‘বাসন্তিকা’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন৷

ইতিমধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দাদুর মৃতু্য হলে দিদিমার সঙ্গে তিনি তখন থাকতেন ঢাকার পুরানা পল্টনে৷ এক টুকরো টিনের বাড়ি৷ পাকা রাস্তা নেই, বিদু্যৎ নেই, জলের কলও বেশ খানিকটা দূরে৷ কিন্ত্ত এসবের মধ্যেও কবি অজিত দত্তকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন ‘প্রগতি’ পত্রিকা৷

বুদ্ধদেবের বয়স যখন পনেরো, ১৯২৩ সাল, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলো ‘কল্লোল’ পত্রিকা৷ তারও আগে থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘কালিকলম’৷ কলেজের ছাত্র বুদ্ধদেব ‘কল্লোল’-এর টানেই এলেন কলকাতা৷ ‘কল্লোল’-এ প্রকাশিত হলো তাঁর একটি গল্প ‘রজনী হ’লো উতলা’৷ অশ্লীলতার অভিযোগ উঠল গল্পটির বিরুদ্ধে৷ মহিলাদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের গুঞ্জন শোনা গেল৷ বীণাপাণি দেবী লিখলেন, ‘এই ছেলেকে জন্মের সময় নুন খাইয়ে মেরে ফেলা হয়নি কেন?’ কিন্ত্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠি ঘি ঢালল সেই বিতর্কের আগুনে৷ রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আধুনিক সাহিত্য আমার চোখে পড়ে না৷ দৈবাৎ কখনো যেটুকু দেখি, দেখতে পাই, হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে৷ আমি সেটাকে সুশ্রী বলি এমন ভুল করো না৷’

বুদ্ধদেব তখন ১৮ বছরের যুবক৷ ১৯২৬ সাল৷ রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি তখন তুঙ্গে৷ রবীন্দ্রনাথের কথার বিরুদ্ধে তিনিও লিখলেন প্রতিবাদপত্র৷ আসলে ‘কল্লোল’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতি পত্রিকার লক্ষ্যই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রবল প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করা৷ এর পরেও বুদ্ধদেবের একাধিক গল্প নিয়ে সেই সময়ই অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল৷ কল্লোল যুগকে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘আধুনিক’ যুগ বলা হয়৷ সেই অধ্যায়ের তরুণতম প্রতিনিধি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু৷ তিনি যখন সবে ২১ বছর অতিক্রম করেছেন, ১৯৩০ সাল, সে বছরই তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বন্দীর বন্দনা’, উপন্যাস ‘সাড়া’ এবং ছোটগল্পের সংকলন ‘অভিনয় নয়’ প্রকাশিত হয়৷

ঢাকার পুরানা পল্টনে থাকার সময়েই বুদ্ধদেবের সঙ্গে আলাপ হয় সদ্য-তরুণী গায়িকা রানু সোম ওরফে প্রতিভার৷ বুদ্ধদেব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত৷ পদার্থ বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর বাড়িতে দিলীপকুমার রায়ের কাছে গান শিখতে গিয়ে রানু প্রথম দেখেন বুদ্ধদেবকে৷ তবে আলাপ রানুর কলকাতা চলে যাওয়ার মাস দুয়েক আগে৷ দিলীপকুমার রায়ের পাঠানো কয়েকটি পত্রিকা বুদ্ধদেবকে পৌঁছে দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানতে বুদ্ধদেব যান রানুদের বাসায়৷ রানুকে ইতিমধ্যেই মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বুদ্ধদেব৷ তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ‘কঙ্কাবতী’র কিছুটা অংশও৷ রানুরও কৌতূহল তৈরি হয়েছিল বুদ্ধদেব সম্পর্কে৷ তিনি লিখেছেন, ‘একদিন সন্ধ্যাবেলা পুরনো পল্টনের মাঠে বেড়াতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আড্ডাখানা এবং বাসস্থান টিনের ঘরটাও দেখে এসেছি, উঁকিঝুঁকিও মেরেছি৷’ এছাড়া বুদ্ধদেবের ‘প্রগতি’ পত্রিকায় তাঁর কবিতাও পাঠিয়েছিলেন প্রতিভা৷ তখন অবশ্য ‘প্রগতি’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে বলে চিঠি লিখে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন বুদ্ধদেব৷

এরপর এমএ পাশ করে বুদ্ধদেব চলে আসেন কলকাতায়৷ তখনও তিনি রিপন কলেজে, যা এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যপক হিসাবে যোগ দেননি৷ থাকেন দক্ষিণ কলকাতার রমেশ মিত্র রোডে৷ এদিকে তার উল্টোদিকের আশুতোষ মুখার্জি রেডের পাঁচতলা বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে তাঁর মামার বাড়িতে এসে উঠেছেন রানু সোম৷ মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎও হয় তাঁদের৷ একদিন ঢাকা থেকে সেখানে আসেন রানুর বাবা-মা৷ বুদ্ধদেব এসে সোজাসুজি তাঁদের বললেন, ‘আপনারা অনুমতি দিলে এ বাড়িতে একটা বিয়ে হতে পারে৷ অবশ্য রানুর যদি মত থাকে৷’

চাকরি-বাকরি নেই, তবু ছেলেটির ‘আত্মপ্রত্যয়’ দেখে এ বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন রানুর বাবা৷ পরে তাঁদের এনগেজমেন্টের দিনই রিপন কলেজে তাঁর চাকরির খবর পেলেন বুদ্ধদেব৷ বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী দু’জনে প্রথমে ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন রমেশ মিত্র রোডে৷ তারপর উঠে গেলেন ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে৷ বুদ্ধদেবের প্রতিজ্ঞা ছিল কোনও লেন, বাই-লেনে তিনি থাকবেন না৷ এই ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটটির নাম রেখেছিলেন ‘কবিতা ভবন’৷ এখান থেকেই বেরতো বুদ্ধদেব-সম্পাদিত বিখ্যাত লিটল ম্যাগাজিন ‘কবিতা’৷

‘কবিতা’ পত্রিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য আজও অনস্বীকার্য৷ শুধু তিরিশের বা চল্লিশের দশকের বাংলা কবিতাই নয়, পঞ্চাশের দশকের তরতাজা তরুণ কবিদের কবিতাকে পরম আগ্রহে তিনি ঠাঁই দিয়েছিলেন এই পত্রিকায়৷ কোনও কবির কবিতা ভালো লাগলে তা শুধু ছেপে দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন না সম্পাদক বুদ্ধদেব৷ সেই কবির কবিতা নিয়ে একের পর এক গদ্য লিখতেও তাঁকে দেখা গেছে৷ জীবনানন্দ দাশকে পাঠক সমক্ষে তুলে আনার এক গুরুদায়িত্ব তিনি এভাবেই পালন করেছিলেন৷

১৯৩৫ সালে প্রথমে তাঁর বন্ধু কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেছিলেন এই পত্রিকা৷ সহকারী সম্পাদক হিসেবে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন কবি সমর সেন৷ পরে ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যার (১৯৪১) থেকে বুদ্ধদেব একাই ছিলেন এর সম্পাদক৷ বুদ্ধদেবের ‘কবিতা ভবন’-এ ‘কবিতা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নিয়মিত বসত কবিদের আড্ডা৷ ক্রমশ ‘কবিতা’ পত্রিকা শুধু কবিতার পত্রিকা নয়, হয়ে উঠেছিল কবিদের পত্রিকা৷ জীবনানন্দ দাশ, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন, মণীশ ঘটক (যুবনাশ্ব), সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কবিরা প্রকৃত কবির মর্যাদায় থেকেছেন ‘কবিতা’ পত্রিকার পাতায়৷ কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে দু’টি বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল ‘কবিতা’র৷

তিরিশের কবিদের কবিতাচর্চাই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্র কবিতার প্রবল প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার সাধনায়৷ রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই ছিল তাঁদের রবীন্দ্র-দ্রোহ৷ বুদ্ধদেব যে রবীন্দ্রনাথকে কতখানি শ্রদ্ধা করতেন, তা তাঁর ‘সব পেয়েছির দেশে’ বইটি পড়লেই বোঝা যায়৷ ‘কবিতা’ পত্রিকাতেও তিনি নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা৷ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক আদর্শ বর্তমান সময়ের ক্ষেত্রে তত সার্থক নয়, এরকম মতামতে সরব হলেও বুদ্ধদেব একথা লিখেছেন, ‘আমাদের মাতৃভাষাই তাঁর কাছ থেকে আমরা পেয়েছি৷… চিরকালের বাঙালি লেখক এই অর্থে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারী৷’ আর তাই বাইশে শ্রাবণ তাঁকে কতখানি শোকগ্রস্ত করেছিল, তাঁর ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে ধরা আছে তা৷

বুদ্ধদেব রিপন কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে স্টেটসম্যান-এ কলাম লিখতেন নিয়মিত৷ তাতে উপার্জন ভালো হলেও তাঁর সাহিত্যের ক্ষতি হচ্ছে বলে বন্ধ করে দিলেন সে কাজ৷ তখনকার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের সহায়তায় বুদ্ধদেব ৬ মাস কাজ করেন ইউনেস্কোর বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে৷ পরে আমেরিকায় পেনসিলভানিয়ার ‘কলেজ ফর উইমেন’-এ পড়ান এক বছর৷ তারপর হুমায়ুন কবীরের মধ্যস্থতায় ত্রিগুণা সেনের ডাকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ানো শুরু করলেন৷ কিন্ত্ত সেখানেও তৃপ্তি নেই৷ শেষ পর্যন্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান অধ্যাপক হিসাবে কাজ শুরু করলেন৷ বুদ্ধদেবের কারণেই এই বিভাগটি শিক্ষাক্ষেত্রে সাড়া ফেলেছিল তখন৷

কিন্ত্ত এখানেও এক শ্রেণির অধ্যাপকের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৩ সালে তিনি পদত্যাগ করেন৷ এরপর কিছুদিন আমেরিকার নানা বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ালেও ভিতরে ভিতরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন বুদ্ধদেব৷ নাকতলায় নতুন বাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন৷ সেখানেই একদিন মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে থেমে গেল তাঁর সমস্ত জীবনস্পন্দন৷ সেদিন ছিল ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চের সন্ধ্যা৷ তাঁর শেষ যাত্রায় কাঁধ দিয়েছিলেন অনুজ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়েরা৷ আর ফাদার অাঁতোয়ান গাইছিলেন ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে৷’