ভাস্কো দা গামা

পূর্ব প্রকাশিতের পর

এতকাল ধরে এতো এতো নাবিক বাণিজ্য করতে এসে পা রেখেছেন কালিকট বন্দরে কত জিনিস পত্র, কত বড় বড় জাহাজ এসে ভিড়েছে, কত কত সেনা, লোক লস্কর, কিন্তু তারা কেউ এই বিদেশীর মতো নন। এনার চালচলন কথাবার্তা রকম ফের সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের।

কী বিশাল তাঁর নৌ বহর! আর কত লোকজন। কী তাদের রাজকীয় ঠাট-বাট। দেখলে ভিরমি খেতে হয়।
রাজা যতক্ষণ না প্রধানের মুখ থেকে আসল সংবাদ পৌঁছে দিতে না পারছেন ততক্ষণে শান্তি পাচ্ছেন না।


সেদিন বন্দরের আশেপাশে যারা সবাই কাজকর্মে রত ছিল সকলেই অবাক হয়ে দেখেছে সেই সুসজ্জিত বিদেশী নৌ বহরটিকে। যারা দেখেনি তাদেরকেও ডেকে ডেকে দেখিয়েছে। সত্যি তাক লাগার মতোই ব্যাপার স্যাপার! কতশত জিনিসপত্রে ‌ঠাসা! আর কত লোক লস্কর তাঁর সঙ্গে। যেন যুদ্ধ জয় করতে এসেছেন। নানান লোকজনের মুখে মুখে নানান রকম কানাঘুষো করতে শোনা গেল। কেউ বললেন, হয়তো কোনো রাজা মহারাজা হবেন।

কারো মতে নিশ্চয়ই কোনো দেশের রাজা বাণিজ্য করতে এঁকে পাঠিয়েছেন। কোনো নাবিক টাবিক হবেন। চেহারা আর পোশাক-আশাক তো তেমনটাই বলছে। কেউ বলছেন, কী জানি বাবা, আবার জলদস্যু নয় তো? শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজাকে আবার গদিচ্যুত করবেন না তো! নইলে এতো এতো অস্ত্রধারী লোকজন সঙ্গে করে আনবেন কেন? রাজ-অনুচরেরা প্রথমে লোক মারফত খবরাখবর সংগ্রহ করলেন। তারপর তাদের ভিতর থেকে সাহসী কয়েকজনাকে পাঠালেন। সেই বিদেশির সঙ্গে সরাসরি কথা বললেন তাঁরা। ফিরে এসে তাঁরা সবিস্তারে জানালেন রাজার অনুচরদের নিকটে।

রাজ অনুচরেরা সব কিছু শুনে এসে রাজার নিকটে এলেন। রাজা জামোরিন তখন সভায় বসে ছিলেন। অনুচরেরা রাজার সামনে এসে মাথা নত করে প্রণাম জানালেন। মহারাজ তাদেরকে দেখা মাত্র উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন। যেন এতক্ষণ তাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, ‘বলো, কী সংবাদ নিয়ে এলে?’ অনুচরেরা জামোরিনকে জানালেন, ‘মহারাজ সে বিশাল বিশাল সব নৌবহর। কী ঠাট-বাট তাদের। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমরা এর আগে কক্ষনো দেখিনি এতো বড়ো সব জাহাজ। মনে হচ্ছে মালপত্রে ঠাসা। বাণিজ্যের কারণেই এসেছে বোধ হয়।’ ‘কারা পা রাখল এই বন্দরে? কোন দেশের লোক?’ জামুরিন চূড়ান্ত কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলেন। যেন তার আর এক মুহূর্ত তর সইছে না। ‘মহারাজ, এই দলের নায়ক যিনি তিনি একজন পর্তুগীজ নাবিক। তার নাম ভাস্কো দা গামা।’ ‘পর্তুগীজ নাবিক! জলপথে?’ রাজার ভ্রু-জোড়া কুঞ্চিত হল। কেননা এর আগে কোনো ইউরোপীয় নাবিক ভারতে আসার জলপথের হদিশ পায়নি। তাহলে কীভাবেই বা তিনি জলপথে ভারতে এলেন? এটা তো রীতিমতো এক অসাধ্য সাধন বলা যেতে পারে। তাঁর ভ্রু-জোড়া সংকুচিত হল। তিনি অনুচরদের বল্লেন, ‘তোমরা ভালো করে সংবাদ সংগ্রহ করে আমায় জানাও। আমার যেন ব্যাপারটা একটু গোলমেলে মনে হচ্ছে।’

‘না হুজুর কথাটা একশ ভাগ সত্যি। আমরা বিভিন্ন ভাবে খবর নিয়ে জেনেছি তিনি পর্তুগীজ নাবিক। দেখার মতো চেহারা বটে। মনে হচ্ছে অগাধ ঐশ্বর্য নিয়ে এসেছে।’ কিন্তু জামোরিনের মাথায় তখন একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘সমুদ্র পথে ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার মেলবন্ধন!’ জামোরিন রীতিমতো উল্লসিত হয়ে কথাটা সকলের সামনে বলে ফেললেন। পাত্র মিত্র সভাষদ সকলে রাজার কথায় মাথা নাড়লেন, সত্যি তো, অসাধ্য সাধনই বটে। এ তো চাট্টিখানি কথা নয়। রাজার কৌতূহল হল একবার স্বচক্ষে মানুষটিকে দেখবার।

১৪৬০ সাল। পর্তুগালের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের সিনেস নামে একটি জায়গা। চার্চ নোসা সেনিয়োরা দাস সালাস-এর পাশেই একটি ছোট্ট কুটির। কুটিরের মাথায় লাল রঙ্গের টালির ছাউনি। দেওয়ালে সাদা চুনকাম করা।

আলেন্তেজ উপকূলে হাতে গোনা যে কটি সমুদ্র বন্দর আছে সিনেস তাদের ভিতরে একটি। এইসব ছোটো ছোটো কুটিরে ভাড়া থাকে মৎসজীবীরা তাদের পরিবার নিয়ে। এইরকমই একটা কুটিরে থাকতেন এস্তেভাও দ্য গামা। তিনি ইনফ্যান্ট ফার্দিন্যান্দ, ডিউক অফ ভিসেউ-এর নাইট হিসাবে কাজ করতেন। কিছুদিন এই কাজ করার পরে তিনি অর্ডার অফ সান্তিয়াগোর সামরিক পদ মার্যাদা লাভ করেন। ১৪৬০ থেকে ১৪৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিনেসের গভর্নর এবং খাজনা গ্রহীতার দায়িত্বে ছিলেন।

এস্তেভাওয়ের জীবনে ১৪৬০ সালটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এই বছরটা ছিল তাঁর তৃতীয় সন্তান ভাস্কো দা গামার জন্ম বছর। আর তার পর পরেই তিনি ‘অর্ডার অফ সান্তিয়াগো’র পদ মর্যাদা লাভ করলেন। এর আগেও তার আরও দুটি সন্তান জন্ম লাভ করেছে। কিন্তু তৃতীয় সন্তান যেন তাঁর এবং তাঁর স্ত্রী ইসাবেলার চোখের মণি। যেমন সুন্দর দেখতে। তেমনি তার বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি। অনেকটা মায়ের সঙ্গে মিল আছে মুখের।

ইসাবেলা দুধ পানের সময়ে শিশু ভাস্কো দা গামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ভাস্কো দা গামার মা ইসাবেলা ছিলেন জ্যাও দ্য রেসেন্ডের কন্যা। অতীব সুন্দরী। অভিজাত ইংরেজ পরিবারের এক তরুণী। তার ভাই এবং বাবার সঙ্গে এস্তেভাওদের পরিবারের বেশ অন্তরঙ্গতা ছিল। ইসাবেলার বাবা এবং দাদা দুইজনেই মিলিটারিতে চাকরি করতেন। মিলিটারিতে কর্মরত অবস্থায় দুই পরিবারের ভিতরে দারুণ পারিবারিক সখ্য ছিল। এস্তেভাও সেই সময়ে ইসাবেলার প্রেমে পড়েন। তারপর তাদের বিবাহ হয়। এস্তেভাও এবং ইসাবেলার আরো চারটি সন্তান ছিল। ভাস্কো দা গামার উপরে ছিলেন পাওলো দ্য গামা এবং জোয়াও চড্রে। পরের তিনজন হলেন— পেড্রো দ্য গামা, আইরেস দ্য গামা এবং তাদের এক বোন হল টেরেসা দ্য গামা।

টেরেসা গামার সাথে পরবর্তীকালে লেপ মেন্ডেস দ্য ভাস্কনসেলস-এর বিয়ে হয়। খুব ছোটোবেলা থেকে পড়াশুনার প্রতি দারুণ আগ্রহ দেখে এস্তেভাও আর ইসাবেলা ভাস্কো দা গামাকে নিকটবর্তী একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। তখন তার বয়স খুবই সামান্য।
এস্তেভাও আড়ালে ইসাবেলাকে বলতেন, ‘দেখ প্রিয়তমা, তোমার এই ছেলে কিন্তু বড়ো হয়ে কিছু একটা হবে। ওর গণিতে মাথা দেখেছ, এই বয়সে কত জটীল গণিতের সমাধান করছে?’ ইসাবেলার চোখ মুখে খুশী ছড়িয়ে পড়ল। ছেলের জন্যে তারও তো গর্ব কম নয়।

পড়াশুনার প্রতি তীব্র আকর্ষণ দেখে কিছুদিন সিনেসের বিদ্যালয়ে পড়ানোর পরে উচ্চতর শিক্ষার জন্যে তাকে অন্যত্র পাঠানোর কথা ভাবলেন এস্তেভাও। অনেকেই এস্তেভাওকে পরামর্শ দিলেন ছেলেকে ইভোরাতে পাঠানোর জন্যে। ইভোরা ছিল সেই সময়ে শিক্ষার কেন্দ্রস্থল। এস্তেভাও ইসাবেলার সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করলেন। ছেলেকে দূরে পাঠাতে প্রথম দিকে কিছুতেই মনে সাড়া দিচ্ছিল না ইসাবেলার। তার উপরে ভাস্কোর বয়স তো বেশ কম। এই বয়সে অতো দূরে সে কী করে থাকবে, চিন্তায় ইসাবেলার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেল। কিন্তু ভাসস্কো দা গামা নাছোড়বান্দা। মাকে জানাল, সে থাকতে পারবে। পড়া শেষ করে আবার সে ফিরে আসবে নিজের শহরে।

কিছুদিন বাদে এস্তেভাও ছেলেকে ইভরা শহরে লেখাপড়ার জন্যে পাঠানোর বন্দোবস্ত করলেন। ইভরা শহরে তার এক বিশেষ পরিচিত বন্ধু ছিলেন। ঠিক করলেন তাঁর কাছেই রেখে আসবেন তিনি ভাস্কো দা গামাকে। সেই মর্মে তাঁর একজন পরিচিত ব্যক্তির মারফৎ এস্তেভাও খবরটা পাঠালেন।

প্রায় মাসখানেক কেটে গেল। সংবাদ না পেয়ে বড়ই ব্যাকুল হয়ে পড়লেন এস্তেভাও। এই বন্ধুটিই তাঁর একমাত্র ভরসা। নইলে এতোদূর কার ভরসায় তিনি কিশোর গামাকে ইভোরাতে পাঠাবেন? একমাস বাদে খবর এল বন্ধুটি এখন সপরিবারে লিসবনে থাকেন। তবে এস্তেভাও পুত্রসহ এখানে এলে তিনি এস্তেভাওয়ের সঙ্গে ইভোরাতে যাবেন। ওখানে তার একজন পরিচিত বন্ধু আছেন। খুব ভাল মানুষ। তার কাছ থেকে অনেক সংবাদ পাওয়া যাবে। একদিন ভাস্কোডাগামাকে নিয়ে এস্তেভাও একটা জাহাজে চেপে বেরিয়ে পড়লেন। এই প্রথম ভাস্কোডাগামা বাড়ি থেকে দূরে আসার সুযোগ পেল। চারিদিকে নীল জলরাশি। দূরে সমুদ্রবক্ষে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু জাহাজ, পাল তোলা নৌকা। দেখা যাচ্ছে কিছু মৎসজীবীদের নৌকা। যতদূর দেখা যায় জল আর জল। আকাশ যেন সমুদ্রকে ছুয়ে আছে। বেলা পড়ে আসছে। ভাস্কোডাগামা নৌকার উপরে দাড়িয়ে দূরের শোভা দেখতে দেখতে একসময় বাবাকে বলল, ‘বাবা, আমি কিন্তু গণিতের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ চালনা বিদ্যা শিখব।’

এস্তেভাও ডেকে ছেলের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। ছেলের কথা শুনে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যে বিষয় পছন্দ করো, ভালবাসো তাই তোমাকে শেখাবো। তুমি শান্ত হয়ে লেখাপড়া করবে কেমন? মা কী বলে দিয়েছে, মনে আছে তো?’ মায়ের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ভাস্কো দা গামা হঠাৎ কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। মনে পড়ল সিনেসের জেটি থেকে তাদের জাহাজ যখন ছেড়ে দিল মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল। মা এবং তার এক কাকা এসেছিলেন তাদের জাহাজে তুলে দিতে। শেষ মুহূর্তে মা ওকে বুকের ভিতরে খুব জোরে চেপে ধরে রেখেছিলেন তারপর কপালে দীর্ঘক্ষণ চুম্বন করলেন।

মনে হল মা যেন তার ভিতরে অসীম শক্তি প্রেরণ করলেন। ভাস্কো দা গামা এখনও যেন শুনতে পাচ্ছে মার বুকের ভিতরের সেই শব্দ। আস্তে আস্তে সেই মহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল। জাহাজের ঘন্টা বেজে উঠল। যাত্রীরা সকলে লাইন দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে পড়ল। দারুণ তৎপরতা দেখা গেল নাবিক এবং অন্যান্য কর্মচারীদের ভিতরে। ভাস্ক দা গামা তখন জাহাজে ওঠার জন্যে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে মার সেই গভীর কষ্ট বুঝতে পারেনি যতটা এখন অনুভব করতে পারছে। বাবার কথার উত্তরে মনে মনে বলল, ‘মনে আছে। মা বলেছে, মন খারাপ করবে না। যখন আমার কথা খুব মনে পড়বে তখন সমুদ্রের পাড়ে দাড়িয়ে চিৎকার করে ‘মা’ বলে ডাকবে। দেখবে আমি ঠিক তোমার ডাক শুনতে পারবো।’

‘আর আমি কীকরে বুঝবো যে তুমি আমার কথা ভাবছ?’ ‘বুঝতে পারবে। দিনের শেষে যখন তুমি বেলাভূমিতে এসে দাঁড়াবে, দাঁড়িয়ে সাগরের দিকে চেয়ে দেখবে একটা ঢেউ মাথায় উচু হয়ে তোমার দিকে ছুটে এসে তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে, সেই সময়ে এক আঁজলা জল হাতে তুলে নিয়ে তাতে চোখ রাখলে তুমি আমায় দেখতে পাবে। আর সেই ফেনিল জলরাশি সরে যেতেই তুমি কিছু জিনিস পাবে। ভাববে সেই সব জিনিস আমি তোমার জন্যেই পাঠিয়েছি।’ মায়ের কথাগুলো সে নিজের মনে আরও একবার আওড়ে নিল। তাদের জাহাজ এখন উপকূল রেখা ধরে উত্তরের দিকে এগিয়ে চলেছে।

ভাস্কো দা গামা এখন ডেকের উপরে উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাম দিকে অনন্ত বিস্তৃত জলরাশি। আর ডানদিকে উপকূলভূমিতে একের পর সরে যাচ্ছে দৃশ্যপট। এই একটা বেলায় কত শহর, কত বন্দর কত গ্রাম চোখের সামনে দিয়ে সরে সরে গেল। ভাস্কো দা গামা বিশ্বগ্রাসী খিদে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেই চলমান দৃশ্যাবলী।
(ক্রমশ)