• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

ভাস্কো দা গামা

ভাস্কো দা গামা ছিলেন একজন পর্তুগিজ পর্যটক। তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিস্টব্দে। ইউরোপ থেকে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপথে ভারতে আসেন। ১৪৯৮ সালের ২০ মে ভারতের কালিকটে পৌঁছান তিনি। তখন কালিকটের রাজা ছিলেন জামোরিন। ভাস্কো দা গামাকে সংবর্ধনা জানান তিনি। সেই ভাস্কো দা গামার ছোটবেলা থেকে জীবনের নানান কাহিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ছন্দা বিশ্বাস।

ভাস্কো-দা-গামার একটি আনুমানিক চিত্র।

গত সপ্তাহের পর

সেই সময়ে রেশম ছিল অত্যন্ত দুর্লভ জিনিস। রোমবাসীরা যেদিন জানতে পারল ভারতে উৎকৃষ্ট রেশম উৎপন্ন হয়, সেদিন থেকে তাদের লক্ষ্য হল কীভাবে ভারতে এসে রেশম এবং রেশমী বস্ত্র তাঁদের দেশে নিয়ে যাবে। রেশম এবং রেশমী বস্ত্রের মোহে মোহিত ছিল সকলে। অতি সূক্ষ্ম এবং কোমল এইসব বস্ত্র বিলাসী রোমবাসীরা পরিধান করার জন্যে যে কোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত ছিল। মিশর এবং আলেকজান্দ্রিয়ার বণিকেরা যে ভারত থেকে রেশম এবং রেশমী বস্ত্র কিনছে সেই সংবাদ অনেকের মতোই রাজা জন-টু-এর কানে এল। যেমন এসেছিল ভাস্কো দা গামার কানে।

ভাস্কো দা গামা যখন ইভোরাতে ছিলেন তখন বিভিন্ন বণিক এবং নাবিকদের সঙ্গে আলোচনার সময়ে জানতে পারেন অতি প্রাচীন কাল থেকে চীন দেশে গুটিপোকার চাষ হতো এবং সেই গুটি পোকার লালা থেকে যে সূক্ষ্ম তন্তু বের হতো সেই তন্তুকে বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করে তন্তুবায়েরা তা থেকে সূক্ষ্ম বস্ত্র বানাতেন। ওই সকল রেশমজাত জিনিস ভারতের বিভিন্ন বন্দরে সাজানো থাকত বিক্রির জন্যে। ভারতীয় পোত বণিকেরা চীন থেকে রেশম এনে নিজেদের বন্দরে বিক্রি করতেন। গ্রিস এবং রোমবাসীরা রেশমের প্রভূত প্রশংসা করত। কিন্তু তারা জানতো না যে এই রেশম কোত্থেকে আসছে।

তাদের ধারণা ছিল এই তন্তুগুলো কোনো তুলাজাতীয় গাছের ফল থেকে প্রস্তুত করা। রেশম যে একজাতীয় পোকার লালা তা তারা ঘূণাক্ষরেও জানতো না। কীভাবে যে এইসব তন্তু থেকে বস্ত্র উৎপন্ন হয় সে সম্পর্কেও তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান ছিল না।

ভাস্কো দা গামা আরো জানলেন যে, সেই সময়ে সিরিয়া এবং মিশরের বণিকেরা ভারত থেকে জিনিসপত্র কিনে সেইসব জিনিস রোমে পাঠাত। এই সময়ে তারা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়েও নিতান্ত উৎসাহ নিয়ে বাণিজ্য করত।

এই সময়ে গ্রিস এবং রোমের প্রচুর জলযান সাগরে যাতায়াত করত। প্রথম দিকে নাবিকেরা বেলাভূমের কাছ ঘেঁষেই সমুদ্রযান চালাত। কিন্তু কিছুদিন বাদে তারা লক্ষ্য করল ভারত মহাসাগরে বছরের ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের সমুদ্রবায়ু প্রবাহিত হয়। এর ফলে প্রতিনিয়ত নানান রকমের বিপত্তি দেখা যেত, কত কত নৌকাডুবির ঘটনা শোনা যেত।

কিছুদিন পূর্বদিক থেকে তারপর কিছুদিন দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হয়। আগে নাবিকেরা এসব ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল। তাই প্রায়শই জাহাজ ও নৌকাডুবির সংবাদ কানে আসত। সেই সময়ে হিপালস নামে একজন সমুদ্র বিশেষজ্ঞ এবং বাণিজ্য পোতাধ্যক্ষ সমুদ্রবায়ুর গতিপথ অনুধাবন করে জানালেন ভূপৃষ্ঠের উচ্চচাপ বলয় থেকে নিম্নচাপ বলয়ে সারাটা বছর নিয়মিত বায়ু প্রবাহ হয়ে থাকে। কর্কটীয় এবং মকর ক্রান্তিয় বলয় থেকে সারাটা বছর বাতাস নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। উত্তর গোলার্ধের এই বায়ু নিরক্ষীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময়ে কিছুটা উত্তর-পূর্ব দিক ঘেঁষে প্রবাহিত হয়। আবার দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হওয়ার সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে যায়। এই উত্তর-পুর্ব আয়ন বায়ু এবং দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর জন্যে তাই বেলাভূমি ধরে নয়, এবারে যান চালাতে হবে মাঝ সমুদ্র দিয়ে।

এটা জানার ফলে নাবিকদের খুব সুবিধা হল।

সেই মতো ভাস্কো দা গামা আরবসাগর দিয়ে যাত্রা করে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে তিনি মুসিরিসে এসে পৌঁছালেন। এই পথ দিয়ে যাতায়াতের ফলে অন্য সকলে উপকৃত হলেন। আর সেই থেকে এই বায়ু প্রবাহ ‘বাণিজ্য বায়ু’ নামে পরিচিত হল।

সেই সময়ে ‘মুসিরিস’ তাই ভারতের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠল।

বণিকেরা তাই নিজেদের কাজ শেষ করে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর সহায়তায় আরবসাগরে প্রবেশ করত, তারপর সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুকে হাতিয়ার করে এক বছরের ভিতরে স্বদেশে ফিরে যেত।

অল্প সময়ের ভিতরে অনেকটা রাস্তা যেতে সক্ষম হল। তিনি এটাও লক্ষ্য করেছেন, উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর বেগ ঘন্টায় প্রায় ১৬ কিলোমিটার আর দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর বেগ কিছুটা বেশি। ঘন্টায় প্রায় ২৪ কিলোমিটার। এই বায়ুর জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশী। তাই এই বায়ুপ্রবাহে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় না।

ভাস্কো দা গামা এই সব বিষয়ে বিস্তর পড়াশুনা করলেন। সুদূর পর্তুগাল থেকে ভারতে আগমন মুখের কথা নয়। অনেক জায়গায় তাঁদের জাহাজ থামাতে হবে, খাদ্য খাবার এবং বিশেষ করে পানীয় জলের জন্যে। বছরের যে সময়ে প্রচণ্ড গরম থাকবে সেই সময়ে দিনের বেলা বিশ্রাম করে রাতের বেলা যাত্রা করতে হবে।

ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত, সাইক্লোন ছাড়াও মহাসাগরে আরো এক মহা বিপদ হল জলদস্যুর ভয়। কখন কীভাবে অতর্কিতে যে তারা হানা দেয় আগে ভাগে কিছুই আঁচ করা যায় না।

এর আগে বার্থালোমিউ দিয়াজ নামে একজন রোমান ক্যাথলিক নৌ-অভিযাত্রী ১৪৮৭ সালে উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে ইউরোপ থেকে পূর্বদিকে আসার পথের হদিশ দেন। তিনি ৪ নভেম্বর আফ্রিকা উপকূলে অবতরণ করেছিলেন। সেই সময়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের কারণে ইউরোপীয়দের এড়িয়ে সম্পূর্ণ নতুন পথের সন্ধান করাটা খুব দরকার হয়ে পড়েছিল।

ভাস্কো দা গামা বার্থালোমিউ দিয়াজের যাত্রাপথের বর্ণনা গভীর মন দিয়ে পড়ে সেই পথ অনুসরণ করলেন।


প্রথন অভিযান—
১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই।
ভাস্কো দা গামা ১৭০ জন নাবিক, খালাসি, জাহাজের অন্যান্য কর্মচারীসহ একটি দল এবং চারটি জাহাজ নিয়ে লিসবন থেকে যাত্রা শুরু করলেন। নাবিক হিসাবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন পেরো দ্য আলেনকুয়ের, পেড্রো ইস্কোবার, জোয়াও দি কইম্ব্রা এবং আফন্সো গনকালেভস। এঁরা ছিলেন সেই সময়ের অভিজ্ঞ নাবিক।

সুন্দর করে সাজানো হল সাও গাব্রিয়েল জাহাজটিকে। যার নেতৃত্ব দেন ভাস্কো দা গামা। এর ওজন ছিল ১৭৮, দৈর্ঘ্য ছিল ২৭ মিটার, প্রস্থ ৮ দশমিক ৫ মিটার, পাল ৩৭২ মিটার, হলরুম ছিল ২ দশমিক ৩ মিটার। এর নির্মাতা ছিলেন বার্থালমিউ দিয়াজ। সব চাইতে উঁচু, সব চাইতে আকারে বৃহৎ জাহাজটি।

ভাস্কো দা গামা তাঁর অন্য দুটি জাহাজে মুল্যবান পাথর, কাচ পাত্র, বিভিন্ন ধরনের গন্ধ দ্রব্য, সামুদ্রিক কীট পঞ্জর, লোবান, অবিমিশ্র রূপো, বিভিন্ন মুদ্রা এবং মদ, বল্কল বস্ত্র দ্বারা জাহাজ পূর্ণ করলেন। ইচ্ছা ছিল, এই সকল জিনিস ভারতে বিক্রি করে ভারত থেকে মশলা, রেশম, রেশমী বস্ত্র সকল, কার্পাস, বহুমূল্য রত্ন, সোনা, রূপা, মুক্তা, গোলমরিচ, দারুচিনি দ্বারা জাহাজ ভর্তি করে স্বদেশে ফিরে আসবেন।
অনেক দিনের স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছে।

ভাস্কো দা গামা ভিতরে ভিতরে যতটা উৎফুল্ল হলেন, বাইরে তার কিঞ্চিৎ মাত্র দেখা গেল না। যেভাবে সকলকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন সেই ভাবেই ধাপে ধাপে এগিয়ে গেলেন। এতোটাই উচ্ছ্বাস গোপন করতে পারার ক্ষমতা ছিল তাঁর ভিতরে।

দ্বিতীয় জাহাজ সজ্জিত হল। এটির নাম সাও রাফায়েল। এটিকে বলা হত ‘সিস্টারস শিপ অফ সাও গাব্রিয়েল’। এটিও একই সময়ে একই উদ্দেশ্য নিয়ে বার্থালমিউ দিয়াজ নির্মাণ করেছিলেন। এর নেতৃত্ব দেন ভাস্কো দা গামার দাদা পাওলো দা গামা। এটা ছিল সাও গাব্রিয়েলের মতোই। বিভিন্ন জিনিস দিয়ে জাহাজ পূর্ণ হল।

সঙ্গে ছিল একটি মালবাহী বেরিও। যা আগের তুলনায় কিছুটা ছোট। এটার নাম ছিল সাও মিগুয়েল। এর নেতৃত্বে ছিলেন নিকোলউ কোয়েলহো। পাইলট ছিলেন পেড্রো এস্কোবার এবং আল্ভাদ্র দা ক্লার্ক। এটি ছিল সব চাইতে ছোটো কিন্তু দ্রুতগামী জাহাজ। পঞ্চাশ থেকে নব্বই টন মাল বহনে সক্ষম। মোটামুটি মাস ছয়েকের খাবার, পানীয় জল, জ্বালানি, ওষুধপত্র ইত্যাদি দ্রব্য সকল পূর্ণ করা হল। এর সঙ্গে ছিল একটি ‘ল্যাটিন সেইল’। মানে ছোটোখাটো ভাসমান নৌকা আকৃতির জলযান। এটি ছিল একটি ত্রিকোণাকার জলযান। খুব দ্রুত জলের উপর দিয়ে ছুটে যেতে পারত। তখনকার দিনে নীলনদে এই জাতীয় জলযান চলত। এগুলো সাধারণত মৎসজীবীরা বেশি ব্যবহার করত। কেউ কেউ আমোদ প্রমোদের তরণী হিসেবেও ব্যবহার করত। অনেক কাল আগে রোমান সম্রাটেরা এই জলযান গুলি ব্যবহার করতেন।

এতো এতো লোকজন এতো মাস জলের উপরে ভেসে চলবে কিন্তু তাদের খাদ্যের প্রয়োজন তো। তাই সকলের খাবারের জন্যে নেওয়া হল শুকনো ফলমূল জাতীয় খাবার এবং লবণজাত কড এবং সাডিন মাছ। টিনভর্তি টুনা মাছ। ম্যাকারেল, রে ফিশ এবং আরও কিছু সংরক্ষণ করা সামুদ্রিক মাছ নেওয়া হল যেগুলো পাঁচ-ছয় মাস পর্যন্ত রাখা যায়। মাস খানেকের মতো চলতে পারে এমন আনাজপাতি নেওয়া হল। আলু, পেঁয়াজ, রসুন, গাজর, বাঁধাকপি, শুকনো চিলি ইত্যাদি নেওয়া হল। হিসাব করে প্রত্যেকের মাথাপিছু খাবার হিসাবে ধরা হল দেড় পাউন্ড বিস্কুট, এক পাউন্ড গরুর মাংস, হাফ পাউন্ড শূকরের মাংস, আড়াই পিন্টস জল, দেড় পিন্টস মদ, ৩০ গিল ভিনিগার, ৬০ গিল তেল। এছাড়া মাথাপিছু নির্দিষ্ট চাল, মাছ এবং চীজ বরাদ্দ থাকল।

ঠিক হল প্রয়োজনে যেখানে যেখানে জাহাজ নোঙর করা হবে, সেখান থেকে কিছু কিছু খাবার তুলে নেওয়া হবে। বাকিটা সংরক্ষণ করা থাকবে। বন্দর থেকে তোলা হবে কমলালেবু। কারণ তারা জানে, ভিটামিন সি-র অভাবে জাহাজের কর্মচারীরা স্কার্ভি রোগে আক্রান্ত হয়। সবুজ শাকসব্জি তো সহজে মিলবে না জাহাজে।

এছাড়া আরও একটি মালবাহী জাহাজ নেওয়া হল যেটি অন্যান্য খাদ্য এবং পানীয় দ্রব্যে পূর্ণ ছিল। খাদ্যের ভার সম্পূর্ণ একজনের উপরে ন্যস্ত ছিল। তিনি এই অভিযানের সকল জাহাজের সকল মানুষদের সকলের দায়ভার নিলেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন গনকাল নানস। এটি ১১০ থেকে ২০০ টন মাল বহনে সক্ষম।

(ক্রমশ)