• facebook
  • twitter
Monday, 4 November, 2024

ভাস্কো দা গামা

ভাস্কো দা গামা ছিলেন একজন পর্তুগিজ পর্যটক। তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিস্টব্দে। ইউরোপ থেকে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপথে ভারতে আসেন। ১৪৯৮ সালের ২০ মে ভারতের কালিকটে পৌঁছান তিনি। তখন কালিকটের রাজা ছিলেন জামোরিন। ভাস্কো দা গামাকে সংবর্ধনা জানান তিনি। সেই ভাস্কো দা গামার ছোটবেলা থেকে জীবনের নানান কাহিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ছন্দা বিশ্বাস।

প্রতীকী চিত্র

গত সপ্তাহের পর

জাগুটো হল চাঁদের দক্ষিণ-পূর্বের ক্রেটার। আব্রাহামের নামানুসারে তাঁর নতুন নামকরণ হল— ‘রাব্বি লেভি’।
পরবর্তীকালে এই টেবিল অনুসরণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি গণনা করে এক বছরের হিসাব দিলেন— ‘৩৬৫ দিন, ৫ ঘন্টা, ৪৯ মিনিট, ১৬ সেকেন্ড।’
এখনকার হিসাবের খুব কাছাকাছি এল। এরপর জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাস জাকুটোর টেবিল থেকে গ্রহদের পারস্পারিক অবস্থান, তাদের গতিবিধি, তাদের ঘূর্ণায়মানতার ব্যাখ্যা দিলেন।

টলেমি সৌর জগতের উপরে জটিলতর গণিতের মাধ্যমে বানিয়ে ফেললেন জিওসেন্ট্রিক মডেল। যেটি ‘টলেমির জিওসেন্ট্রিক মডেল’ নামে পরিচিত।
জোতিঃপদার্থবিদ্যায় পণ্ডিত ব্যক্তিরা প্রায় সকলে জাকুটোকে ঈশ্বর মনে করেন।

দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। ভাস্কো দা গামা ইভরাতে এসে পড়ার সুযোগ পেলেন আব্রাহামের কাছে।
এ যেন স্বপ্নেও তিনি কল্পনা করতে পারেননি। এমন একজন বিদ্যান পণ্ডিত প্রবরের কাছে তাঁর মতো ক্ষুদ্র মানুষ শিক্ষা নিতে এসেছে?

কে না জানে বিজ্ঞানী আব্রাহামের নাম?
সমস্ত পর্তুগালে ছড়িয়ে পড়েছে আব্রাহামের নাম।

স্পেনের সালমানাকা শহরে যাঁর জন্ম, পড়াশুনা সালমানাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অ্যাস্ট্রনমি যাঁর প্রিয় বিষয়, পরবর্তীকালে তিনি জারাগোজা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

বিজ্ঞানী জাকুটো এরপর স্পেন থেকে পর্তুগালের লিসবনে চলে এলন। ততদিনে তিনি পণ্ডিত মহলে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ইতিমধ্যে লিসবনের রাজা জন টু-এর কাছে জাকুটোর সংবাদ পৌছে গেছে। জন টু তাঁকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। জাকুটোকে সভায় আনা হল। রাজা জন তাঁকে ‘রয়াল অ্যাস্ট্রমার’ হিসাবে সম্মানিত করলেন। এই পদ জাকুটো ধরে রেখেছিলেন রাজা ম্যানুয়েল-ওয়ান পর্যন্ত।

ভাস্কো দা গামার তখন মাত্র কুড়ি বছর বয়স। একদিন বাবা এস্তেভাও ইভরাতে তাঁর কাছে এসে বললেন, তাকে অর্ডার অফ সান্তিয়াগোতে যোগ দেবার জন্যে তিনি তাকে নিতে এসেছেন। এস্তেভাও ছিলেন সান্তিয়াগোর একজন সেনা।

ভাস্কো দা গামা বাবার কথা অমান্য করেননি। তিনি ইভরা থেকে চলে এলেন সান্তিয়াগোতে।
সান্তিয়াগোর মাস্টার ছিলেন রাজকুমার জন। পরের বছর রাজকুমার জন রাজা জন দ্বিতীয় (John II) হিসাবে সিংহাসন আরোহণ করেন।
জন-টু রাজা হয়ে দেশের নানা বিষয়ের সংস্কার সাধন করা শুরু করলেন। অন্যান্য নানান সংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাণিজ্যের দিকেও নজর দেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছিলেন আফ্রিকা কীভাবে বাইরে থেকে সোনা, মশাল, বস্ত্র, হাতির দাঁতের সামগ্রী এবং দাসদের কিনে এনে তাদের কাজে লাগাচ্ছে। সুদূর এশিয়া থেকে উচ্চমানের মশলা এনে এদেশে বাণিজ্য করছে, মুনাফা লুটছে।
জন-টু ভাস্কো দা গামার শরণাপন্ন হলেন।

ভাস্কো দা গামা সেই সময়ে সমুদ্র অভিযান এবং নৌবিদ্যায় অসাধারণ বুৎপত্তি অর্জন করেছেন। তিনি ভাস্কো দা গামার কাছে তাঁর অভিপ্রায় জানালেন। যে করেই হোক আফ্রিকা মহাদেশ হয়ে এশিয়া আসার নতুন জলপথ অনুসন্ধান করতে হবে। এর জন্যে যা যা দরকার সব কিছু তিনি দিতে প্রস্তুত আছেন। ভারবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্য করার সাধ তাঁর বহুদিনের। পৃথিবীতে এমন সম্পদশালী দেশ আর ক’টা আছে?

ভাস্কো দা গামার সঙ্গে পরামর্শ করে জন-টু দু’জন গুপ্তচর নিযুক্ত করলেন।
সেটা ছিল ১৪৮৭ আল। এঁদের একজন হলেন পেরো দ্য কভিলহা এবং অপরজন হলেন আলফন্সো দ্য পাইডা। স্থলপথে তাঁরা প্রথমে মিশর, তারপর পূর্ব আফ্রিকা হয়ে ভারতে প্রবেশ করলেন। ভারতে কোথায় মশলা বাজার, কোথায় কেমন বাণিজ্যের প্রসার, সেখানকার রাজনৈতিক বাতাবরণ কেমন, সেইসব খবর সংগ্রহ করে দেশে ফিরলেন।

১৪৮৭ সালে বার্থোলমিউ দিয়াজ নামে একজন পর্তুগিজ নাবিক যিনি সর্বপ্রথম আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ দিকে সাগর পাড়ি দেন। ইউরোপ থেকে এশিয়া মহাদেশের যাওয়ার পথের হদিশ দেন। বার্থালোমিউ-এর বয়স তখন ত্রিশের কোঠায়। এর ভিতরে বার্থোলমিউ সমুদ্র অভিযান সম্বন্ধে বহু অভিজ্ঞতা ও তথ্য জোগাড় করেছেন। তিনি ছিলেন একজন দুঃসাহসী নাবিক। বার্থালোমিউ দিয়াজ যে পথ ধরে সমুদ্র পাড়ি দেন এবং নতুন পথ আবিষ্কার করে ফিরে আসেন সেই ম্যাপ ভাস্কো দা গামা সংগ্রহ করলেন। এর জন্যে অবশ্য ভাস্কো দা গামাকে কিছুটা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল।


পঞ্চদশ শতকের শুরু থেকেই রাজা হেনরির উদ্যোগে আফ্রিকার উপকূলবর্তী অঞ্চলে অভিযান চালাতে শুরু করে। এর একটাই উদ্দেশ্য ছিল সোনা অন্বেষণ। এরপর ১৪৬০ সালে রাজা হেনরির মৃত্যুর পরে কিছুদিন পর্তুগিজেরা সেই অভিযান চালানোর ব্যাপারে কম আগ্রহ দেখাতে শুরু করল। বেশ কিছুদিন এই ভাবেই কেটে গেল। এরপর ১৪৬৯ সালের দিকে ফের্ণাও গোমসের নেতৃত্বে আবার শুরু হল বাণিজ্য। মূলতঃ হাতির দাঁত, বস্ত্র, সোনা, রেশম, মেলেগুয়েটা কাগজ আর ক্রীতদাস ব্যবসা শুরু হল।

এরপর রাজা দ্বিতীয় জন সিংহাসনে বসেই কিছু সংস্কারমুলক কাজে হাত লাগালেন। বাণিজ্যের দিকে নজর দিলেন তিনি। ইতিমধ্যে আফ্রিকা যে মশলা, সোনা এবং দাস ব্যবসায় বেশ অর্থ উপার্জন এবং সুনাম অর্জন করেছে সেটা তিনি লক্ষ্য করলেন। মূলত মশলা ব্যবসার প্রসারের জন্য তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়লেন। মিশরীয় বন্দর হয়ে লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে কীভাবে ভারত থেকে মশলা আনতে হয়, সেটাই তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। ভারতবর্ষ তখন অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। নানান সম্পদে পরিপূর্ণ।

এবারে ভারত হল তাঁর পাখির চোখ।
প্রাচীন কাল থেকেই ইউরোপের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় বণিকেরা ভারতবর্ষ থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিক্রি করত।

মিশর, পারস্য ইত্যাদি দেশসমুহ যে ভারতের সঙ্গে বহুযুগ ধরে ব্যবসা বাণিজ্যে লিপ্ত আছে, সে সংবাদ তাঁদের কানে এসেছে।
পারস্যের মানুষ ছিলেন অত্যন্ত বিলাসপ্রিয় এবং ভোগ ব্যসনে লিপ্ত। টিসিয়স নামে একজন গ্রীক পণ্ডিতের লেখা থেকে তিনি জানতে পেরেছেন ভারতের কাশ্মিরী শাল, গালিচা, পশমিনা পারসিকদের খুবই পছন্দের জিনিস। তাঁদের অন্দরে সুদৃশ্য বাহারী গালিচা , বৈদূর্যমণি, বহুমূল্য রত্নরাজি সুচারু শোভা বর্ধন করত সে সবই ভারত থেকে আনা। পারস্যের প্রাচীন এক পণ্ডিতের লেখা থেকে তাঁরা জেনেছেন কাশ্মীর এবং ভারতের পশ্চিম অঞ্চলের রাজ্যসমূহের বিভিন্ন স্থানে যে সকল শিল্প এবং বিবিধ প্রকার রত্নসামগ্রী প্রস্তুত হত সেইসব জিনিসপত্র প্রথমে আরব সাগরের বিভিন্ন বন্দরে আসত, তারপর সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে আফ্রিকা আর ইউরোপে পৌঁছে যেত। সেই সময়ে সিংহল দেশে যে মুক্তা উৎপাদিত হত সেই মুক্তা মিশর, পারস্য সহ গোটা ইউরোপে তার কদর ছিল। তিনি এটাও জেনেছিলেন পারস্য উপসাগরের মোহনায় দারুচিনি, মুক্তা, হাতির দাঁত, আবলুস কাঠ, বিভিন্ন সুগন্ধী প্রস্তুতকারক গন্ধদ্রব্য, মশলা ইত্যাদি প্রেরিত হত।
এসব কথা যত শুনলেন ততই ভাস্কো দা গামার চোখ দীপ্তিময় হয়ে উঠল।

ভাস্কো দা গামা বোখারা এবং বাখতার নগরীর নাম শুনলেন। একসময়ে এই নগরীদুটি ছিল ভারতের সঙ্গে কাবুল ও বাখতরের মধ্য ভাগের বাণিজ্যের পথ। তিনি আরো জানলেন গ্রীক বীর আলেকজান্ডার যখন ভারতবর্ষ আক্রমণ করলেন তখন ইউরোপীয় লোকেরা ভারতের ধান, কার্পাস, চিনি, তিলের তেল, লাক্ষা, দামী শাল, সুরা, মদ, গন্ধ দ্রব্য, জটা মাংসী (এক ধরণের উদ্ভিদ, যার শিকড় কাঠের মতো শক্ত। যা বিভিন্ন প্রকার আয়ুর্বেদ ওষুধ প্রস্তুতিতে কাজে লাগে।) ইত্যাদি জিনিসপত্র অনেক আগে থেকেই ব্যবহার করে আসছে।

আলেকজান্ডারের মতই ভাস্কো দা গামাও ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আলেকজান্ডারের যেমন সব সময়ে মনে ছিল কীভাবে তিনি তার টায়ার নগরীকে বিশ্বের উচ্চ স্থানে নিয়ে যাবেন। ভাস্কো দা গামাও চাইতেন তাঁর দেশ পর্তুগালের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে।

সমুদ্রের উপরে শক্তি সঞ্চয় না ঘটাতে পারলে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অবাধে বাণিজ্য করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই সবার প্রথমে দরকার জলপথ আবিষ্কার করা। আর এই পথ আবিষ্কার না করতে পারলে কম সময়ের ভিতরে কিছুতেই ইউরোপ থেকে এশিয়া মহাদেশে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।

এই কথাটি যখন ভাস্কো দা গামার মাথাতে এল, তখন থেকেই তিনি বদ্ধপরিকর হলেন কীভাবে ভারতে যাওয়ার জলপথ আবিষ্কার করা যায়। তিনি রাজার সঙ্গে কথা বলে এটাও ঠিক করলেন যে, নিজের দেশের লোকেদেরও বাণিজ্যের ব্যাপারে উৎসাহী করে তুলতে হবে। যাতে দেশান্তরে যাওয়ার সময়ে তাদের সমর্থন পাওয়া যায়, তাদের সাহায্য পাওয়া যায়। কেননা বিপুল পরিমাণ রাজশক্তি অর্থাৎ সেনা দরকার এই বাণিজ্যের জন্যে। সমুদ্রে কত কত জলদস্যু আছে, আছে কত শত শত্রুপক্ষ, ধনলোভী বণিক সম্প্রদায়, তারা পরস্পরের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বরূপ। একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে অন্যের ধন আত্মসাৎ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত নয়। আছে প্রাণহানির আশঙ্কা। সুতরাং বাণিজ্য করতে হলে বাণিজ্যতরীর সঙ্গে রাখতে হবে রণতরীও।

ভাস্কো দা গামা শুধুমাত্র একজন জ্ঞানী ভূপর্যটক, দক্ষ বণিক কিম্বা সাহসী যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি একাধারে যেমন ছিলেন রাজনীতিবিদ, তেমনি ছিলেন কুশলী সমরনীতি বিশেষজ্ঞ।

এই সকল গুণের জন্যে রাজার খুব কাছের মানুষ ছিলেন ভাস্কো দা গামা। অনেক বিষয়ে তিনি রাজাকে পরামর্শ দিতেন।
পর্তুগালের রাজা একদিন ভাস্কো দা গামার সঙ্গে এই জলপথ আবিষ্কারের ব্যাপারে আলোচনা করলেন। নৌপথে আফ্রিকা মহাদেশ হয়ে ভারতে আসার বাণিজ্য পথ কীভাবে আবিষ্কার করা যেতে পারে, সে সম্বন্ধে নানান কথা বললেন। ভারতের মশলা, হাতির দাঁত, বস্ত্র, সোনা, রূপা, রেশমজাত দ্রব্য কীভাবে পর্তুগালে আনা যায় সে ব্যাপারে তিনি বদ্ধপরিকর। শুধু রাস্তাটা বের করা দরকার।

ভাস্কো দা গামা জানালেন এই একই বিষয় তাঁকেও ভাবাচ্ছে।
সুদুর অতীতকাল থেকে স্থলপথে এবং জলপথে মিশর, আরব এবং ফিনিশিয়বাসীরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবসায় লিপ্ত আছে। আনুমানিক যীশু খ্রিস্টের জন্মের আটশো-নয়শো বছর আগে থেকেই তারা নিয়মিত ভারতে এসেছে ব্যবসার কারণে। লোহিত সাগর হয়ে আরব সাগরের পাড়ে গুজরাতে এসে সেখান থেকে সোনা, রূপা, রক্ত চন্দন, হাতির দাঁত, বানর, ময়ূর ইত্যাদি সব কিনে নিয়ে যেত। মূলত স্থলপথেই যাতায়াত চলত। সেই সময়ে আরববাসীরা নানান মশলা, সুগন্ধী দ্রব্য ভারত থেকে কিনে নিয়ে অন্যান্য দেশে কয়েকগুণ অধিক দামে বিক্রয় করত।

ভারত থেকে দারুচিনি, গোল মরিচ, এলাচ, লবঙ্গ ছাড়াও ধূপ, ধুনা, চন্দন কাঠের জিনিস কিনে নিয়ে যেত।

(ক্রমশ)