• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

ভাস্কো দা গামা

ভাস্কো দা গামা ছিলেন একজন পর্তুগিজ পর্যটক। তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিস্টব্দে। ইউরোপ থেকে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপথে ভারতে আসেন। ১৪৯৮ সালের ২০ মে ভারতের কালিকটে পৌঁছান তিনি। তখন কালিকটের রাজা ছিলেন জামোরিন। ভাস্কো দা গামাকে সংবর্ধনা জানান তিনি। সেই ভাস্কো দা গামার ছোটবেলা থেকে জীবনের নানান কাহিনি ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ছন্দা বিশ্বাস।

গত সপ্তাহের পর


সূর্য তখন মধ্য গগনে। দ্বিপ্রহরে যাত্রীরা সকলে যখন একটু বিশামে রত এস্তেভাও কতবার ডাকলেন গামাকে, ‘এসো, একটু জিরিয়ে নাও, সেই কোন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে চলে এসেছ বল তো? বিকেলে হলে একটু রোদের তেজ পড়লে না হয় আবার দেখা যাবে। এখনও আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে। অনেক দিন লাগবে। তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে তো?’

কিন্তু ভাস্কো দা গামা অনড়, কিছুতেই সে এই জায়গা ছেড়ে যেতে রাজি নয়। সেই সময়টুকুর ভিতরে না দেখা কত কিছু চলে যাবে ওর আর কোনোদিন দেখা হবে না।

ভাস্কো দা গামা ডেকের উপরে দাঁড়িয়ে নাবিকদের মুখে কত বিচিত্র ধরনের রোমহর্ষক সব গল্প শুনছে, খালাসিদের কাছ থেকে এটা সেটা জেনে নিচ্ছে। অনেকেই এই কিশোর বালকের কথা শুনে ভাবছে এইটুকুন একরত্তি ছেলে এতসব জানলে কোত্থেকে?

নাবিকদের ভিতরে একজন এগিয়ে এলেন ভাস্কো দা গামার দিকে। ভাস্কো দা গামা তখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল দূরের আকাশ যেখানে সাগরকে স্পর্শ করেছে।
‘এই ছেলে, তোমার নাম কি?’
ভাস্কো দা গামা ঘাড় ঘোরাল নাবিকের গলা শুনে।
‘আমায় বলছেন কিছু?’
‘তা নয়তো কি? এখানে তোমার মতো ক্ষুদে বালক আর কে আছে? আমার নাম ভাস্কো দা গামা।’
দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল গামা।
‘তোমার বাড়ি কোথায়?’
‘সিনেসে।’
‘তুমি তো একা আসোনি, কে আছে তোমার সঙ্গে?’
‘আমার বাবা আছেন। ওই যে ওইদিকে বিশ্রাম ঘরে।’

একজন খালাসি নাবিকের কানে কানে জানাল, ‘মি. এস্তেভাও দা গামা, সরকারের খাজনা আদায়কারী, নাম শোনোনি? এককালে সেনার চাকরি করতেন, সিনেসে থাকেন, নামজাদা লোক। সিনেসে এমন কোনো লোক নেই যে এস্তেভাওয়ের নাম শোনেনি।’

নাবিকটা কেমন বোকা বোকা মুখ করে খালাসির কথায় ঘাড় নাড়াল। যেন এস্তেভাওকে না চেনাটা অপরাধের ব্যাপার।
নাবিকটি এবারে ভাস্কো দা গামাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি বাবার সঙ্গে কোথায় যাচ্ছ? এতটুকু বয়সে কাজের ধান্দায় নিশ্চয়ই নয়?’

নাবিকটির কথাবার্তা মোটেও ভালো নয়। কেমন যেন রসকষহীন কাটখোট্টা টাইপের।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও গামা উত্তর দিল, ‘কাজ? কিসের কাজ? আমি কোনো কাজে যাচ্ছি না।’
‘তাহলে কি অকাজে যাচ্ছ?’
‘আমি ইভোরাতে যাচ্ছি পড়াশুনার জন্যে।’
‘কেন সিনেসে কী হল? ওখানে কি ভালো কোনো স্কুল নেই?’
‘এখনকার পাঠ আমার শেষ হয়ে গেছে। আমি গণিত আর সমুদ্র-বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে যাচ্ছি। ইভোরাতে বড়ো বড়ো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, নামজাদা বহু জ্ঞানী গুণী মানুষ আছেন।’
কয়েকজন খালাসি নিজেদের ভিতরে তাস খেলায় ব্যস্ত ছিল। ডেকের একপাশে বসে তারা খেলছিল। ভাস্কো দা গামার কথা শুনে তারা সকলে একবার তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছে ছেলেটি।
‘তা ইভোরাতে যাবে যখন তখন এই পথে কেন এলে?’
নাবিকটি বলল।
‘আমরা প্রথমে লিসবনে আমার বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে যাবো, তারপর সেখান থেকে ইভোরাতে যাবো।’
এতক্ষণে নাবিকটির কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হল।
নাবিকটি এরপর ভাস্কো দা গামার কাছ থেকে সরে গিয়ে জাহাজের অন্য প্রান্তে চলে গেল। জাহাজের মাস্তুলগুলোকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
কয়েকজন খালাসিকে সতর্ক করে গেল আজ বিকেলে সামনের বন্দরে জাহাজ নোঙর করতে হবে। সেখান থেকে কিছু খাবার-দাবার আর পানীয় জল তুলে নিতে হবে।
ভাস্কো দা গামা গালে হাত রেখে ভাবছিল সামনে এবারে কোন বন্দর পড়বে?
ওদের জাহাজটা উপকূল বরাবর চলছিল। জাহাজের ডেক থেকে সাগর পাড়ের অনেক কিছু দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সবুজ গাছপালা আর জেলেদের কিছু অস্থায়ী বাড়ীঘর।
দূরে একটা লাইট হাউস দেখা যাচ্ছে।
কী সুন্দর ছবির মতো সব কিছু।

ভাস্কো দা গামার ভালো লাগছে দূর থেকে বাতিঘর দেখতে। সাগরের পাড়ে অনেক উঁচু করে তৈরি করে রাখা হয়েছে এইসব লাইট হাউসগুলো। বাবার কাছে জেনেছে সাগরে মহাসাগরে চলতে চলতে দিকভ্রষ্ট নাবিকদের সাহায্যের জন্যে তৈরি করা হয়েছে এই লাইট হাউসগুলো। রাতের দিকে উত্তাল তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দেওয়ার সময়ে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েন নৌকার মাঝি এবং নাবিকেরা। চারিদিকে অসীম জলরাশি। তাঁরা তখন বুঝতেই পারেন না কোথা থেকে এসেছেন এবং কোথায় যাচ্ছেন। তাঁদের গন্তব্যপথই বা কোথায়! কোথায় নোঙর করবেন তাঁদের জলযান।
তখন এই লাইট হাউসগুলো সেইসব বাণিজ্যজাহাজ, মাছ ধরা নৌকা, কিম্বা পণ্যবাহী জলযান, যাত্রীবাহী জাহাজের নোঙরের হদিশ দেয়। সঠিক দিক নির্দেশ করে। যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন এখানে কাছেই সমুদ্র বন্দর আছে। প্রয়োজনে তাঁরা সেইস্থানে এসে তারপর তাঁদের যাত্রাপথ ঠিক করতে পারবেন।

ভাস্কো দা গামা দেখল নাবিকটা তার কাছ থেকে সরে গিয়ে একটা চোঙা মতো জিনিসে চোখ রেখে বহুদূরের কিছু দেখার চেষ্টা করছে। এটা এমন একটা যন্ত্র যার সাহায্যে দূরের জিনিস বেশ ভালভাবেই দেখা যায়। নাবিকটির হাতে ছিল একটি ম্যাপ এবং একটি গোলাকার চুম্বক। ভাস্কো দা গামার খুব ইচ্ছে করছে চুম্বকটিকে একবার হাতে নিয়ে দেখার। বাবার মুখে শুনেছে সাগর পাড়ি দিতে চুম্বকের উপরে নির্ভর করতে হয় নাবিকদের। দিনের বেলাতে তো সুর্যের অবস্থান দেখে নাবিকেরা বুঝতে পারেন। কিন্তু রাতের বেলা তারারা দিক নির্দেশ করলেও অনেক সময়ে আকাশে মেঘ থাকে, তারাদের সেইভাবে না দেখা গেলে তখন চিন্তায় পড়ে যান নাবিকেরা। তখন এই চুম্বকই তাঁদের দিক নির্দেশের কাজে লাগে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ভাস্কো দা গামা এগিয়ে যান নাবিকের দিকে।
নাবিকটি ভাস্কো দা গামাকে দেখে বলে, ‘কী ব্যাপার তুমি এখানে?’
ভাস্কো দা গামা তার হাতের কম্পাসটাকে ইঙ্গিত করে।
নাবিকটা বুঝতে পেরে কম্পাসটা হাতের পরে নিয়ে ভাস্কোডাগামাকে দেখায়।
ভাস্কো দা গামা অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে কম্পাসের দিকে। যেভাবেই ঘোরানো হোক না কেন কম্পাসটা উত্তর-দক্ষিণ মুখ করে আছে।

গোলাকার কম্পাসের গায়ে শূন্য থেকে শুরু করে অসংখ্য দাগ কাটা আছে। শূন্যের দিকে যেখানে কাঁটাটা স্থির হয়ে আছে সেদিকটা উত্তরদিক। আর তার উল্টোদিকের কাঁটাটার অভিমুখ হল দক্ষিণ দিক। এই দুটো দিক জানতে পারলে বাকি দিকগুলো তো সহজেই জানা যাবে। ছেলেটির জানবার কৌতূহল দেখে এরপর নাবিকটি ম্যাপ খুলে ভাস্কো দা গামার সামনে মেলে ধরলেন। তাদের জাহাজ কোথা থেকে ছেড়েছিল এবং কোথায় যাবে সেটা ম্যাপ দেখে বলে দিলেন। ভাস্কো দা গামার চোখ আনন্দে এবং বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

সেই কাঠখোট্টা মানুষটা হঠাৎ করে তার বন্ধু হয়ে গেলেন।
নাবিকটি এরপরে ভাস্কো দা গামাকে সঙ্গে করে জাহাজের ক্যাপ্টেন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেইখানে নিয়ে গেলেন।
জাহাজের হুইল ধরে দাড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন।
নাবিকটি ক্যাপ্টেনের কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বললেন।
ক্যাপ্টেন কিশোর ভাস্কো দা গামার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘শুনলাম তুমি নাকি মস্ত বড় নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখো?’

ভাস্কো দা গামা মাথা নাড়ল। সত্যিই সে মস্ত বড় নাবিক হতে চায়। জাহাজে করে সমস্ত পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে চায়।
এস্তেভাও কেবিনে বসে ভাবছিলেন সিনেস থেকে লিসবনের দুরত্ব তো কম নয়। দুটি শহরই সমুদ্র উপকূলে। আবার ইভোরা সমুদ্র থেকে বেশ খানিকটা ভিতরে। স্থল পথে যেতে হলে অনেকটা ঘুরপথে যেতে হবে। কিছুটা হেঁটে নয়তো ঘোড়ার পিঠে চেপে। কোথাও নদী পড়বে, দুস্তর অরণ্য পড়বে। ভাস্কো দা গামার বয়সটা বেশ কম। এতোটা পথ সে কীভাবে চলবে?

অন্যদিকে লিসবনে যেতে গেলে এখনও বেশ খানিকটা সময় দুর্দমনীয় সাগর পথ পাড়ি দিতে হবে। আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউ, ছোটোখাটো জাহাজ এবং নৌকাগুলিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সেই ঢেউ যেন মোচার খোলার মতোই মাথার উপরে তুলে নাচায়। উল্টে-পাল্টে ছত্রখান করে দেয় সময়ে সময়ে। কত বড়ো বড়ো জাহাজ যে আটলান্টিকের বুকে পাড়ি দিতে গিয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে, সেই খবর কেউ কোনোদিন পায়নি।
মহাসাগরের খামখেয়ালিপনা বোঝা দুঃসাধ্য।

(ক্রমশ)