ভাস্কো দা গামা

গত সপ্তাহের পর

লিসবনে পা দিতেই দেখা হয়ে গেল বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধু পাওলো এস্তেভাওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কতদিন বাদে দুই বন্ধুর দেখা হল। তারপর গামার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই তোমার ছেলে? বাহ, খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে তো। একেবারে তোমার গিন্নির মতো, তাই না?’

এস্তেভাও ঠোঁটের কোণে ঝোলা হাসি নিয়ে মাথা নাড়লেন। চোখে মুখে বাৎসল্য স্নেহের আঁকিবুকি।
এবারে পাওলো সস্নেহে বালক গামার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অনেক বড় হয়ে গেছে।’
‘হুম, ও আমার তৃতীয় সন্তান।’

ভাসস্কো দা গামা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পাওলো আঙ্কেলের মুখের দিকে। এত সুন্দর করে কেউ কথা বলতে পারে, চোখে না দেখলে কানে না শুনলে বিশ্বাস করা যেত না। এমন স্নেহসুলভ কথা সেই বালক বয়েসেই গামাকে মানষুটার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় ভরিয়ে তুলল।


কথা বলতে বলতে তাঁরা বাড়িতে ঢুকে গেলেন। এস্তেভাও এবং ভাস্কো দা গামাকে দেখে বন্ধুপত্নী খুশী হয়ে তাঁদের সাদরে আপ্যায়ন করে ঘরে ডেকে নিলেন।

এস্তেভাও বন্ধুপত্নীর হাতে তুলে দিলেন সিনেস থেকে আনা পেয়ারা, কাজু বাদাম, ঢেড়শ, মরিচ, কামরাঙা এবং টিন ভর্তি শুকানো টুনা মাছ।

প্রথমে কিছু শুকনো ফল দিয়ে বানানো কেক জাতীয় মিষ্টি খাবার, এক প্রকার সামুদ্রিক মাছের ফিলে দিয়ে বানানো খাবার আর পানীয় দিয়ে তাঁদের আপ্যায়ন করলেন। খাওয়ালেন আলফান্সো আম দিয়ে বানানো শরবৎ। বন্ধুর জন্যে সুদৃশ্য গ্লাশে দামী মদ ঢেলে দিলেন। চেরি ফল দিয়ে বানানো মদ। নিজেও একটা গ্লাসে মদ ঢেলে খাওয়া শুরু করলেন।
কত কথা জমে আছে। একে একে দুইজনে সেই সব কথা বলা শুরু করলেন।

ভাস্কো দা গামাকে ভিতর বাড়িতে নিয়ে গেলেন নতুন আন্টি। ভাস্কো দা গামা বাড়ির বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে গেল। খেলার সঙ্গী হতে আবার সময় লাগে নাকি।

বেলা গড়িয়ে এখন দুপুর হতে চলল। তাই আর কিছু খেতে না দিয়ে সরাসরি মধ্যাহ্ন ভোজের জন্যে তারা প্রস্তুত হলেন।
বন্ধুপত্নী নিজের হাতে রকমারী সব খাবার প্রস্তুত করেছেন। কড মাছ, সার্ডিন মাছ, ম্যাকারেল ইত্যাদি মাছেরই হরেক রকমের পদ রেঁধে খাওয়ালেন।

পরের দিন তাঁরা রওনা দিলেন ইভরার উদ্দেশে। কিছুটা পথ হেটে কিছুটা পথ ঘোড়ায় চেপে পরের দিন তাঁরা ইভোরাতে পৌঁছান। ইভরাতে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই পাওলো উপস্থিত ছিলেন বন্দরে। বহুদিন বাদে আবার তাঁদের দুই বন্ধুর দেখা হল।

বন্দরে উপস্থিত কয়েকজনের সঙ্গে এস্তেভাওয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। কথা বলতে বলতে এস্তেভাও জানলেন পাওলো একসময়ে সিনেসেই ছিলেন। সামরিক পদে থাকার সময়েই এস্তেভাওয়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ পরিচয় হয়েছিল। সে আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। তারপর আর যোগাযোগ ছিল না বহুকাল। বহুদিন অদেখার ফলে ভুলেই গিয়েছিলেন যে তিনি এখন ইভোরাতে থাকেন। সেদিন হঠাৎ বন্ধুর চিঠি পেয়ে তিনি উল্লসিত হলেন। আজ আবার অনেক দিন বাদে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগল।

তখনি এস্তেভাও সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে ইভোরাতে রেখে লেখাপড়া শেখাবেন। বন্ধুপত্নী তাঁদের সকলকে সানন্দে আপ্যায়ন করলেন। খুব খুশি হলেন, তিন বন্ধু একজায়গায় হয়ে অনেক গল্পগুজব করলেন।

বন্ধুপত্নী নিজের হাতে হরেক রকমের রান্না করে খাওয়ালেন। দুপুরে কড, টুনা মাছের রকমারি পদ, শূকরের মাংস রান্না করলেন। সঙ্গে ছিল আনারসের তৈরি মিষ্টি পদ।

রাতে খাওয়ালেন ঝলসানো গরুর মাংস, মদ, আর গাজর, বাঁধাকপি, পেয়াজ, রসুন, চিলি দিয়ে বানানো ‘রে ফিশ’-এর একটি পদ। সঙ্গে দামি মদ। ফুল, গুল্ম জাতীয় উদ্ভিতের নির্যাস, বাদাম, আমন্ড এবং ক্রিমের সঙ্গে পরিস্রুত স্পিরিট দিয়ে বানানো সুস্বাদু মদ।

বন্ধু পাওলোর নিজেরই চারটি ছেলেমেয়ে। তারা সকলে গামাকে আপন করে নিল। বন্ধুপত্নী খুব যত্ন করে গামাকে খাওয়ালেন। এস্তেভাও দেখে মনে মনে শান্তি পেলেন।

গামা খেতে খেতে মায়ের কথা মনে করল। মাকে ছেড়ে থাকতে তার কষ্ট হবে ঠিকই কিন্তু নতুন এই আন্টিও ভীষণ ভালো। ঠিক তার মায়ের মতোই স্নেহশীলা। খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন। আর ছেলেমেয়েদের খুব ভালবাসেন।
বন্ধু পাওলো এস্তেভাওকে কথা দিলেন, গামার কোনোরকম যত্নের ত্রুটি হবে না। তার পড়াশুনার দিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। গামা তাঁর নিজের সন্তানের মতোই তাঁর কাছ থাকবে।

তবে এস্তেভাওকে একটা কথা বললেন, সে যেন মাঝে মাঝে এখানে আসে। পারলে গামার মাকেও সঙ্গে আনার কথা বলে দিলেন।

অবশেষে যাবার দিন এসে গেল।
বন্ধু এস্তেভাওকে জাহাজে তুলে দিতে এলেন পাওলো। সঙ্গে ভাস্কো দা গামাও এসেছে।
জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত সকলে অপেক্ষা করলেন।

বাবা এস্তেভাও ভাস্কো দা গামাকে ইভরায় বন্ধুর কাছে রেখে ফিরে বিষণ্ণ মনে ফিরে এলেন।
তবে গামা বাচ্চাদের সঙ্গে সুন্দর মিশে গেছে দেখে তাঁর ভাল লাগল। অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন ভাল লাগল বন্ধুপত্নীর ব্যবহার দেখে। গামা সেখানে ভালোই থাকবে মনে ভেবে একটু স্বস্তি পেলেন।

বাবা চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েকদিন তার খুব মন খারাপ করছিল। মনে পড়ছিল মায়ের কথা। অন্যান্য ভাই বোনেদের কথা। মন কেমন করছিল তার জন্মস্থান সিনেসের জন্যে। আবার কবে যেতে পারবে কে জানে।

তবে এ মন খারাপ খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠল নতুন আন্টির স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে। ভালোবাসায় তিনি ভুলিয়ে দিলেন গামার সকল দুঃখ। নিজের ছেলেদের মতোই আদর যত্নে বেড়ে উঠতে লাগল ভাস্কো দা গামা। ইভোরার দিনগুলো স্বচ্ছন্দ গতিতে এগিয়ে চলল।


ইভরা হল পর্তুগালের রাজধানী শহর। এই শহরে রয়েছে বহু প্রাচীন যুগের রোমান দেবতাদের সব মন্দির। আছে দেবী ডায়নার মন্দির। গ্রীক পুরাণে তিনি আবার অরণ্যের দেবী। ভালোবাসেন বনে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে। তাঁকে শিকারের দেবী বলা হয়।
এ ছাড়াও আছে গথিক স্থাপত্যে তৈরি ‘ক্যাথিড্র্যাল অফ ইভরা’।

ভাস্কো দা গামা খুব ছেলেবেলা থেকে বাবার মুখে শুনে আসছে এই শহরের কথা। জ্ঞান- বিজ্ঞান সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হল এই ইভরা শহর। যাঁরা জ্ঞানী, যাঁরা বিদ্যান, তাদের দেশের বিখ্যাত সব পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁদের সকলেই একবার না একবার এই শহরে পা রেখেছেন। দূর দূর থেকে বহু জ্ঞানপিপাসু মানুষ এখানে পড়তে এসেছেন।

সেই থেকে এই ইভরা শহরের প্রতি একটা ভালবাসা জন্মে গেছে ভাস্কো দা গামার। কল্পনায় সে যেন দেখতে পেত শহরটাকে। মনে মনে ভাবতো, কবে বড় হবে আর এই শহরে পড়তে আসবে। আজ তার সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে।
পাওলো আঙ্কেল তাকে এখনকার একটা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেন। ভাস্কো দা গামা গণিতের পাশাপাশি সমুদ্রবিদ্যা এবং জাহাজ চালনা বিদ্যাও শিখতে লাগলেন। এই দুটি বিষয়ে সে বিশেষভাবে জ্ঞান অর্জন করতে লাগলো।
ভাস্কো দা গামা কিশোর বয়স পেরিয়ে আস্তে আস্তে যৌবনে প্রবেশ করল।

এখানেই ভাস্কো দা গামা তার বিদ্যাশিক্ষা সম্পূর্ণ করল। এই কয়েক বছরে সে মোটামুটি ইভরা শহরের সমস্ত দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ দেখে ফেলে। সে যায় দেবী ডায়নার মন্দিরে। রোমানদের দেবী ডায়না হলেন চাঁদের দেবী। বহু প্রাচীনকাল থেকে রোমানরা দেবী ডায়নার আরাধনা করে আসছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে নির্মিত হয়েছিল এই মন্দির। যার উচ্চতা ছিল ১৫ মিটার এবং প্রস্থে ২৫ মিটার।

ছুটির দিনগুলিতে গামা বেরিয়ে পড়ত। সে ঘুরে ঘুরে দেখত এই শহরের প্রাচীন দুর্গ, প্রাসাদ, দেব দেবীর মন্দির।
আর ছুটির দিনে একবার এসে দাঁড়াত সাগরপাড়ে, বেলাভূমিতে। আঙ্কেলের বাড়িটি ছিল সমুদ্র থেকে অনেক দূরে। সিনেসে তাদের বাড়ির মতো নয় যে হাত বাড়ালেই সাগর।

ছুটির দিনে চলে আসত সাগরতীরে। সাগরের নীল নিঃসীম জলরাশির দিকে তাকিয়ে মায়ের কথা মনে করত। আর ঢেউ গুণত। নুলিয়াদের মাছ ধরা দেখত। আর দেখত কত কত নিত্য নতুন জাহাজ, নৌকা। মাছ ধরার ছোটো নৌকাগুলো সারাটা রাত সমুদ্রে ভেসে বেড়াত। সিনেসে থাকাকালীন গভীর রাতে এই মাছ ধরা নৌকাগুলোর আলো এসে তার চোখে পড়ত। মনে হত গোটা আকাশ যেন সাগরে নেমে এসেছে।

সেইসব কথা ভেবে তখন তার খুব বাড়ির জন্যে মন কেমন করত। মায়ের কথা, ভাই বোনেদের কথা, বাবার জন্যে মন কেমন করত।

মায়ের কথা ভেবে এই কয়েক বছরে ধরে ঢেউয়ের সঙ্গে চলে আসা ঝিনুক, ছোটো শামুক, সুন্দর সুন্দর সব শঙ্খ, স্টার ফিশ, কত কত জিনিস যে যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছে ভাস্কো দা গামা!
পড়া শেষ করে সে যখন ফিরবে তখন এইসব জিনিস নিয়ে যাবে বাড়িতে।

ভাস্কো দা গামা এখানে পড়াশুনা করতে করতেই নাম শুনল জ্যোতির্বিদ আব্রাহাম জাকুটোর। সকলেই তাঁকে ভীষণ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। অসাধারণ পাণ্ডিত্য তাঁর। ভাস্কো দা গামা চিন্তা করল যে ভাবেই হোক সে জাকুটোর কাছে নৌবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা নেবে।

এরপর সে নতুন করে পাঠ নেয় আব্রাহাম জাকুটোর কাছে। নৌ চালনায় পারদর্শী হতে গেলে জ্যোতির্বিদ্যা শেখাটা দরকার। আর সেই সময়ে আব্রাহাম জাকুটো ছিলেন বিখ্যাত একজন জ্যোতির্বিদ, জ্যোতিষী, গাণিতিক, ঐতিহাসিক এবং একজন রাব্বি। পরবর্তীকালে তিনি হলেন রাজা জন টু-এর রাজসভার শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষী। যাকে বলে রাজ-জ্যোতিষী তিনি সেই পদে বসলেন। এরপরে তিনি বহু জিনিস বানাতে সক্ষম হলেন রাজার অনুগ্রহে।

জাকুটো সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা অ্যাস্ট্রোল্যাব বানালেন। যেটা সমুদ্রের ল্যাটিচ্যুড মাপতে ভীষণ কাজে লাগবে। তখনকার দিনের নাবিকেরা খুবই অসুবিধায় পড়তেন। জাকুটো নাবিকদের কথা মাথায় রেখেই বানিয়ে ফেললেন এই অ্যাস্ট্রোল্যাবটি। হিব্রু ভাষায় তিনি লিখে ফেললেন একটি বই। যার নাম,- ‘হা, হিব্বুর হা গাডল’ (Ha, Hibbur Ha Gadol)। ইংরাজিতে যার অর্থ দাঁড়ায়— ‘দ্য গ্রেট বুক’।

১৪৭০ থেকে ১৪৭৮ এই আট বছর ধরে তিনি বইটা লিখলেন।

আব্রাহাম এই বইটিতে জ্যোতিঃপদার্থ বিদ্যার উপরে নানান কথা লিখেছেন। চাঁদের কথা লিখলেন, সুর্যের অবস্থানের কথা লিখলেন। আর লিখলেন অন্যান্য পাঁচটি গ্রহ সম্পর্কে। তিনি বানিয়ে ফেললেন একটি ‘আলফনশাইন টেবল’ (Alfonsine Table)। এর আগে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সম্পর্কে যে কথা কেউ বলেননি সেই সব কথা লিখলেন। পরবর্তীকালে চাঁদে যে আগ্নেয়গিরির সন্ধান পাওয়া গেছে উত্তর-পশ্চিমে ‘উইলকিন্স’, পূর্বে ‘লিন্ডেনিউ’, দক্ষিণ-পূর্বে ‘রাব্বি লেভি’ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের নাম হল ‘সেলসিয়াস’।­
(ক্রমশ)