‘অপেক্ষার মৃতু্য নেই, ছুঁয়ে থাকে শুধু সংশয়ভূমি’

সৈয়দ হাসমত জালাল

‘বৃক্ষ, আমি ও আমরা’ মোস্তাক আহমেদের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ৷ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও মনোজ্ঞ সম্পাদক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছেন মোস্তাক৷ একক বা যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘ঈশ্বরী : বিনয় মজুমদার’, দেবেশ রায়ের সাক্ষাৎকার সংকলন ‘চাপান-ওতোর’, ‘শতবর্ষে মান্টো : ফিরে দেখা, ফিরে পাওয়া’, ‘বাংলা নাটকে লোকনাট্যের প্রভাব’ প্রভৃতি গ্রন্থ৷ বোঝাই যায় তাঁর পাঠ ও ভাবনার ভুবনটি বিচিত্রমুখী ও বিস্তৃত৷

তবে কবিতার প্রতি তাঁর মুগ্ধতা আশৈশব৷ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘নির্জনতার আত্মকথা’৷ তাঁর আলোচ্য কবিতাগ্রন্থ ‘বৃক্ষ, আমি ও আমরা’র ব্লার্বে লেখা আছে, ‘চরম নীরব অতল থেকে উঠে আসে কবিতা৷ তারপর কথারা অবগাহন করে আর এক নিঃসীম নীরবতায়৷ কবিতা হাঁটতে থাকে শেষহীন স্তব্ধতার দিকে৷’ তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থের নাম কিংবা আলোচ্য গ্রন্থের এই উদ্ধৃত কথাগুলি থেকেই বোঝা যায় এই কবির চিন্তা-চেতনা গভীরতাপ্রয়াসী৷ পারিপার্শ্বিক জীবনের কোলাহলকে শুষে নিয়ে এক নিবিড় নীরবতাই তাঁর সাধনভূমি৷ এই নীরবতার মধ্যেই তাঁর নির্মাণ, তাঁর সৃজনের সচেতন উষ্ণতা এবং চোরা আগ্নেয়স্রোত৷
‘জীবনদেবতা’ ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত দেবতা৷ মোস্তাকের এই গ্রন্থে ‘জীবনদেবতা’ নামে একটি কবিতা আছে৷ বোঝাই যায়, এই দেবতা কোনও প্রথাগত ধর্মীয় দেবতা নয়৷ এই দেবতা আসলে চেতনার স্বাভাবিক বিশুদ্ধি, যে শুদ্ধতার মধ্যে দিয়েই উপলব্ধি করা যায় এক পরমকে৷ মোস্তাক লেখেন— ‘যে বোধ ক্রমশ নীরবতার দিকে নিয়ে যায়,/ অন্ধ হয়েও জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে ফেলা অনায়াসে, / সে তো তোমারই দান, অকৃপণ হাতে বিলিয়েছ যা৷’


দৈনন্দিন জীবনের, সমাজের, রাষ্ট্রের এবং বিভিন্ন ঘটনাবলীর যে অভিঘাত একজন কবির মনকে নাড়া দেয়, তা যে সবসময় খুব সুখকর, তা তো বলা যায় না৷ বরং এই ক্ষতবিক্ষত সময় কবিকে পীড়িত করে, বিষণ্ণ করে৷ আার সেজন্যেই তাঁর ‘প্রার্থনা’— ‘আপন যা কিছু সঞ্চয়, কেলাসিত, জমাট-বাঁধা প্রস্তর, / ডুবে যায়, ফেলে আসি, ঘর্ষণে ঘর্ষণে বজ্রপাত, / চোরাপথ, ধু-ধু মাঠ কেবল, কেবলই আর্তি জানায়৷’

‘বৃক্ষ, আমি ও আমরা’ শীর্ষক কবিতাটি, যার নামে গ্রন্থটির নাম, পড়ে নেওয়া যাক৷ বৃক্ষ ও তার ছায়া ক্লান্ত পথিককে আশ্রয় দেয়৷ বৃক্ষ এখানে নিঃসন্দেহে একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে৷ আসলে এ তো জীবন ও তার অন্তর্নিহিত বোধ৷ সেই বোধের গভীর থেকেই উঠে আসে এরকম পঙ্ক্তিমালা— ‘বৃক্ষ জানে, নিজস্ব-স্থবিরতা ছায়াকেও গ্রাস করে৷ / বৃক্ষ জানে, শেষ বিন্দু নির্যাসও দিয়ে যেতে হবে৷ / এরপরও রাত্রি অাঁধার হবে, ঘোর কৃষ্ণ শীতল! / এরপরও বৃক্ষ পরিধি বাড়াবে, কচি পাতা অসীম!’ আসলে, স্থবিরতা তো নিজস্ব অর্জনকেই গ্রাস করে নেয়, স্থবিরতা তো মৃতু্যরই নামান্তর, তাই জীবনকে গতিময় রাখতে হয়, পরিধি বাড়াতে হয়৷ তবেই অসীম সম্ভাবনার দিক উন্মুক্ত হতে থাকে৷ এখানে ‘কচি পাতা অসীম’ সেই সম্ভাবনার ব্যঞ্জনাটিকেই খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুলে ধরেছে৷ আর সেজন্যেই সে বৃক্ষের কাছে বার বার ফিরে আসতে হয়৷

অন্য একটি কবিতা ‘হামাগুড়ি’-তে দেখি, সেই ব্যাপ্ত জীবনবোধ ও নিঃশেষ আশা-আকাঙ্ক্ষার এক নিবিড় সত্য ও ব্যঞ্জনাময় রূপ৷ ‘মৃতু্য চরম সত্যি জেনেও / একাকী বৃদ্ধ বসে থাকে / নড়বড়ে চেয়ারে৷’ জীবনের অনিবার্য একটি পরিণতি ও পরিস্থিতিকে সামান্য কয়েকটি শব্দে চমৎকার ফুটিয়েছেন কবি৷ এই মৃতু্যর দিকে ক্রম-অগ্রসরমান বৃদ্ধের সামনে কী থাকে— ‘সাদা কাপড়ে ঢাকা / তেপান্তরের সীমাহীন মাঠ৷’ কিন্ত্ত তাই বলে কি সব কথা শেষ হয়ে যায়, মুছে যায় জীবনের সব রং? না, তার পরেও কথার বর্ণময় বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে দেয় জীবন৷ ‘সেখানে কথা আছে বাকি, / কথার পিঠে কথারা কোলাহল করে৷ / হাত কাঁপে, / রং তবু ছড়ায় ক্যানভাসে৷’ ফুরিয়ে যেতে যেতেও এই উৎসারিত শব্দ-বর্ণ জীবনের প্রবহমান বোধকে বাঁচিয়ে রাখে৷

এরকম আরও একটি ছোট কবিতায় উঠে এসেছে পরিব্যাপ্ত জীবনবোধর কথা৷ কবিতাটির নাম ‘গ্রহণ’৷ ‘পূর্ণতার স্বাদ চেটেপুটে নেব ব’লে, / আজীবন নিজেকে বঞ্চনা করেছি৷’ বহু ত্যাগ ও বঞ্চনার মধ্যে দিয়েই একজন মানুষ পেতে চায় পূর্ণতার স্বাদ৷ কিন্ত্ত সে তো সহজ বিষয় নয়৷ এই সৃষ্টিই তো অপূর্ণ৷ তাই একসময় অভিমান বোধ করাই স্বাভাবিক৷ কারণ তার মধ্যে আছে গভীর ভালোবাসা, যে-ভালোবাসা দিয়ে সে পেতে চেয়েছে পূর্ণতাকে, পূর্ণতার উপলব্ধিকে৷ কিন্ত্ত তা না পেয়ে সে যখন অভিমানাহত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে চায়, তখনই সেই পরম তার পাশে এসে বসে৷ মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের পঙ্ক্তি— ‘তাই তো, প্রভু, হেথায় এলে নেমে, / তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে৷’ মোস্তাক লিখেছেন, ‘আজ যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি, / একরাশ বিশুদ্ধ অভিমানে, / ঈশ্বর এসে বসলেন পাশে৷’ কবির অভিমানের বদলে তিনি পেয়ে যান সেই পরমের মালা৷ আগেই বলেছি, এই ঈশ্বর প্রথাগত কোনও প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের ঈশ্বর নয়৷ এ বড় ব্যক্তিগত ঈশ্বর, চেতনার বিশুদ্ধির৷ এ সেই কাঙ্ক্ষিত পরম যেখানে সমস্ত সৌন্দর্যের নীরব উদ্ভাস৷

এর বিপরীতধর্মী জীবনের কিছু ছবি আমরা দেখে নিতে পারি এই গ্রন্থেব অন্যান্য কবিতায়৷ খুব ছোট কবিতা ‘প্রলাপ’৷ মাত্র তিনটি বাক্যে কবি এখানে ধরেছেন বর্তমান সময়টিকে৷ জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন৷’ আমরা কি সেই অসুখ থেকে মুক্তি পেয়েছি! না, পাইনি, বরং এই অসুখের শেকড় আরও গভীরে ছড়িয়েছে৷ মোস্তাক লিখেছেন— ‘পৃথিবীটাই আস্ত হাসপাতাল৷ / প্রত্যেকে অসুস্থ জেনেও / সুস্থতার ভান করি৷ / আমাদের অসুখ / ক্রমশ বেড়ে চলে৷’ মজার কথা, আমরা প্রত্যেকেই এই অসুস্থতার শিকার হয়েও সুস্থতার ভান করে চলি৷ আমরা ভালো নেই জেনেও বোঝাতে চাই, ভালো আছি৷ এক গভীর আত্মপ্রবঞ্চনা৷ এই অসুস্থতার নিরাময় কীভাবে হবে, থেকে যায় সে প্রশ্নও৷

‘অণু-পরমাণু কথা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন— ‘চারপাশের লক্ষ্মণ-গণ্ডিটা / ছোট হচ্ছে দিনকে দিন৷’ আমাদের চারপাশের এই শ্বাসরোধকারী সময় তো এভাবেই আমাদের জীবনের চারপাশের গণ্ডিটাকে আরও ছোট করে দিচ্ছে৷ আর তাই ‘চিৎকার— চিৎকার আকাশে কাঁপে, / ছায়াপথ থেকে ফিরে ফিরে আাসে প্রতিধ্বনি৷’ আমাদের চিৎকারের প্রতিধ্বনি শূন্য থেকে আমাদের কাছেই ফিরে আসে৷ আর ‘লক্ষ্মণ-গণ্ডিটা গায়ে চেপে বসছে ক্রমশ৷’

কবি বিনয় মজুমদারকে নিয়ে লেখা কবিতা ‘বিনয় মজুমদার’-এও দেখি ‘অসূয়া সময় নিরুৎসুক চারপাশ, / সিঁড়িভাঙা অঙ্কের বীভৎস আয়োজন৷’ কিন্ত্ত এই সমস্ত প্রচলকে তুড়ি মারার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিলেন বিনয় মজুমদারই৷ গভীর অন্ধকার থেকে একমুঠো উজ্জ্বল মেদহীন সাদা রোদ তুলে এনেছিলেন তিনি৷ আর তাই যখন ‘ধান দুলে ওঠে সোনালি আভায়,/ সোঁদা মাটি ছড়ায় প্রিয়জনের গন্ধ৷ / ভাঙা ঘরের উঠোনে তখন— / রোদ পোহান বিনয়, অক্লেশে৷’ একটি চমৎকার শ্রদ্ধার্ঘ্য৷

‘বিভূতিভূষণ’ কবিতাটিতেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি শুধু শ্রদ্ধার্ঘ্যই নয়, তারও অধিক কিছু সংবেদন ছড়িয়ে আছে৷ ‘প্রকৃতির কাছে নিঃসঙ্কোচে দু-হাত পাতি, / হাঁটু গেড়ে আর্তি জানাই, আলো নেমে আসে অরণ্যে, / ছুঁয়ে থাকি জল, মাটি, আকাশ— অকালবর্ষণে ভিজি৷’ একটি স্নিগ্ধ অনুভব উঠে আসে—‘আভূমি সঁপেছি সমুদয়, সমুদয় বিভূতিভূষণ৷’

তবে শেষ পর্যন্ত ‘বৃক্ষ, আমি ও আমরা’ কবিতাগ্রন্থের গর্ভে জেগে থাকে সংশয়ভূমি৷ ‘সংশয়ভূমি’ নামে তিনটি কবিতা রয়েছে এখানে৷ কবি বলছেন— ‘সার্কাস জমে গেছে, / জোকার ও দর্শক, / সব একাকার৷ / সারা দেশ জুড়ে তাঁবু / আকাশ দেখি না আর৷’ স্বদেশ আর ক্ষতবিক্ষত সমসময়কে তিনি তুলে এনেছেন এখানে— ‘আকাঙ্ক্ষা ছুঁয়ে থাকে মৃত শরীর, / ফুটিফাটা পায়ে রক্তাক্ত রাজপথ৷ / চলো মোমবাতি জ্বালাই, থালাতে বাসি ভাত— / ভাতে বড়ো পরিযায়ী পরিযায়ী গন্ধ!’ করোনাকালের পীড়িত, মৃত পরিযায়ী শ্রমজীবী মানুষদের কথা ভোলেন না কবি৷ কিন্ত্ত এমন নিঃসীম সংশয়ের মধ্যেও তিনি মনে করেন, আকাঙ্ক্ষার মৃতু্য নেই৷ এই আকাঙ্ক্ষাই তো সমস্ত ঝড়ঝাপটা আর প্রতিকূলতা সামলে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ বইটির প্রচ্ছদ, মুদ্রণ, বাঁধাই অত্যন্ত সুন্দর৷ প্রচ্ছদ করেছেন সৈকত সরকার৷
বৃক্ষ, আমি ও আমরা৷ মোস্তাক আহমেদ৷ প্রকাশক: লালমাটি প্রকাশন৷ মূল্য: ২০০ টাকা