মানস দে
সেই যখন পাড়ার মেয়েরা সকালবেলায় সা রে গা মা করে রেওয়াজ করত, সেই যখন পাড়ার ছেলেরা বেকার তকমা এড়ানোর জন্যে টাইপ আর শর্ট-হ্যান্ড শিখত, সেই যখন ছোট বাচ্চারা বায়োস্কোপওয়ালার পেছন হাফ প্যান্ট পরে দৌড়াত, তখন পাড়ার ভালো ছেলে নন্দদুলাল কোনো মেয়ের মুখোমুখি পড়লে তাকিয়ে দেখবার উদগ্র বাসনা বুকে চেপে মুখ নিচু করে বই-খাতা বগলদাবা করে টিউশন পড়তে যেত। সে অনেকদিন আগেকার কথা। সেই নন্দদুলাল সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কখন যে আরব সাগর, আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে গেল কে জানে! সেই নন্দদুলাল, যে এমনিই ছোট্টোখাট্টো কখন যে সত্যি সত্যি আরো গতর কমিয়ে ন্যাডি হয়ে গেল কে জানে! সেই নন্দদুলাল, ওরফে ন্যাডি, যে কোনোদিন আগে এই হিসেব করেনি, আজ একটা হিসেবে নিয়ে বসেছে। কীসের হিসেবে একটু পরেই জানতে পারবেন।
ন্যাডিকে নিয়ে খুব একটা মাতামাতি কেউ কোনোদিন করেনি। কারণ করার প্রয়োজন পড়েনি। ছোটবেলায় ন্যাডির জন্মদিন নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামায়নি। বছরের বাকি দিনগুলোর মতো দিনটা নিঃশব্দে এসে চুপিসারে বিদায় নিত, নন্দদুলাল বা কেউ সে দিনটাকে ধরে টানাটানি করে বড়ো করার চেষ্টা করেনি। কিন্তু গতকাল ন্যাডির ফ্যাশনেবল বৌ, শ্রেয়সী, সেই রকম একটা দিনের পঞ্চাশতম আবির্ভাব খুব ঘটা করে পালন করেছিল। অন্তত আয়োজন দেখে তো তাই মনে হচ্ছিল। সিলিকন ভ্যালির নামকরা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে বিশাল ব্যাংকোয়েটের আয়োজন। দামি স্যুটের মোড়কে ন্যাডি বৌ আর মেয়েকে পাশে নিয়ে কেক কেটেছিল। বোতল বন্দি কত তরল মুক্তির উল্লাসে নাচানাচি করতে করতে কত অতিথির পেট দিয়ে ধীরে ধীরে মাথার সব অনুভূতিকে যে গ্রাস করে দিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। ন্যাডিকেও সে দুলিয়ে দিয়েছিল। নেহাত বৌ আর মেয়ে ছিল তাই খুব বেশি খেতে পারেনি। তবুও পায়ের তলায় পৃথিবাটাকে টলিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট ছিল।
নন্দদুলাল এই দেশে আসা ইস্তক হঠাৎই ছোট হয়ে গেছে সে কথা তো আগেই বলেছি। আসলে পর্দার আড়ালে সেটার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। নন্দদুলাল উচ্চারণ করতে গিয়ে সাহেবরা কদাচিৎ লালে এসে পৌঁছতেন। তার আগেই চিৎপটাং হয়ে কী সমস্ত বিকট উচ্চারণ করতেন। সেই শব্দ নন্দদুলালের কানে কটাস কটাস করে বিঁধত। নন্দদুলাল তাই নিজেই সাহেবদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নিজেকে ন্যাডি বলে পরিচয় দিত। সাহেবদের অলস জিভ যাতে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হাঁপিয়ে না যায় তার ব্যবস্থা। তাই সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে ‘নন্দদুলাল’-কে খানিকটা নামিয়ে সমতলভূমিতে ছেড়ে দিয়ে, ন্যাডি করে দিয়েছে। এখন সে ইউনিভার্সাল ন্যাডি। এমনকি বাঙালি কম্যুনিটিতেও। তার ট্রেন্ডি বৌও ছা-পোষা বাঙালি নন্দদুলালকে পরিত্যাগ করে ন্যাডিকে বরণ করে নিয়েছে সেই কবে। বেচারা নন্দদুলালের খারাপ লেগেছিল বৌয়ের মুখে নন্দের বদলে ন্যাডি ডাক শুনতে। কিন্তু কিছু বলেনি। ন্যাডিকে নিয়ে গতকাল কত লোকে কত ভালো ভালো কথা বলল। এইটুকু ভালো কথাতে জন্মদিনে সবারই বোধহয় জন্মগত অধিকার থাকে।
অভ্যাসের দোষে আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে গেছে ন্যাডির। কালকের গিফটগুলো এখনো গাড়ির ডিকিতে বন্দি হয়ে আছে। ন্যাডি ভাবলো ওদের বরং মুক্ত করে দেওয়া যাক। সেই ভেবে একে একে গিফটগুলো গাড়ির পেছন থেকে নামিয়ে ঘরের মধ্যে এনে খুলে দেখতে লাগল। আর খামে কে কী লিখেছে তা পড়তে লাগল। প্রচুর ওয়াইনের বোতল পেয়েছে উপহার হিসাবে। বেশ কিছু উপহার দেখে ভাবতে লাগল মানুষের সুদূরপ্রসারী ভাবনার কথা। এদের অনেকগুলোকেই আবার রি-সাইকেল করা যাবে। রঙিন খামগুলোকে ছিঁড়ে কার্ডগুলো বের করে দেখছিল। বাইরে আলাদা হলেও ভেতরে প্রায় সবগুলোতেই একই লেখা— ‘হ্যাপি ফিফটিয়েথ’। শুধু একটা খামে লেখা— ‘দিস ইজ জাস্ট এ রিমাইন্ডার অ্যাবাউট ইওর আনফুলফিলড ড্রিমস ইন লাইফ। বেস্ট উইসেস ফর দোজ।’ কার্ডটার বহিরাবরণ বলার মতো কিছু নয়, কার্ডের সঙ্গে একটা খুব ভালো ফাউন্টেন পেন আরেকটা ছোট ফ্যাশনেবল রাইটিং প্যাড। রাইটিং প্যাডের তলায় লেখা আছে— ‘কিপ গেসিং।’ ন্যাডি এতক্ষণ রোবটের মতো একটা একটা করে গিফট খুলছিল, খাম ছিঁড়ছিল, আর সাইডে রেখে দিচ্ছিল। কিন্তু এই গিফটটায় এসে কে যেন সুইচ বন্ধ করে দিল। রাইটিং প্যাডের ওপর ইংরেজিতে লেখা— ‘কিউ-ফোর নট ফার। স্টার্ট নাও।’ সত্যি কথা বলতে কী, ন্যাডি প্রথমে ভেবে কোনো কুলকিনারা পেল না কথাটার মানে কী। বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকার পর রহস্যভেদ করে খুব আনন্দ পেল বটে, কিন্তু ওই ছোট্ট কয়েকটা শব্দ তাকে খুব ভাবাল।
পঞ্চাশ একটা সংখ্যা। মানুষের গড় আয়ু ধরলে অর্ধেক জীবন পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। ন্যাডি ভাবে, পুরো জীবনটা যদি একটা বছর হয় তাহলে এখনকার তারিখ মোটামুটি আগস্টের মাঝামাঝি। অন্যভাবে বললে কোয়ার্টার-থ্রি বা কিউ-থ্রি। মনে মনে একটা হিসেবে কষে জীবনের কোন কোয়ার্টারে কী পেয়েছে। কিউ-ওয়ানের প্রথম কয়েকবছর তার স্মৃতিতে নেই, থাকার কথাও নয়। তারপর থেকে বহু স্মৃতির জন্ম-মৃত্যু হয়ে কিছু বেঁচে আছে। মনে পড়ে ‘গোপাল বড়ো সুবোধ বালক’-এর গল্প। আজ আর মনে নেই সেটা জীবনের প্রথম না দ্বিতীয় না তৃতীয় গল্প। তবে গোপালের সঙ্গে নন্দদুলাল নিজের খুব মিল পেত। তাকেও সবাই পাড়ার সুবোধ বালক হিসাবেই জানত। এই সুবোধ বালকদের অনেক জ্বালা। বুক আর মুখের দূরত্ব অনেক বেশি। না হলে একবারের জন্যেও কেন মহুয়াকে নন্দদুলাল তার ভালো লাগার কথা বলতে পারল না! এতদিন তো একসঙ্গে টিউশন পড়েছিল। কেমন সে যেন নিরীহ দুলাল মার্কা হয়েই সারাজীবন থেকে গেল। আজ যতই সে ন্যাডি হোক না কেন, নাছোড় ‘দুলাল’ ঠিক চুপি চুপি আজও তার পেছনে। বছর পঁয়তিরিশ আগেকার এক ছোট্ট মেয়ের মুখ হঠাৎ উঁকি মারে ন্যাডির মনে আজ সকালবেলা। শুনেছে একটা ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে নাকি তার বিয়ে হয়ে গেছে। জানে না, এখন কোথায় কীভাবে আছে সে। জানে, তার আজ কয় ছেলেমেয়ে। বহু আগেই যৌবন হারিয়ে সে এখন হয়তো নাতিপুতি নিয়ে ঠাকুমাদের দলে নাম লিখিয়েছে। হয়তো বা শাশুড়ি হয়ে বৌমাকে শাসন করছে। হয়তো বা একাদশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা করতে করতে শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে হাতে পায়ে বাত ধরিয়েছে। কে জানে!
এই নয় যে মহুয়াকে নিয়ে নন্দদুলাল পরে খুব ভাবার অবকাশ পেয়েছে। আজ হিসেব করতে বসে কেন কি জানি কত যুগ পরে মফস্বলের এক পঞ্চদশী বালিকা পঞ্চাশের এক প্রৌঢ়ের স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে। এই নয় যে শ্রেয়সীকে নিয়ে নন্দদুলাল খুশি নয়। বৌকে নিয়ে একজন পুরুষ মানুষের কতটা খুশি হওয়া উচিত নন্দদুলাল তা জানে না। নন্দদুলাল যে শ্রেয়সীকে নিয়ে অখুশি, তা নয়। বাকিরা মনে করে ওরা দুজনে খুব সুখী। বাকিদের মনে করা সুখের আবহে নন্দদুলালেরও মনে হয় ও সুখী। তবে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে বৈকি! আজও আবার নতুন করে জেগেছে। ভালোবাসা কথাটার অর্থ অনেকের মতো নন্দদুলালকেও ভাবায়। শ্রেয়সীকে ভালোবাসে কিনা ও জানে না, তবে অভাব একটা অনুভব করে। এতদিনের সহানুবস্থানে একটা নির্ভরতা শ্রেয়সীর ওপর তৈরী হয়েছে সেটা নন্দদুলাল অস্বীকার করে না। সেটাকেই অনেকের মতো ভালোবাসা বলে চালিয়ে তৃপ্তি খোঁজে নন্দদুলাল। সেই ভালোবাসায় ভর করে চেষ্টা করেছে শ্রেয়সীর সব রকম চাহিদার যোগান দিতে— অর্থ থেকে সময়, অনর্থ থেকে অপচয়। কত কিছু করেছে স্রেফ শ্রেয়সী চেয়েছে বলে। মাঝে মাঝে মন চেয়েছে প্রতিবাদ করতে কিন্তু তার নিরীহ দুলাল প্রবৃত্তি তাকে বারবার বাধা দিয়েছে। তাই তাদের দেখে খুব সুখী দম্পতি নিশ্চয় বলা চলে তবে ঠোঁটকাটা নিন্দুকরা আড়ালে আবডালে তাকে স্ত্রৈণ বলে।
নন্দদুলাল বাবা-মায়ের ছেলে। বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই নিজের সাহিত্য নিয়ে পড়ার বাসনা ঘুচিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। একবারের জন্যেও তার নিজের ইচ্ছের কথা মুখ ফুটে বলেনি সুবোধ বালক নন্দদুলাল। আমেরিকা আসা সেটাও বাবামা চেয়েছিল বলে। বিয়ের পরও নন্দদুলালের সময়ে তারা ভাগ বসাতে চেয়েছিল। বাবা-মার ভাগ সে ফেরায়নি, হয়তো একটু কম দিয়েছে শ্রেয়সীর চাপে। শ্রেয়সীর সঙ্গে এই একটা ব্যাপারে একটু মতবিরোধ ছিল। তবে তাদের দাম্পত্য জীবন সেই বিরোধিতাটুকু মেনে নিয়ে টুকটুক করে এগিয়ে গেছে প্রায় বাইশ বছর। এর মধ্যেই তানিশা এসেছে তাদের মধ্যে। এই একটা জায়গায় নন্দদুলালের কখনো মনে হয়নি সে কর্তব্য করছে। বছর দুই আগে সে কলেজে যাবার পর যা কিছু সময় উদ্বৃত্ত হয়েছে সেটাও নিজের ভেবে পকেটে পুরে নিয়েছে শ্রেয়সী। মেয়েকে আঠারো বছর ধরে দেওয়া সময় এখন সুদে আসলে উসুল করতে চায় যেন।
অফিসে ন্যাডি কাজের ছেলে। জল যেমন সবসময় কম বাধার পথ বেছে নেয়, তেমনি অফিসের বসও এক্সট্রা কাজ থাকলে ন্যাডির দিকে ধেয়ে আসে। অফিসের কাজ ন্যাডির পেছনে পেছনে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে বেডটাইমে ঢুকে যায়। রাতের বেলায় ঘুমকে একটু কম সময় দিয়ে কাজের সঙ্গে আদর চলে বেশি। সুবোধ বালক নন্দদুলাল বছর শেষে দেড় থেকে দু-পার্সেন্ট ইনক্রিমেন্ট পেয়ে মনে মনে বসকে দু-একটা গালি পাড়তে গিয়ে নিজেকে সংযত করে নেয় নিজের ভেতরেই।
বন্ধুমহলে ন্যাডিরা আদর্শ দম্পতি। নন্দদুলালও অন্তত কাল পর্যন্ত তাই ভেবে এসেছে। সে পার্সোনাল স্পেসে বিশ্বাস করলেও তা নিয়ে খুব একটা দর কষাকষি করেনি শ্রেয়সীর সঙ্গে, পাছে যদি কিছু উল্টোপাল্টা ভেবে বসে। টাইম আর স্পেসে তারা দুজনে সর্বদাই একসঙ্গে। আরেকটু ডিটেলে বললে বলা ভালো, সেই স্পেসে নন্দদুলাল বেশ চেপ্টেই আছে বলতে হবে।
সময় তো ভগবানের দান। একটা দিনের পর আরেকটা দিন নতুন করে চব্বিশটা ঘন্টা জমার খাতায় ঢুকিয়ে দেয়। সময়কে টাকার মতো উপার্জন করতে হয় না বলেই হোক বা বিদ্যুতের মতো ভবিষ্যতের জন্যে জমিয়ে রাখা যায় না বলেই হোক নন্দদুলাল কাউকে নিরাশ করে না। তবে আজ ওই বার্থডে কার্ডটা হাতে পাওয়ার পর, মনটা কেমন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে নন্দদুলালের। অর্ধ-শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে যাবার পর এসে উপলব্ধি করছে জীবনের রানওয়েটা বড্ড ছোট হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে তার সমস্ত সময় বাকিরা নিজেদের মনে করে লুটেপুটে নিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করে চলে গিয়েছে। নন্দদুলালের শরীর পৃথিবীতে পঞ্চাশ বছর দাপাদাপি করলেও তার কোনো আলাদা সত্তা কোথাও তৈরি হয়নি। হয়তো সে সাহিত্য নিয়ে পড়তেই পারতো, হয়তো সে মহুয়ার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাতে পারত। হয়তো যে জীবনটা পেত, তাতে আর্থিক সচ্ছলতা থাকত না, তবুও সেটা বোধহয় একান্ত নিজস্ব হতো। সেই সব এলোপাথাড়ি ভাবনার দুয়ার হঠাৎ কে যেন আজ খুলে দিয়েছে। পেনের ডগায় অনেক শব্দ বসাতে ইচ্ছে করছে নন্দদুলাল থেকে সংকুচিত হয়ে যাওয়া ন্যাডির। নন্দদুলাল কলমটা খুলে রাইটিং প্যাডে লিখতে আরম্ভ করে— ‘একটা খাঁচায় বন্দি পাখির আত্মকথা। কোনো এক সময়, কোনো এক দেশের, কোনো এক জায়গায় এক সুবোধ বালক ছিল। ঠিক যেন গোপালের মত। সেই সুবোধ বালক, চিরদিন সুবোধ হয়েই বন্দি থেকে গেল সবার কাছে। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ পথ পেরিয়ে হিসেব করতে এসে দেখে কোথাও সে নেই। অথচ…’