পিকলুর উপস্থিত বুদ্ধি

অঙ্কিত চিত্র

অমিয় আদক

আজ পিকলুর বাবা বাড়ি নেই। সকালের পড়াশোনায় ব্যস্ত সে। তার মা ডেকে বলেন, ‘বাবা পিকলু, তোকে একবার পড়া বন্ধ করেই রাণুজেঠিমাদের বাড়ি যেতে হবে।’
—কেন মা?
—তোর বাবা সক্কালেই একটা জরুরি কাজে গেছেন। আজ তোকেই দুধটা আনতে হবে। নইলে স্কুল যাওয়ার সময় দুধ দিয়ে ভাত খাবি কীকরে?

‘ঠিক আছে যাচ্ছি। দুধের ক্যানটা দাও। আমি যাবো আর আসবো।’ তার মা দুধের ক্যান হাতে দেন। সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে রাণুজেঠিমাদের বাড়ি। বাড়ি পাশের পাড়ায়। এর আগেও পিকলু গেছে সেই বাড়িতে। তবে মায়ের সঙ্গে। একা কখনও যায়নি। বাম হাতে দুধের ক্যান। ডান হাতে নেয় ঢাকনা। ঢাকনা দিয়ে ক্যানের উপর ছোটছোট আঘাত করে। মনে মনে একটা তালে বাজাতে থাকে। রাস্তার দিকে খেয়াল রেখেও তার বাজনা চলতে থাকে।


তাদের পাড়া আর জেঠিমাদের পাড়ার রাস্তাটা পুকুর পাড়ের উপর দিয়। বাঁয়ে পুকুর। ডাইনে বাঁশের বাগান। সে বাঁশবাগান খানিক ঝোপঝাড়ে ভর্তি। সেই রাস্তায় সে একা। পুকুর পাড়ে এসেই তার বাজনা থামে। মনের মধ্যে ঢোকে একটা অজানা ভয়। বাঁশঝাড়ের দিক থেকে যদি হনুমান বেরিয়ে আসে। যদি তাকে তাড়া করে। এমনতর উদ্ভট ভাবনার দোলাচল তার মনে।

তার ভাবনাটা চকিতে বাস্তব হয়ে যায়। সে দেখে একটা হনুমান সেই মাত্র রাস্তায় এসে বসে। তার যাওয়ার রাস্তার ঠিক মাঝখানে। রাস্তা আগলে হনুমান তার দিকেই তাকিয়ে। বেজায় ভয় পায়। বুকের ভিতরটা ধড়ফড়িয়ে ওঠে। এখন কী করবে? তাও ভেবে ঠিক করতে পারে না। তার পিছনে কেউ এলেও, সে খানিক সাহস পেতে পারতো। পিছনে তাকিয়েও কাউকে নজরে পায় না। তার যেন ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলার অবস্থা। কান্না ভিতরে থাকলেও কান্নার শব্দ বেরোয় না।

পিকলু এমন বিপদে কখনও পড়েনি। তার তো হতভম্ব অবস্থা। কী করবে? ঠিক করা তার পক্ষে অসম্ভব। এমনটাই ভাবে সে। পিকলু পিছিয়ে আসে না। সাহস করেই কয়েক পা আগায়। তখনি হনুমান পুকুর পাড়ের দিকে সরে। পাড়ের আমড়া গাছের ডালে লাফিয়ে ওঠে। ডালে বসে। তাকিয়ে থাকে পিকলুর দিকে। তার ঝোলা লেজটা সামান্য হাওয়ায় দুলতে থাকে। পিকলু বুঝতে পারে, হনুমান তাকে তাড়া করার চেষ্টায় থাকেনি। এবার তার মনের ভিতর থেকে ভয় হেমন্তের মেঘের মতোই মিলিয়ে যায়। এগিয়ে চলে। পৌঁছায় রাণুজেঠিমাদের বাড়ি।

তাকে দেখেই রাণুজেঠিমার প্রশ্ন, ‘পিকলু, বাবা কি বাড়ি নেই?’
—সক্কালেই কী একটা কাজে বাবা বেরিয়েছেন। তাই মা আমাকে পাঠালেন।
—একটু দাঁড়া বাবা, হাতের কাজটা সারি। তোকে তাড়াতাড়িই ছেড়ে দেবো।
পিকলু জেঠিমাদের উঠানে আমগাছের ছায়ায় দাঁড়ায়। টুক করে একটা পাকা আম তার বামদিকে পড়ে। সে নুয়ে আমটা কুড়োয়। জেঠিমাদের বারান্দায় রাখে। জেঠিমার হাতের কাজ সারা হলে তিনি পিকলুর হাতের ক্যানটা নেন। তাঁর নজরে পড়ে আমটা। বলেন, ‘পিকলু, আমটা এখানেই ছিলো? নাকি কেউ রাখলো?’
—আমি রেখেছি জেঠিমা। এইমাত্র আমটা গাছ থেকে পড়লো।
—রাখতে হবে কেন? আমটা নিয়ে যা। তুই নিজেই খাবি। হ্যাঁ শোন, আমি দুধটা দেওয়ার পর খানিক দাঁড়াবি। তোদেরও কিছু আম দেবো।
—আচ্ছা দাঁড়াচ্ছি।

পিকলু পাকা আমটা প্যান্টের পকেটে ভরে। সে ভাবতে থাকে, তাদের ছোট্ট উঠোন। উঠোনের কোণে একটা মাত্র পাতিলেবুর গাছ। তাদের উঠানের যা চেহারা, তাতে আমগাছ রাখাও অসম্ভব। তাই হয়তো তাদের আমগাছ নেই। বাবা অবশ্য আম কিনে আনেন। তারা কেনা আমই খায়। জেঠিমাদের গাছের দিকে তাকায়। দেখে, গাছের উপরটায় নাইলনের পাতলা জাল লাগানো। তার খেয়াল পড়ে, হনুমান আছে। পাড়ার পুকুরের পাড়ের গাছ। হনুমান আটকাতেই গাছের উপরে নাইলনের জাল। হনুমানগুলো জেঠিমাদের গাছের আম খেতে পায় না। জেঠিমা আসেন। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে। একটা পলিব্যাগে প্রায় কিলো তিনেক পাকা আম। সেটি ধরিয়ে দেন। তার সঙ্গে হ্যান্ডেলওয়ালা দুধের ক্যানটাও দেন। সে ডানহাতে নেয় আমের ক্যারিব্যাগ। বাম হাতে দুধের ক্যানের হ্যান্ডেল। বেরিয়ে পড়ে বাড়ির পথে।

হাজির পুকুর পাড়ের রাস্তায়। সেই হনুমানটাকেই গাছের ডাল থেকে নামতে দেখে। সে পিকলুর দিকেই এগোয়। পিকলুর বেজায় ভয় লাগে। ক্যারিব্যাগে পাকা আম। সেদিকেই হনুমানের নজর। হনুমানটা হাতের ব্যাগ কেড়ে নিতেও পারে। তখন সে কী করবে? ভাবতেই তার কপালে ঘাম বেরোয়। তা সে নিজেই বুঝতে পারে। হনুমান প্রায় সামনে হাজির। তখনি খেয়াল পড়ে, পকেটে একটা আম। সে সাহস হারায় না।

বামহাতের কব্জির উপরে তোলে ক্যানের হাতল। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে পাকা আমটা। ডানহাতে আমের ক্যারিব্যাগ দুধের ক্যান দুটোকেই নেয়। বামহাতে করেই পাকা আমটা পাশের ঝোপের দিকে ছোঁড়ে। বোকা হনুমান। সেটার খোঁজেই ঝোপের দিকে যায়। তখনি খানিক ছুটেই সে পুকুর পাড় পেরোয়। বাড়ির বাইরে থেকেই মাকে হাঁক দেয়, ‘মা, ওমা, তাড়াতাড়ি বাইরে এসো।’
ছেলের কাতর ডাকে মা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসেন। বলেন, ‘কী হয়েছে? অতো ঘামছিস কেন?’

‘আমের ব্যাগটা ধরো। বাড়িতে চলো। বলছি।’ মা আমের ব্যাগ নেন। সে মায়ের পিছনে বাড়িতে ঢোকে। দুধের ক্যান বারান্দায় রাখে। সব ঘটনা জানায়। মা বলেন, ‘বুঝতে পেরেছি, ভয় খানিক পেয়েছিলিস। উপস্থিত বুদ্ধিতে হনুমানকে সামলেছিস। শোন, বিপদ অসুবিধে আসবেই। বুদ্ধি দিয়েই তার মোকাবিলা করবি।’ ছেলেকে কাছে টানেন, মাথায় চুমো দেন। বলেন, ‘সোনা আমার!