শামসুল হক
ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে ইউরোপ মহাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। মেজাজটাও ছিল বেশ ফুরফুরে। আপনমনে উপভোগ করছিলেন নিসর্গের অপরূপ সব দৃশ্যাবলীও। আর তার মাধ্যেই সেই সময় সমুদ্রের অতল জলরাশির উপর যে অপরূপ দৃশ্যের সম্মুখীন তিনি হয়েছিলেন তা নিয়েই আবার ভাবনাচিন্তা করতেও শুরু করেছিলেন নতুনভাবেই। শুধু ভাবনাই নয়, সমগ্র ব্যাপারটাকেই নিজস্ব জ্ঞান ও বুদ্ধির বলে তিনি আবার তাকে বাস্তবায়িত করেছিলেন বলেই তারপর বিশ্ববিজ্ঞান মঞ্চে প্রতিষ্ঠিতহয়েছিল পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন এক সমীকরণ। বলাই বাহুল্য, তারপর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বৃদ্ধি পেয়েছিল আমাদের দেশের মানমর্যাদাও। প্রসারিত হয়েছিল পদার্থ বিজ্ঞানের নিজস্ব পথটিও।
সেটা ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনও এক ঝলমলে সকালের কথা। বৈজ্ঞানিক সি. ভি. রমন ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ইংল্যান্ডের পথে। সেখানে পদার্থবিদ্যার উপর বিশেষ গবেষণার কাজ নিয়ে একটা আলোচনাসভা ছিল তাঁর। মহাসাগরের বুক চিরে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই তাঁর নজরে আসে অতি বিরল এক দৃশ্যের। সেইসময় তিনি দেখতে পান সমুদ্রের জলে হিমবাহের মধ্যে নীল বর্ণের এক আলোকরশ্মি।
সমস্ত ব্যাপারটাকেই তিনি তখন একেবারে নিখুঁতভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন এবং কেনই বা এই ধরনের ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তাও শুরু করেছিলেন। তবে তখন তিনি অন্য একটা কাজে বিশেষভাবে ব্যস্ত ছিলেন বলে নতুন বিষয়টি নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামাতে চাননি। ব্যাপারটাকে নিয়ে পরে ভাবা যাবে বলে তিনি সেই মুহূর্তে মন দিয়েছিলেন তাঁর পুরাতন কাজেই।
কিছুদিন পরেই ইউরোপের কাজ সেরে দেশে ফেরেন রমন সাহেব। তারপর মন দেন নীল সমুদ্রের দিকে। সাগরের অসীম জলরাশির উপর সেদিন তিনি কেন দেখেছিলেন নীলের খেলা, এবার ভাবনার স্রোতটা ঘোরাবার চেষ্টা করলেন সেই দিকেই। শুরু করলেন নিরলস গবেষণাকর্মও। পরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, জল ও বরফের মধ্যে সূর্যালোকের বিকিরণ প্রক্রিয়া ঘটিয়েই তিনি উদ্ঘাটন করবেন জটিল সেই রহস্যের।
কয়েকজন সহযোগীকে সঙ্গে নিয়েই শুরু হল তাঁর নতুন অনুসন্ধানের কাজ। আর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি পেয়েছিলেন ঈপ্সিত সাফল্যও। তারপর গবেষণালব্ধ সেই ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞান মহলে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হল রমন এফেক্ট তত্ত্ব নামক অতি মূল্যবান একটা দলিলও।
রমন এফেক্ট আসলে কী, আস্তে আস্তে তা পরিষ্কারভাবে বিকশিত হতে থাকে দেশ বিদেশের সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক মানুষজনের কাছেই। সকলেই বুঝতে পারেন যে, কোনও বস্তুর অণুতে যদি আলোকমণ্ডলীর সংঘাত ঘটে, তাহলে তার প্রতিক্রিয়ায় নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে আলোকের কম্পনও। তবে সবসময়ই তেমন ঘটনা যে ঘটবে তা কিন্তু মোটেও নয়। ক্ষেত্রবিশেষে সেটা আবার কমেও যেতে পারে। আর এর মাঝেই দেখা দিতে পারে আলোর বিকিরণও।
সেইসময় দক্ষিণ ভারতীয় বিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সভায় রমন সাহেব সমগ্র ব্যাপারটাকেই সকলের সামনে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সমিতির সদস্যরা সেটা গ্রহণও করেছিলেন। আর তাঁদেরই প্রচেষ্টায় ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্সে সেটা প্রকাশিতও হয়েছিল।
সি. ভি. রমনের এই সাফল্যের কথা তখন ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই। তাঁর সেই বিশাল কীর্তির জন্য সকলেই তখন ধরে নিয়েছিলেন যে বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারটি এবার নিশ্চিতভাবেই চলে আসবে এই দেশে রমন সাহেবেরই হাত ধরে। রমন নিজেও খুব আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন এই ব্যাপারে। বাস্তবে তা কিন্তু ঘটেনি। ১৯২৮ সালে বিজ্ঞানের জন্য নোবেল পুরস্কারের নাম ঘোষিত হয় ওয়ার্ন রিচার্ডসনের। বিজ্ঞানী রমন অবশ্য তাতে ভেঙে পড়েননি। অপেক্ষা করেছিলেন পরের বছরের জন্য। কিন্তু ১৯২৯ সালেও নিরাশ হতে হয় তাঁকে। সেবার সেই পুরস্কারটি পান লুই. ডি. বোগলি।
এই ঘটনা রমন সাহেবকে এবার একটু নিরাশ করেছিল বৈ কি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাঁর তো কিছুই করারও ছিল না। তাই সবকিছুই নীরবে মেনে নিয়েছিলেন তিনি।
পরের বছর ১৯৩০। ভাগ্য সেবার কিন্তু আর বিমুখ করেনি তাঁকে। সে বছর প্রত্যাশিত নোবেলটি আসে তাঁরই হাতে। আর তিনিই হলেন এশিয়া মহাদেশের সেই ব্যক্তি, বিজ্ঞানের উপরপেয়েছিলেন প্রথম নোবেল পুরস্কারটি। তার আগে ১৯১৩ সালে সাহিত্যের জন্য প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কেবলমাত্র নোবেল পুরস্কারই নয়, বিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের জন্য রমন পেয়েছিলেন আরও অনেক পুরস্কার। নোবেলের আগে ১৯২৪ সালে তিনি নির্বাচিত হন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো। ১৯২৮ সালে পান netteucci পুরস্কার। ১৯৩০ সালে তিনি অর্জন করেন রাইট ব্যাচেলর পুরস্কারটিও। ১৯৫৪ সালে পান ভারতরত্ন। আর লেনিন শান্তি পুরস্কার পান ১৯৫৭ সালে।
লেখক হিসেবেও তিনি সুনাম অর্জন করেছেন প্রচুর। দুই হাজারেরও বেশি গবেষণাপত্র প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। আবার লেসার রশ্মি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান যে কতখানি তা অস্বীকার করতে পারবেন না বিশ্বের কোনও প্রান্তের কোনও মানুষই।