মধুসূদন দত্ত যেদিন মাইকেল হলেন

ফাইল চিত্র

ডা. শঙ্করকুমার নাথ

১৭৭০ সালের ২৩ ডিসেম্বর আজকের বিবাদী বাগ অঞ্চলে একটি গীর্জা প্রতিষ্ঠা করলেন মিশনারী জন কিয়ারনানডার। নাম দেওয়া হল মিশন চার্চ। ১৭ বছর পর এর নাম হল Old or Missionj Church— পুরনো অথবা মিশন গীর্জা— কলকাতার একটি প্রাচীন গীর্জা। বর্তমান ঠিকানা ৫ নম্বর আর এন মুখার্জি রোড, লালবাজার। কলকাতার এই দ্বিতীয় প্রাচীনতম গীর্জাটির প্রতিষ্ঠাতার পুরো নাম রেভারেন্ড জন জাকারিয়া কিয়ারনানডার (John Zacharias Kierrander)। ইনি এসেছিলেন সুইডেন থেকে। এটিই কলকাতার প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট গীর্জা। জন কিয়ারনানডারের জন্মের সাল, তারিখ নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ১ ডিসেম্বর ১৭১০ খ্রীস্টাব্দ তারিখটি। জন ভারতে আসেন ১৭৪০ সালের আগস্ট মাসে মাদ্রাজে, কলকাতায় আসেন ১৭৫৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর লর্ড ক্লাইভের আমন্ত্রণে— এখানে মিশনারীর কাজকর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

উল্লেখ্য, কলকাতায় তাঁকে বিনা ভাড়ায় ঘর দেওয়া হয়েছিল। কলকাতায় এসেই জন ওই বছর ডিসেম্বরে মুরগিহাটায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন, যেখানে ইউরোপিয়ান এবং নেটিভ উভয় ছেলেরাই ভর্তি হতে পারতেন। এক বছরেই সেই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা হয়েছিল ১৭৪ জন।


প্রথম বছরেই জন ১৫ জন নেটিভকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন এই বাংলায়— তার মধ্যে একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি মিশনারী হিসেবে ধর্ম প্রচার করতেন ইংরেজি, জার্মানি, পতুগিজ এবং বাংলা ভাষায়।

১৭৬১ সালে বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় এক ভয়ঙ্কর কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই মহামারীতে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে যায়। জন নিজে ছ’বার আক্রান্ত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু তাঁর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে এই কলেরায়। ১৭৬২ সালে অবশ্য জন আবার বিয়ে করেন, এবার তাঁর স্ত্রী হলেন শ্রীমতী অ্যান উলি। ১৭৬৭ সালে জন Society for Promoting Christian Knowledge-এ রিপোর্ট করলেন যে, ১৭৫৮ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৭৬৬ সালের শেষ পর্যন্ত তিনি মোট ১৮৯ জনকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিয়েছেন।

১৭৬৭ সালে জন কিয়ারনানডার পরিকল্পনা করলেন, কলকাতায় একটি গীর্জা তৈরি করবেন। এই বছরের মে মাসে তিনি এর জন্য একটি জমি কিনলেন। গীর্জাটি সম্পূর্ণ হয়ে গেল সাড়ে তিন বছরে, নাম মিশন চার্চ। প্রসঙ্গত, এর আরও ১৭ বছর পর সেন্ট জনস্ চার্চ তৈরি হয়েছিল। এই মিশন চার্চ তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৬৮,০০০ টাকা। এই গীর্জার স্থপতি ছিলেন বন্টুট দ্য মেলভিল (Bontout de Melvill)।
যাঁরা এই চার্চকে Old Mission Church বলেন, তাঁরা ভুল বলেন। আসলে এই গীর্জার নাম Old or Mission Church। ১৭৭০ সাল থেকে এই চার্চটির নাম মিশন চার্চ, ১৭ বছর পর ১৭৮৭ সালে যখন সেন্ট জনস গীর্জা তৈরি হল, মিশন চার্চকে ডাকা হতে লাগলো Old Church নামে আর সেন্ট জনস চার্চকে New Church নামে। ফলে মিশন চার্চের দুটি নাম হল, Old Church এবং Mission Church অর্থাৎ Old or Mission Church, কিন্তু কখনওই সেটা Old Mission Church নামে নয়, যদিও আজও এই ভুল নামটিই গীর্জার প্রবেশদ্বারে লেখা রয়েছে।

Old or Mission Church-এর ১৪৫ বছরের ইতিহাস বিষয়ে যে-লেখাটি থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি, তা প্রকাশিত হয়েছে ১৯১৫ সালের Bengal Past and Present পত্রিকায়। সেই লেখার শিরোনামেও সঠিকভাবে রয়েছে Old or Mission Church।

হ্যাঁ, মহাকবি মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন ওল্ড মিশন চার্চে নয়, ওল্ড বা মিশন চার্চে, যদিও চার্চটা একই, সে-কথায় আমরা আসবো।

খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের সেই দিনটি
সেদিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ। জায়গাটা হল ওল্ড বা মিশন চার্চ, কলকাতার সাহেবপাড়া, আজকের বিবাদী বাগ অঞ্চল, প্রভাতকাল। আজ মধুসূদন দত্তের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেবার দিন, কত আর বয়স তখন তাঁর, মাত্র উনিশ বছর। মধ্যমণি হিসেবে গীর্জার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মধুসূদনের আসন ঠিক করা হয়েছে। আর একটু পরেই তিনি চলে আসবেন। একে একে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ চার্চে এসে উপস্থিত হচ্ছেন। মধুসূদনও এলেন। এবার সকলে অপেক্ষায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য।

মধু-জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ সোম ওই দিনটিকে, ওই ক্ষণটিকে এইভাবে বর্ণনা করেছেন:
‘‘সেই দিন সহরময় হুলস্থূল পড়িয়া গিয়াছিল। সেই সময়ে রাজনারায়ণ দত্ত সদর-দেওয়ানী আদালতের প্রতিপত্তিশালী উকীল ও বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। সুতরাং, তাঁহার একমাত্র পুত্র যে খ্রীষ্টান হইতেছে, একথা প্রবাদের ন্যায় গৃহে-গৃহে নরনারীর মুখে রাষ্ট্র হইতে লাগিল। বিশেষতঃ, মধুসূদনের খ্রীষ্টধর্ম্ম গ্রহণ-ব্যাপার পাদ্রিরা যেরূপ সমারোহে সম্পন্ন করিয়াছিলেন, তাহাতে এ সংবাদ তৎকালীন বঙ্গদেশের সমগ্র সংবাদপত্রেও প্রচারিত হইয়াছিল।

১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারীর শীত-প্রভাতে কলিকাতার মিশন রো-র গগণচুম্বী-চূড়া-শোভিত ‘‘ওল্ড-মিশন-চর্চ্চ’’ ধর্ম্মমন্দিরে মধুসূদন নবধর্ম্ম পরিগ্রহণ করিবেন। নগরবাসীরা উত্তেজিত হইয়াছেন; সেই জন্য, উৎসবের সময় পাছে কোন গোলযোগ, বিঘ্ন বা বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়, এই আশঙ্কায় গির্জ্জার কর্ত্তৃপক্ষগণ গির্জ্জার সম্মুখে সশস্ত্র সৈনিক প্রহরী প্রহরায় নিযুক্ত করিয়াছিলেন। একে একে নিমন্ত্রিত সাহেব ও বিবিদিগের শকটগুলি আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। কে. এম. ব্যানার্জ্জী প্রমুখ অন্যান্য পাদ্রিরাও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মধুসূদনের এই ধর্ম্মান্তরগ্রহণ-উৎসবে কে. এম. ব্যানার্জ্জি, নির্ব্বাচিত সাক্ষী (Chosen Witness) স্বরূপে উপস্থিত ছিলেন। কেল্লা হইতে সাহেবরা মধুসূদনকে সঙ্গে লইয়া উপস্থিত হইলেন। ইঁহারা গির্জ্জায় প্রবেশ করিলে দ্বার বন্ধ হইয়া গেল। গির্জ্জাভ্যন্তরে প্রথমে সঙ্গীত-মঞ্চ হইতে বাদ্যযন্ত্র সংযোগে (Church Organ) মধুসূদনের খ্রীষ্টধর্ম্ম-অবলম্বন-উপলক্ষে রচিত নিম্নে উদ্ধৃত ধর্ম্ম-সঙ্গীতটি সমবেত নরনারীরা কণ্ঠ-সম্মিলনে গীত হয়।’’

সেই ধর্ম্মসঙ্গীতটি নীচে উল্লেখ করে দিলাম:
HYMN
By M.S. Dutt, A Hindu Youth
(Composed by him to be sung at his Baptism)
I
Long sunk in Superstition’s night,
By Sin and Satan drive, —
I saw not, — cared not for the Light,
That leads the Blind to Heaven.
II
I sat in darkness, — Reason’s eye
Was shut, — was closed in me; —
I hasten’d to Eternity
O’er Error’s dreadful Sea!
III
But now, at length, thy grace, O Lord
Bids all around me shine:
I drink thy sweet, — thy precious word,—
I kneel before thy shrine!
IV
I’ve broke Affection’s tenderest ties
For any blest Saviour’s sake; —
All, all I love beneath the skies,
Lord! I for thee forsake!
9th February 1843

সমবেত সঙ্গীত শেষ হতেই ভাবগম্ভীর পরিবেশে মূল অনুষ্ঠান অর্থাৎ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা শুরু হল:
‘‘তৎপরে ইংলণ্ডীয় গির্জ্জা-সম্প্রদায়ের (Church of England) অন্তর্ভূক্ত ওল্ড-মিশন চার্চ্চের প্রধান ধর্ম্মাচার্য্য, সৌম্যদর্শন আর্চ্চডিকন ডল্ট্রী (Venerable Arch-deacon Dealtry) যথাবিহিত অনুষ্ঠান মন্ত্র পাঠান্তে জর্ডন নদীর পবিত্র নীর মধুসূদনের মস্তকে সেচন করিয়া, ‘‘মাইকেল’’ নাম দিয়া তাঁহাকে খ্রীষ্টধর্ম্মে দীক্ষিত করিলেন।’’

দীক্ষা শেষ হয়ে গেলে মধুসূদন তাঁর নিজের বাড়িতে যাননি, যাওয়ার কথাও নয়। তিনি আর্চডিকন-এর বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে মধুর সঙ্গে দেখা করতে যান তাঁর দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু— গৌরদাস বসাক এবং ভূদেব মুখোপাধ্যায়। তাঁরা মধুকে দেখার পর বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরে যান।
গোড়ার দিকে মধুসূদন মিশন চার্চের পাদরি ভন্ এবং আর্চডিসনের বাড়িতে বাস করছিলেন। এরপর কিছুদিন ছিলেন ডেকার্স লেনে ইংরেজি সাহিত্যের সুপণ্ডিত স্মিথ সাহেবের বাড়িতে। বাস্তবিক এই সময় তিনি নিজ সমাজ এবং বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী হয়ে পড়েছিলেন।

ওল্ড চার্চ থেকে গৌরদাস বসাককে লেখা তাঁর পত্রটিতে তাঁর কষ্টের এই প্রকাশ দেখা যাচ্ছে:
‘‘ওল্ড চার্চ, ১৮৪৩

প্রিয় গৌরদাস,
প্রবাদ আছে যে, দরকারের সময়ে যার সাহায্য পাওয়া যায় সেই প্রকৃত বন্ধু। বেশ, এখন আমি ‘সাহায্যপ্রার্থী’, তুমি যদি ‘প্রকৃত বন্ধু’ হও, এবার তার প্রমাণ দাও। তুমি কি ভাবছ যে, তোমার কাছ থেকে আমি টাকা ধার করতে চাই? তুমি কি ভাবছ যে, তোমার বন্ধুদের সঙ্গে তোমার সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরিয়ে আমি আমার জন্যে কিছু করে নিতে চাই? না, না, না। ও ধরনের কোনো কিছুই না। আতঙ্কিত হোয়ো না। হায়, আমি এখন একা। এবং এখন আমি সাহায্যপ্রার্থী, আমি সঙ্গ চাই। বল, তুমি কি আসবে এবং দিনটা আমার সঙ্গে কাটিয়ে যাবে? আমি প্রায় নিশ্চিত যে তুমি আসবে না, কিন্তু তবুও তুমি নিজেকে আমার ‘বন্ধু’ বলে স্বীকার কর বলেই তোমাকে এ কথা জানানো আমি কিছুটা কর্তব্যের মতন জ্ঞান করি বলেই জানাচ্ছি যে, আমি ভীষণভাবে একা, ভয়ংকরভাবে তোমার সঙ্গ চাই।’’
(বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা মাইকেলের এই চিঠিটি ইংরেজি থেকে অনূদিত— নেওয়া হয়েছে
ড. সুশীল রায় সম্পাদিত ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের পত্রাবলী’ (১৯৫৯) পুস্তক থেকে।)

প্রসঙ্গক্রমে, এখানে বলবো, জীবনীকার নগেন্দ্রনাথ সোম ওল্ড অর মিশন চার্চকে ভুলবশত লিখেছেন ওল্ড মিশন চার্চ (১৯৫০ সালের সংস্করণ, পৃ: ৩৫), অনেক পরে জীবনীকার গোলাম মুরশিদও তাঁর বই ‘আশার ছলনে ভুলি’-তে (১৯৯৭ সংস্করণ) একই ভুল করেছেন, লিখেছেন ওল্ড মিশন চার্চ (পৃ: ৬৭)। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই ভুল করেছেন (মধুসূদন দত্ত, ১৩৫০, পৃ: ১৫), যোগীন্দ্রনাথ বসুও এই ভুল করেছেন (১৯২৫ সালের সংস্করণ, পৃ: ১২৬)। এই ভুল আরও অনেক জীবনীকারই করেছেন মাইকেলের পাঠকগণ তা পড়তে গিয়ে দেখেছেন। এখানে লক্ষ্য করুন, মধুসূদন যখন এই ওল্ড চার্চ থেকে গৌরদাসকে চিঠি লিখেছেন, তিনি কিন্তু ভুল করেননি, চিঠিতে তিনি লিখেছেন Old Church।

গোলাম মুরশিদ একস্থানে লিখেছেন, ‘‘৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেয় ওল্ড চার্চে মধুর দীক্ষার কাজ শেষ হলো।’’ (পৃ: ৬৫) এখানে সঠিকভাবে ওল্ড চার্চ কথাটা থাকলেও পুস্তকের অন্যত্র ওল্ড মিশন চার্চ কথাটা রয়েছে। যাই হোক, তাঁর বক্তব্য সন্ধেবেলা দীক্ষার কাজ শেষ হয়। নগেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘৯ই ফেব্রুয়ারীর শীতপ্রভাতে… মধুসূদন নবধর্ম্ম পরিগ্রহণ করিবেন।’’ তাহলে কি এই দীক্ষা গ্রহণের পুরো অনুষ্ঠানটি শেষ হতে প্রভাত থেকে সন্ধে পর্যন্ত গড়িয়ে গেছিল? সামগ্রিকভাবে অনুষ্ঠানটির বর্ণনা থেকে তা মনে হচ্ছে না।
ওল্ড অথবা মিশন চার্চের রেজিস্টারে মধুসূদনের ধর্মান্তকরণের রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে ১৯১৫ সালের Bengal Past & Present পত্রিকায়:
“THE OLD CHURCH REGISTERS
……..
The Baptismal Registers date from 1828 only,
Among those baptized at the Old Church were:
… … …
Michael Modhu Sudan Dutt, the greatest Bengali Poet of the 19th Century: February 9, 1843.”
গোলাম মুরশিদ লিখিত ‘আশার ছলনে ভুলি’, এই অসামান্য পুস্তকে মাইকেলের ব্যাপটিজমের একটি দলিলের ফটোকপি দেওয়া আছে। ছবির ভিতরে লেখাগুলি এতটাই অস্পষ্ট, ভাঙা-ভাঙা যে সবটার পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছে না। তবুও, যেটুকু পড়া যাচ্ছে, তা বলি। বাঁদিক থেকে প্রথম কলামে সম্ভবত ব্যাপটিজমের তারিখ, দ্বিতীয় কলাম ফাঁকা, তৃতীয় কলামে লেখা Modoosoodun, চতুর্থ কলামে লেখা Son of (সম্ভবত), পঞ্চম কলামে লেখা Rajnarain (সম্ভবত), ষষ্ঠ কলামে লেখা Dutt, সপ্তম কলামে লেখা Calcutta, অষ্টম কলামে কী লেখা, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

পত্রপত্রিকায় মধুসূদনের ধর্মান্তকরণের খবর
মধুসূদনের এই খৃষ্টধর্মে-দীক্ষা-গ্রহণের খবরটা শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত The Friend of India সাপ্তাহিক ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশ পেল ১৬ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ১৮৪৩ সালে, বৃহস্পতিবার। সম্ভবত এটিই প্রথম প্রকাশিত খবর কোনও পত্রিকায়। এই সংবাদপত্রের ঠিক এর আাগের সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ৯ ফেব্রুয়ারি, আর ওই দিনটি ছিল মধুসূদনের ধর্মান্তকরণের অনুষ্ঠান, ফলে খবরটা প্রকাশ করতে সাপ্তাহিক পত্রিকা ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়াকে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পরে সারা বিশ্বের অনেক পত্রপত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

মধুসূদনের ধর্মান্তকরণের আগে কী ঘটেছিল
নগেন্দ্রনাথ সোম লিখেছেন:
‘‘১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথমেই মধুসূদন হিন্দু কলেজ হইতে সহসা অন্তর্হিত হইলেন। তখন তিনি ‘সিনিয়র’ বিভাগে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। কোথায় গেলেন কেহই জানেন না; সহপাঠী বন্ধুবান্ধব সকলে যারপরনাই উদ্বিগ্ন হইলেন। বিশেষতঃ মধুসূদনের ন্যায় অন্তরঙ্গ সুহৃদের অন্তর্দ্ধানে গৌরদাস ও ভূদেবের হৃদয়ে গুরুতর ব্যথা অনুভূত হইল। খিদিরপুরের বাটীতেও বালক বিদ্যালয় হইতে প্রত্যাগত হয় নাই, উৎকণ্ঠায় অধীরা জননূ জাহ্নবী অশ্রুসিক্ত-কপোলে ঘর-বাহির করিয়া উদ্বেগে আত্মহারা হইয়াছেন। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত অস্থির-চিত্ত হইয়া আত্মীয়-বন্ধুগণের সহিত নানাস্থানে পুত্রের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন।’’

দু-একদিন পরে জানা গেল, মধুসূদনকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ফোর্ট উইলিয়ামে, যাতে বিনা বাধায় মধুসূদনের ধর্মান্তকরণ অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হতে পারে। যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন:

‘‘পাছে মধুসূদনের আত্মীয়গণ তাঁহাকে তাঁহাদিগের হস্ত হইতে বলপূর্ব্বক উদ্ধার করিয়া লন, সেই ভয়ে খৃষ্টান যাজকগণ মধুসূদনকে অন্যত্র না রাখিয়া একেবারে ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিলেন। মধুসূদনের পিতা লাঠিয়াল ও ষড়কিওয়ালাদিগের সাহায্যে পুত্রকে উদ্ধার করিবেন আশা করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁর সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হইল।’’

আরও কিছু কথা
মধুসূদন দত্তের খ্রিস্টধর্ম-গ্রহণের খবরটি সারা বিশ্বেই প্রচার পেয়েছিল, কোনও সেন্দহ নেই। খ্রিষ্টধর্ম-গ্রহণের জন্য মধুসূদনকে হিন্দু কলেজ ছাড়তে হয়েছিল; তাই তাঁকে ভর্তি হতে হয়েছিল হাওড়ায় অবস্থিত বিশপস্ কলেজে।

মধুসূদন বিধর্মী হবার পরেও বাবা রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর পড়াশোনার জন্য নিয়মিত অর্থ পাঠিয়েছেন। মা জাহ্নবী দেবীর অনুরোধে রাজনারায়ণ পুত্রের সব খরচ দিতেন বিশপস্ কলেজে। মাঝে মাঝে পুত্রকে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও চলতো। কিন্তু বিশপস্ কলেজে থাকাকালীন মধুসূদন খানিকটা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠেন এবং মাঝেমধ্যেই বাবার সঙ্গে নানান বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন। অবশেষে ১৮৪৭ সালের শেষভাগে রাজনারায়ণ দত্ত পুত্রের অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেন। তার পরেরটা বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী ইতিহাস।