গল্পের গরু

সুতপা ভট্টাচার্য চক্রবর্তী

এক
সকালটা তখনও ভালো করে ডানা মেলেনি৷ পাহাড়তলির গ্রামটায় এই সময়ে একটা অমোঘ নির্জনতা ছডি়য়ে থাকে৷ লুকিং গ্লাসে চোখে রেখে গাডি়টা ঘুরিয়ে নিল রাজ৷ এখানে ওর জন্মভিটে, সেই টানেই মাঝে মধ্যে আসা৷ তবে এই শেষ বার৷ এবারই সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে৷ তারপর… রাজের জীবনে পাহাড়তলির আর কোনো চিহ্নমাত্র থাকবে না৷

কুকুও এসেছিল আগে কয়েকবার৷ এবারে আর ওকে আনতে পারল না৷ কুকু-র একদম ভাল্লাগে না জায়গাটা৷ তবু রাজের আবেদনেই আসা…
নাহ্, ঠিক জমছে না৷ এভাবে শুরুটা কেমন যেন চেনা গৎ৷ এবারে বাউন্ডারি লাইনটা পাল্টাতে হবে৷
বারোখিটকেল সম্পাদক মশাই বারবার করে বলছেন৷ আপনাকে তো আর পাতে দেওয়া যাচ্ছে না মশাই৷ এতো রিপিটেশন…. বিষয়, চরিত্র, ভাষা কোথাও কিছু নতুনত্ব নেই৷ পাতা ওল্টালেই বোঝা যায় এবার কী হবে৷ একটু ছিমছাম পরিষ্কার লিখুন না মশাই৷


দুই
আমাদের বাডি়র দক্ষিণ দিকটা খুব সুন্দর ছিল৷ একটা বিশাল জলাশয়৷ জলে সরু সরু ঢেউ৷ বিশ্বকর্মা পুজোর সময় প্যাঁকাটিতে ছোট ছোট রঙিন কাগজ বেঁধে সেই জলাশয়ের চারপাশে পুঁতে দিতাম৷ ভেজা হাওয়ায় কাগজগুলো উড়ত পতপত করে৷ দারুণ লাগতো আমাদের পাড়াটাকে৷ আমাদের জায়গাটা ছিল চটকল এলাকা৷ পাটের সূক্ষ্ম তন্ত্ত হাওয়ায় ভেসে বেড়াত৷ অনেক লোকেরই হাঁপানির অসুখ ছিল৷
এই তো, আবার একটা অসুখ এসে গেল৷ খুশি আর মজার গল্প লিখতে গিয়ে অসুখ এলো কোত্থেকে? না না, ওসব অসুখ-টসুখ আসুক চলবে না মশাই৷ আজকাল আপনার গল্পে বড্ড হতাশা দেখা দিচ্ছে৷ এটা নেট যুগ মশাই৷ এই যুগের ছেলে মেয়েরা আবার ওসব হতাশা-টতাশা বেশ অপছন্দ করে৷ মজা চাই, অনেকখানি মজা৷ আমি মজা জোগান দিতে শুরু করি—

তিন
পার্কে অনেকগুলো বাচ্চা হাতে রঙিন বেলুন নিয়ে ছোটাছুটি করছে৷ পাশে পাশে দৌড়চ্ছে ওদের মায়েরা৷ তাদের চুলে রং… পোশাকে রং… আমি মুগ্ধ হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি৷ আচমকাই একটা কথা ছিটকে আসে ওদের ভেতর থেকে— আমার শাশুডি়টা না— আরও একটু উৎকর্ণ হই— কী বলবি বল তো!
সেদিন কাজের মেয়েটাকে একটা নতুন কাপড় দিয়ে দিল৷ এদিকে আমার বেলা তাঁর হাত খোলে না মোটে৷ আর—
আর লিখতে পারি না আমি৷ আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে৷
এই হয়েছে আপনার এক রোগ৷ কে যে মাথার দিব্যি দিয়েছে আপনাকে যে সব সত্যি কথা লিখতে হবে! আরে মশাই একটু মিথ্যে চালি বুলি ঝাড়ুন৷ তবেই তো গল্প জমবে৷ জমে ওঠা গল্পের তীব্র আঁচে আমি নিজেকে সেঁকে নিই—

চার
নরম দুপুরে হালকা আলোয় টুংটাং বাজনা বাজছে৷ রঙিন পাত্রটা ঘুরছে হাত থেকে হাতে৷ মাত্র দুজন নর-নারী মিশ্র মদিরায় মাতাল হয়ে উঠেছে তারা৷ জাম্পিং অ্যান্ড পাম্পিং— শরীর বেয়ে গলিত লাভাস্রোত… প্রচন্ড সুখ… কিছুক্ষণ নরম বিছানায় মড়ার মতন সেঁটে থাকা— তারপর দুটো গাডি় দুদিকে চলে গেল৷ পরদিন ঘর, বিছানা, মদিরা সব এক থাকে, শুধু নরনারী বদলে যায়৷ এক ফাঁকে আমি ওদের ঘরে ঢুকে পডি়৷ একটা পচা দুর্গন্ধ ভ্যাক করে নাকে এসে লাগে৷ ছুট্টে বেরিয়ে আসি ও ঘর ছেডে়৷
নাহ্, যৌন সূত্র কাজে লাগল না৷ নতুন করে অন্য কিছু ভাবতে হবে৷ সম্পাদক মহাশয়ের ফোন আসে— একটু আদি রস-টস গুঁজে দিন না৷ আগে তো বেশ দিতেন টিতেন৷ বই কাটবেও ভালো৷ আমাদেরও তেমন কষ্ট হতো না৷ আরে মশাই ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচতে কে না চায় বলুন? আর এখন তো পুরস্কার টুরস্কারের ছড়াছডি়৷ তেমন তেমন খোলাখুলি লিখতে পারলে আপনাকে আর পায় কে? তখন আবার আমাকে যেন ভুলে যাবেন না৷ মনে রাখবেন৷ আপনার এই খরার দিনে আমিই কিন্ত্ত বন্ধুর মতো হাত বাডি়য়ে আপনাকে রক্ষা করেছিলাম৷

পাঁচ
আমিও মাঝে মাঝে রক্ষক হয়ে যাই৷ কচি কচি ছেলেমেয়েদেরকে গল্প কবিতা বড় কাগজ মেজ কাগজ এসবের লোভ দেখিয়ে দলে টানি৷ ওরা আমার পাশে ভিড় করে থাকে৷ আমার খুব ভালো লাগে৷ ওদের মৌতাতে নিজেকে খুঁজে পাই৷ এবারের লেখাটা তাই ওদের নিয়েই লিখব বলে ভাবি—
রমিত আর রঙ্গিতা কলেজ থেকে বেরিয়ে পাশের চায়ের দোকানটায় বসল৷ ওদের কলেজের সামনে দুটো চায়ের দোকান৷ একটায় ভিড় বেশি, অন্যটায় কম৷ ওরা এখন নির্জনতা খুঁজছে৷ কম ভিড়টাতে সেঁটে যাওয়াই ওদের পক্ষে বেশি স্বাভাবিক৷ রঙ্গিতার আঁচলের খুঁট ধরে, থুডি় ওড়নার প্রান্ত ধরে ফিসফিস করে কথা বলছে রমিত৷ রঙ্গিতার অবাধ্য হাত রমিতের ঊরুকেই তার সেরা আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ এ পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল৷ তবে এইটুকু পাঠ করার পরেই সম্পাদকের শুকনো কণ্ঠস্বর যেন খেঁকিয়ে উঠল—
আপনি মশাই একদমই বেরসিক৷ আরে গল্পের মেয়েদের অত স্মার্ট করতে নেই৷ কিছু বোঝেন না আপনি৷ একটু ন্যাকা ন্যাকা… একটু বোকা বোকা… তবুও ছেলেটা জোর করে ধরে চুমু খাবে… তবেই না রোমান্স জমবে৷

ছয়
রোমান্স সূত্রটাও কাজে লাগল না৷ নাহ্ এবারের পুজোটা মিটে গেলে ভাবছি গল্পের লাইনটা ছেডে়ই দেব৷ বড্ড ভিড় এখানে৷ দম বন্ধ হয়ে আসে আমার৷ একটুখানি খোলা হাওয়া, নরম রোদ্দুর শুকনো মাটি আমাকে টানে খু-উ-উ-ব৷ বারবার আমি ওদের কাছে চলে যাই৷ ওদের জীবনযাত্রা, সারল্য আমাকে মুক্তি দেয়৷ খোলা চুল পিঠে ছডি়য়ে আমি মেতে উঠি— আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে…
ওদের আকাশটা কি একটু বেশি নীল? নাকি অনেকটা খোলা বলেই অমন দেখায়? ওখানে গেলেই টেপির মা আমার কাছে থাকে৷ কাছের মানুষ বলেই ভাবে৷ ওদের অসীম সারল্যের সঙ্গে আরেকটা জিনিস আমার চোখে পডে় যায়৷ প্রচণ্ড দারিদ্র৷
অশুভ সংকেত পেয়ে যাই৷ তাই নিয়েই লেখা শুরু করি৷ আমার লেখার কেন্দ্রে থাকে টেপির মা৷ টেপির মাকে ঘিরেই আবর্তন করে ওদের সমাজ৷ জীবনযাত্রা৷ প্রকৃতি৷ আর প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন দারিদ্র৷
এতখানি লিখতে পেরে বেশ ভালো লাগছে৷ মনে হচ্ছে এই তো নিজের লেখা খুঁজে পেয়েছি৷ এই লেখার প্রত্যেক পরতে পরতে নিজেকে বুনে যাব এবার৷ ওদের সারল্য আর দারিদ্রকে টেনে এনে সভ্য সমাজের চোখ খুলে যাব৷ লেখাটির পুনঃপাঠ শুরু করি—
নাহ্, কেমন কাঠখোট্টা লাগে৷ বরং বারবার এসে যে শব্দটা আমায় আহত করে তা হল ‘ওরা’৷ থমকে যাই আমি৷ কখনো তো ‘আমরা’ শব্দটি লিখতে পারলাম না৷ তাহলে কেন? কেনই বা এই মিথ্যাচারণ? নিজের ভেতর জমে ওঠা প্রশ্ন-উত্তর পর্বে নিজেই আহত হই৷ কেমন অস্থির লাগে৷ মনে হয় পাগল হয়ে যাব৷

সাত
এই তো এতক্ষণে একটা সূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে৷ অনেকটা ত্রিকোণমিতির মতো—পাগলামির সূত্র৷ এই নিয়েও আজকাল বেশ কয়েকজন লেখক করে খাচ্ছেন৷ সম্পাদক মশাই তো আগেও কয়েকবার বলেছেন— আরে মশাই পাগলামির লাইনটা ধরুন না, দেখবেন ঠিক উতরে যাচ্ছেন৷ ফিট করা বুদ্ধিজীবী আছে৷ পিঠ চাপড়ানি দেওয়ার লোকের অভাব হবে না৷ কথাগুলো মনে পড়তে বেশ খানিকটা উৎসাহ পেলাম৷ দেখি একটু চেষ্টা করে—

আমাদের পাড়ায় দুটো পাগল থাকত৷ একটি আলিঝুলি হয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াত৷ একদম বদ্ধ পাগল৷ ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার দিকে ঢিল ছুডে় মারত৷ মাঝে মাঝে মাঝরাতে সে বিনবিনিয়ে সুর তুলে কাঁদত৷ পাড়ার ক্লাব ঘরের বারান্দাটাই ছিল ওর আস্তানা৷ ওখানেই সে রাতের বেলায় শুয়ে থাকত৷ ওর গোঙানির মত কান্নাটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা৷ তাই ওটা কানে গেলেও আমরা বিরক্ত হতাম না কখনো৷ তারপর ও একদিন মরে গেল৷ কর্পোরেশনের গাডি় এসে ওকে তুলে নিয়ে গেল৷ কবে— কী বৃত্তান্ত— আজ আর সেসব কিছু মনে পডে় না৷

আর একটা পাগল ছিল মনীষাবৌদিদের বাডি়তে৷ রমেশদার কীরকম যেন ভাই হয়৷ ওদের বাডি়তেই থাকত৷ শুনেছিলাম চাকরি বাকরি না পেয়ে ওটা পাগল হয়ে গিয়েছিল৷ দিনরাত খালি বিড়বিড় করত৷ হাসত৷ আর কাগজ নিয়ে আঁকি-বুকি কাটত৷ তবে তেমন ভয়ানক কিছু নয়৷ তবু ওকে দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠত৷ মনীষাবৌদি একবার আমাকে ও আমার মাকে বলেছিল, ওটাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচি৷ আমার ছোটবোন বলেছিল, আচ্ছা ও কি সত্যি সত্যি চাকরি না পেয়ে পাগল হয়ে গেছে? মনীষাবৌদি বলেছিল— আরে না না বিয়ে দেওয়ার সময় সব ছল করেছিল৷ সেই মনীষাবৌদিরই আর বাঁচা হল না৷ কাপডে় কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিল৷
নাহ্, আবার মৃতু্য এসে গেছে৷ লিখছিলাম তো পাগলামির গল্প৷ এর মধ্যে আবার মৃতু্য আসে কোত্থেকে? তবে কি পাগলামি, মৃতু্য সবই জীবনের এপিঠ ওপিঠ? গভীর থেকে গভীরতর চিন্তায় নুইয়ে পডে় আমার মাথাটা৷

আপনি মশাই বড্ড ভাবুক৷ এত ভাবুক হলে চলবে না এইখানে৷ টাকা পয়সা গাডি়-বাডি় এগুলোই তো সব৷ এক-একজন লেখককে দেখছেন না— কীকরে সব কত কিছু হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ আমার হয়েছে যত জ্বালা৷ সম্পাদকের জ্বালায় আবার কলম ধরি৷

আট
এবার কেরানির গল্প৷ হরিপদ কেরানি নয়, শ্যামাপদ কেরানি৷ ওই হল৷ হরিও যা, শ্যামও তাই৷ আমাদের এই শ্যামাপদ কেরানি এমনিতে লোক ভালো৷ শুধু একটু ধান্দাবাজ এই যা৷ ধান্দা দেখলেই টুক করে নিজের মাথাটা গলিয়ে দেয় সে৷ খায় দায়… গান গায়… তাইরে নাইরে না… ঘরে বউ আছে৷ বাইরে মেয়েছেলে আছে৷ খান তিনেক ছেলেমেয়েও আছে৷ সকলেই দু’নম্বর মাপের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পডে়৷ স্কুলবাস চেপে স্কুলে যায়৷ ওদের দেখে একটা আত্মশ্লাঘা বোধ করে শ্যামাপদ কেরানি৷ রঙিন জামা কাপড়, ঝকঝকে জুতো মোজা৷ একদিন ঘরের বউকে ডেকে সে বলল— চলো না সোনাই, এবার আমরা পুজোয় কুয়ালালামপুর বেড়িয়ে আসি৷ তা তার বউ তো এতো আহ্লাদের চোটে প্রথমে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল৷ সে বেচারা কোনোদিন পুরী দার্জিলিংই যায়নি৷ আর তাছাড়া কর্তার এত কীর্তির কথাও সে জানে না৷ সে বলল— কুয়ালালামপুর! সে তো অনেক দূর! অনেকখানি টাকা লাগবে!
শ্যামাপদ বলল— আরে টাকার কথা অত ভেবোনা ডার্লিং৷ আর টাকা টাকা করে এই যৌবনটা নষ্ট করে কী লাভ বলো?

বউ ডান হাতের আঙ্গুলের ফাঁকটা বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল— একটু হাজার মলম এনো তো৷ হাতটায় খুব হাজা হয়েছে৷
শ্যামাপদ কটমট করে বলল— হাজার মলম!
শ্যামাপদর মেজাজ গেল চটকে৷ হচ্ছিল কুয়ালালামপুরের গল্প, সেখান থেকে জাম্প মারল হাজায়৷ সত্যিই আমার কলমটা আজকাল বড্ড বেগড়বাই করছে৷ ওর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি আমি৷ নাহ্, এই শেষ বার৷
সম্পাদক মশাই আল্টিমেটাম দিয়ে গেছেন— আর কখনো আমি যদি এমুখো হই তো আমার নামে কুকুর পুষবেন৷ নাহ্ এই অপমান আর সহ্য করা যায় না৷ তাই শক্ত হাতে বাঁশের মতো করে কলমটা ধরে লিখতে শুরু করি—

নয়
গরু ঘাস খায়… গরুর দুটি চোখ আছে…. নাক কান গলা ছাড়াও আরেকটি বিশেষ অঙ্গ আছে… যার নাম গলকম্বল… গরুর দুটি শিং আছে… পশুদের মধ্যে গরুই সবচাইতে ভালো পশু… কারণ উহার রাগ, দ্বেষ, হিংসা, যৌন বিকৃতি কিছুই নাই৷ প্রজননের প্রয়োজন ছাড়া নানাবিধ যৌন সম্পর্কে গরু কখনো জডি়য়ে পডে় না৷ তাই গরুর যৌন সুনাম অত্যন্ত বেশি৷ গরুর দুটি পা… দুটি হাত…
এই পর্যন্ত লেখার পর থমকে যায় আমার কলম৷ লেখাটায় চোখ বুলাই আমি৷ আবার পডি়৷ শেষ পর্যন্ত ওটাতেই মজে যাই আমি৷ আচমকাই প্যাড থেকে পাতাগুলো ছিঁডে় নিয়ে কাগজের গোল্লা পাকিয়ে শুন্যে ছঁুডে় লোফালুফি খেলি৷