শান্তনু গঙ্গারিডি
–কী এক ফোন রে ভাই। কথা বলার সময় শুধু শুধু জ্বলে নিভে, জ্বলে নিভে।
—সমস্যাটা কোথায়?
—কল রিসিভ করে কথা বলা শুরু করলেই উড়ো জাহাজের মতো মোবাইল ফোনের আলো জ্বলা-নেভা শুরু করে দেয়।
—তাতে কী হয়।
—কথার খেই হারিয়ে যায়। কী কথা বলতে চেয়েছি, কী বলার ছিল, সব তালগোল পাকিয়ে যায় দাদা।
—কবে থেকে এসব হচ্ছে।
—এই, যবে থেকে আপনাদের এই গঞ্জে এসেছি তবে থেকে এই সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয়। না না, মনে হয় না। সত্যি বলছি এখানে আসার পর থেকেই হচ্ছে। আগে তো এমনতর কাণ্ড ঘটেনি। আনকোরা নতুন মোবাইলটা এমন পাগলামি শুরু করে দিল।
—চা খাবে?
—তা চলতে পারে।
—চলো এই টি-স্টলে বসি।
অসংখ্য ঝুরি দেখে বোঝা যায় শত বছরের পুরনো বটগাছ। এক ধারে ছোট্ট চায়ের দোকান। দুটো কাঠের তক্তা পাতা। দু জনায় টি স্টলে বসে। কিছু সময় পর ধোঁয়াওঠা গরম চা আসে। কাচের গেলাসে।
—চায়ের রংটা এমনতর নীলাভ কেন?
—এটা অপরাজিতা চা। রংটা নীল নয়। ভায়োলেট। তুমি কালার ব্লাইন্ড না হলে বুঝতে পারতে যে অপরাজিতা ফুল ভায়োলেট কালারের হয়ে থাকে।
—অপরাজিতা চা! মানে, কিছুই বুঝতে পারলাম না।
—তোমাকে মনমরা লাগছে। হতাশ লাগছে। হতাশা তাড়াতে অপরাজিতা চায়ের জুড়ি নেই।
—আমি উত্তরবঙ্গের মানুষ। চা বাগানের কাছাকাছি থেকেছি। চায়ের গন্ধ মেখে ছোটো থেকে বড় হয়েছি। কিন্তু দাদা, অপরাজিতা চা নামক পানীয় আছে বলে শুনিনি।
—সে তো অনেক কিছুই আমরা জানি না। যেমন, মকাইবাড়ি বাগানে যাবার আগে চা পাতার ভর্তা বলে একটা খাদ্যবস্তু আছে তা জানা ছিল না।
—চা পাতার ভর্তার কথা শুনেছি বটে তবে খাইনি।
—চা বাগানের কাছাকাছি ছিলে কিন্তু চা পাতার ভর্তা চেখে দেখতে মন চায়নি। তোমার কী আগ্রহ টাগ্রহ নেই নাকি! আসলে চা পাতার ভর্তার বিষয়ে তোমার কিছুই জানা নেই। একেবারেই অজ্ঞ।
—আরে জানি মশাই। চা পাতার ভর্তা কীভাবে বানায়, কীভাবে খায় সব জানা আছে।
—প্যাঁচে পড়ে অনাবিল অসত্য বলে দিলে। আশ্চর্য। যা জান না, তা স্বীকার করতে এত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেন?
—উফফ্। আপনি কি আমাকে পরীক্ষা করছেন নাকি? আপনি কি পরীক্ষক? হেড একজামিনার? যত্ত সব। মুডটা অফ করে দিলেন মশাই।
—চা পাতার ভর্তা বানানোর পদ্ধতি বর্ণনা করো তো।
—চা বাগানের লেবারদের মধ্যে পাতিচখা বা পাতিভর্তা খাবার চল রয়েছে। চা গাছের কচি পাতা সংগ্রহ করে কুচিকুচি করে কেটে তার সাথে পেঁয়াজ রসুন আদা কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি মিশিয়ে ডলে নিতে হয়। তারপর সেটাতে মুড়ি ও চানাচুর ঢেলে পাতি লেবুর রস মিশিয়ে দিলেই মুখে জল আনা পাতিচখা তৈরি হয়ে যায়। গরীব লেবারদের অনেকেই এটা খেয়ে এক বেলার ভাতের খরচ বাঁচায়।
—বাহ্ বেশ। থ্যাংকস আ লট। … তা, এই গঞ্জে আসার হেতু কী?
—নাহ্, মানে এমনি।
—নাহ্, মানে এমনি! এমন জোড়াতালি কথা বলছ কেন?
—না মানে, একজনের সঙ্গে জরুরি দরকার ছিল। তাই এসেছি।
—তা বটে, নেহাত জরুরি দরকার ছাড়া এই ব্রিজশূন্যপুরে কেউ পদধূলি দেয় নাকি!
—তা, যার খোঁজে এসেছ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হলো কি?
—না হয়নি তো। প্রথমে সিগন্যালের সমস্যা ছিল। ফোনটা রি-স্টার্ট করলাম। কিন্তু এখন ফোন করলে কল যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে কিন্তু ওদিক থেকে সাড়া পাচ্ছি না। এই দেখুন না, হ্যান্ডসেটের আলো জ্বলছে নিভছে জ্বলছে নিভছে। দু ঘন্টা ধরে চেষ্টা করে বিফল মনোরথ হয়েছি।
২
[অ]: আমি আপনার…। সরি, আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শেষ তক নিজেই তোমাকে ফোন দিলাম।
[স] : ফোন দিলাম… মানে?
[অ]: সরি, ফোন দিলাম মানে হলো ফোন করলাম।
[স]: আমিও তোমাকে বার বার ফোন ‘দিয়েছি’ কিন্তু লাগেনি। কিন্তু, তুমি ফোন করাকে ফোন দেয়া বলছ কেন?
[অ]: বাংলাদ্যাশে আমরা এরম ভাবেই বলে থাকি।
[স]: তুমি বাংলাদেশের নাগরিক। আশ্চর্য তো। সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয়ের পর থেকে একদিনও বলোনি তো।
[অ]: আমি ভারতীয়। বাংলাদেশের বাসিন্দা না।
[স]: মহা মুশকিল তো। এই যে বললে, বাংলাদ্যাশে আমরা এরম ভাবেই বলে থাকি।
[অ]: ও আচ্ছা। তুমি জানো না যে, আমরা যেখানে থাকতাম সেটা একটা প্রত্যন্ত ছিট-মহল। ভারতের অংশ হলেও বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে অবস্থিত। আমাদের গ্রাম থেকে বাংলাদেশের বাজারহাট স্বাস্থ্যকেন্দ্র মাত্র দেড় কিলো দূরে। তাই আমরা ওখানেই যেতাম। সেখানকার লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে বড় হয়েছি। নিকটবর্তী ইন্ডিয়ান শহরের দূরত্ব ছিল চার কিলো। তাই খুব কম যাওয়া হতো।
[স]: এবার বুঝতে পেরেছি। দূরত্বকে তোমরা কিলো বলো। আমরা কিলোমিটার বলি। আমরা জিনিসপত্র ওজনের সময় কিলো বলি। কিলোগ্রাম বলতে চাই না। দূরত্ব বোঝাতে তোমরা কিলো বললে আমাদের কানে লাগে। এই আর কী।
[অ]: বুঝতে পেরেছি। তুমি আবার জ্ঞান বিতরণ শুরু করলে।
[স]: আহা, জ্ঞানটান নয়। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। আচ্ছা, আমি যখন কবিতা আবৃত্তি করি তখন ভাল লাগে না বুঝি।
[অ]: তা লাগে।
[স]: তোমার গানের গলা কিন্তু দারুণ।
[অ]: অনেক কথা তো হলো। শিমুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে না থেকে চলো নদীর কাছে যাই। নদীর সঙ্গে গল্প করতে করতে তোমার সঙ্গেও দু-চার কথা হবে।
ওরা হাঁটতে লাগলো। এর মধ্যে অন্তত দু-তিন বার সেই মোবাইলটা বেজে উঠলো। হ্যালো হ্যালো বলাই সার। কথা শোনা গেল না। হ্যান্ডসেটের আলোটা অ্যাম্বুলেন্সের মতো জ্বলা নেভা শুরু করল।
৩
এই ব্রিজশূন্যপুর গ্রাম থেকে নিকটবর্তী শহরের দূরত্ব কমসে কম দশ কিলোমিটার। শহরে যাবার রাস্তা মোটামুটি চলনসই। গ্রামের পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে তিন কিলোমিটার এগোলে পাগলাদিয়া নদী। পাগলাদিয়া নদী পার হবার পর আরো সাত কিলোমিটার দূরে পাগলাদিয়া শহর।
শোনা যায় পাগলাদিয়া নদীর দুই পাড়কে যোগ করার জন্য সেই ব্রিটিশ আমলে একটি লোহার পুল তৈরি করা হয়েছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পিলার টলে গিয়ে ব্রিজ কাৎ হয়ে গেছিল। স্বাধীনতার সত্তর বছরে বার তিনেক কংক্রিট ব্রিজ খাড়া করা হয়েছিল বটে তবে প্রতিটি প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। এখানকার বালি মাটির চরিত্র বড্ড গোলমেলে। বিষয়টা বুঝতে পেরে এখন আর কেউ পুল তৈরির প্রস্তাব দেয় না। নদী পেরোবার জন্য যে একটা সাঁকো থাকা দরকার সেটাও এখানকার লোকজন আর ভাবে না।
নদীটা শীর্ণকায়া হয়ে পড়ায় রিকশা মোটরগাড়ি সহ সকল ধরনের যানবাহন নদীর মধ্যে দিয়েই এপার ওপার করে। মানুষ জন হেঁটে পারাপার করে। দিব্যি চলে যাচ্ছে।
[অ]: এটাই হলো আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে। মোটামুটি সারা বছরই শুকনো থাকে। বর্ষায় বড়জোর হাঁটু জল হয়।
[স]: তার মানে সাইকেল মোটরগাড়ি নদীর বুক পেরিয়েই চলাচল করতে পারে। বেশ মজার তো। চলো আমরাও একটু পা ভিজিয়ে নিই।
[অ]: দিদিমার কাছে শুনেছি এই নদীতে সেই ব্রিটিশ আমলে লোহার পুল তৈরি হয়ে ছিল। কিন্তু কিছু দিন বাদেই চিৎপটাং হয়ে যায়।
[স]: তারপর আর চেষ্টা হয়নি?
[অ]: হয়েছিল। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তারপর থেকেই তো গ্রামের নাম ব্রিজশূন্যপুর হয়ে গেল।
[স]: তোমাদের এলাকাটা এত সুন্দর কিন্তু লোকগুলো কিছুটা অদ্ভুত বটে।
[অ]: কেন?
[স]: চায়ের দোকানে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো তাঁকে বেশ ভালই লাগছিল। পরে বুঝলাম লোকটি খিটকেল টাইপের।
[অ]: হায় হায়! সাড়ে সর্বনাশ হয়ে গেছে…!
[স]: সাড়ে সর্বনাশ, মানে। কীসের সর্বনাশ।
[অ]: তুমি কি দুলু মামার সঙ্গে বসে চা খেয়েছ? বট গাছটার পাশে চায়ের দোকানে? তাহলেই সেরেছে!
[স]: খাইসে, ডাইনো আইসে!
[অ]: ইনিই আমার দুলু মামা। ডাইনোই বটে। দেহখানা দেখেছ তো। একটু লেংচে হাঁটেন। মনে কোনো প্যাঁচ নেই। তবে বড্ড বেশি কথা বলেন। চ্যাটারবক্স। একদিকে আধুনিক, অন্যদিকে কনজারভেটিভ। তাঁর চোখে ধুলো দিয়েই তো তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। বকবক করে তোমাকে নাজেহাল করে ছেড়েছেন, নিশ্চিত।
৪
[স]: এই চাঁপা গাছটাকে যদি মাঝে মাঝে একটু ছেঁটে দেয়া যেত তাহলে ভাল হতো। ডালপালা ছড়িয়ে আরো অনেক ফুল ফুটতো।
[অ]: তা ঠিক। কিন্তু করবেটা কে?
[স]: এটা সাদা চাঁপা। আরো কিছু রঙের চাঁপা ফুল রয়েছে। চাঁপা ফুলের অনন্য সুবাসের জন্য অনাদি কাল থেকে মন্দিরে মন্দিরে এই ফুলের বিশাল চাহিদা।
[অ]: ঠিক ঠিক। কৈলাসেও নাকি চাঁপা ফুল রয়েছে।
[স]: কেষ্ট ঠাকুরের প্রিয় ফুলও এটা।
[অ]: হ্যাঁ, দিদিমার মুখে শুনেছি।
[স]: বৃন্দাবনে পৌঁছানোর পর যখন কৃষ্ণর খোঁজ মিলছে না তখন গোপিনীরা চাঁপা গাছগুলোকে জিজ্ঞেস করত যে, ওরা কৃষ্ণকে ওদের আসপাশ দিয়ে যেতে দেখেছে কিনা!
[অ]: দারুণ, দারুণ।
[স]: তোমাকে কাছে পেয়ে সুনীলের কবিতাটা বেশি মনে পড়ছে,
‘হাত ভরা চাঁপা ফুল, কে এনেছে রুপােলি শিকল
সে কি বিকেলের ব্যাধ? দীর্ঘকাল, দীর্ঘকাল উপবাসী চোখ
মাঝখানে নিস্তব্ধতা, ক্ষণিক না অলৌকিক
আকাশ ঘুমিয়ে আছে আকাশের নীল বিছানায়
বাতাস হারিয়ে গেছে, যেখানে সবাই যেতে চায়
আমাকে শিকল দাও, তুমি চাঁপা ফুলগুলি নেবে?’
[অ]: এই নদীর দু-কূল জুড়ে অনেক চাঁপা ফুল আর চাঁপা ফুল।
[স]: সুনীলের কবিতাটা আমার প্রিয়। তবে অপরাজিতা নিয়ে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতাটা মানতে পারি না। ‘পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে, তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম? গন্ধ কি তোর বিন্দুমাত্র আছে? বর্ণ-সেও ত নয় নয়নাভিরাম। ক্ষুদ্র শেফালি, তারও মধুর-সৌরভ; ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি; গরবিনী, তোর কিসে তবে গৌরব! রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!’
[অ]: মন খারাপ করার কী আছে? কবি তাঁর ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। অন্য আরেকজন অন্যভাবে দেখেছেন হয়ত।
[স]: অপরাজিতার গুণাবলীর শেষ নেই। আর, তোমাদের এখানে তো দেখছি অপরাজিতা চা অব্দি পাওয়া যায়।
[অ]: কী করে জানলে যে অপরাজিতার গুণাবলীর শেষ নেই। ফ্লার্ট করছ না তো!
[স]: ফ্লার্ট করব কেন? তোমার দুলু মামা অপরাজিতা চা খাওয়ালেন তো। সেই সঙ্গে গুণাবলীও বর্ণনা করলেন।
[অ]: মামার সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেছে দেখছি। মামাকে হাত করতে পারলে মা-কে বোঝাতে অসুবিধা হবে না।
[স]: চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দুলু মামা বলেছিলেন তোমাদের এখানে বাণিজ্যিকভাবে অপরাজিতার চাষ হয়ে থাকে।
[অ]: সত্যি তাই। এখানকার অপরাজিতা দূর দূরান্তে চলে যায়।
[স]: আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই কিছু কিছু না পাওয়ার অতৃপ্তি থাকে। হয়তো যা চেয়েছি তা পাইনি কিন্তু যা চাইনি তা অনায়াসেই পেয়ে গিয়েছি।
[অ]: যেমন?
[স]: যেমন তোমাকে!
[অ]: প্রথম সান্নিধ্যেই এতটা মনে হচ্ছে…!
[স]: হচ্ছে তো। তোমার কাছে মনের কথা লুকিয়ে রাখতে পারব না।… রোদের তেজ কমে এসেছে। একটা গান শোনাবে না?
[অ]: (গান ধরে)
‘ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা,
আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা॥
আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি,
আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা॥
ওগো নদী, চলার বেগে পাগল-পারা,
পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা–
আমার চলা যায় না বলা– আলোর পানে প্রাণের চলা–
আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তারা॥’
গান শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আজ পূর্ণিমা, তাই চরাচর ঢাকা পড়েনি।
[স]: সোশ্যাল মিডিয়ার রীলে তোমার গান শুনেছি। আজ সরাসরি শুনে মুগ্ধ হলাম। দরদিয়া মিষ্টি গলা। মনে হচ্ছে, রবিবাবু তোমাদের এই পাগলাদিয়া নদীর কথা ভেবেই এই গানটা লিখেছিলেন।
[অ]: মনে হলে তো হবে না। কবিগুরু বোলপুর থেকে কলকাতা যাবার সময় ট্রেনে বসে এটা লিখেছিলেন। সেই ১৯১৫ সালের লেখা গান। শতাধিক বছর কেটে যাবার পরেও এত জনপ্রিয়।
[স]: জানো তো, নদীর স্রোতের কথা মনে হলেই এই গানের কলি ভেসে ওঠে।
[অ]: কিন্তু, মহাশয়। এই গান নদীকে নিয়ে লেখা নয় মোটেই।
[স]: অ্যাঁ!!
অ: অ্যাঁ নয় গো, হ্যাঁ। আমি জেনেবুঝে ভেবেচিন্তেই বলছি।
[স]: কী যা তা বলছ! শুরুতেই তো পরিষ্কারভাবে বলা আছে, ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা…।
[অ]: কিন্তু, তার পরের পঙ্ক্তি গুলোতে কি আছে?
[স]: পরের লাইনে, আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা।
[অ]: ঠিক তা-ই। আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু। মানে হলো, আমি হলাম চাঁপা ফুলের গাছ। গাছ তো, তাই স্তব্ধ; কথা বলি না।
[স]: এভাবে তো কোনোদিন ভেবে দেখিনি।
[অ]: তারপর বলা হয়েছে, আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি। তার মানে, আমি তো গাছ তাই চলতে পারি না। সে অর্থে আমি অচলই বটে। কিন্তু আমিও সংগোপনে চলাফেরা করে থাকি।
[স]: হ্যাঁ, তারপরেই বলা হয়েছে, আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা।… গূঢ় রহস্য বটে!
[অ]: এই তো, বিষয়টা তোমার উপলব্ধিতে এসেছে। একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারা যায়, এই গানের কলিগুলোর মাধ্যমে নদীর তীরে বেড়ে ওঠা একটি চাঁপা গাছের আত্মকথা বর্ণনা করা হয়েছে।… আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা-র অর্থ হলো নদীর জলে আমার পাতা পড়ে। তারপর স্রোতে ভেসে যায়। ফুলও ভেসে যায়। আমার কাণ্ড অচল বটে, কিন্তু আমার ফুলেরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে যায়। ফুলের প্রোপাগ্যাশনের মাধ্যমেই আমার চলা ফেরা। আমি অচল হয়েও সচল। আমার ফুলেরা নদীর তীরে তীরে পৌঁছে অঙ্কুরোদগম ঘটায়। বংশ বিস্তারের মাধ্যমেই আমি সচল।
[স]: কবি বলছেন, আমার চলা যায় না বলা– আলোর পানে প্রাণের চলা–
[অ]: তারপরের লাইন, আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তারা।
[স]: হ্যাঁ, আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে যা বুঝতে পারি না আকাশ ও নক্ষত্র তা বুঝতে পারে।
[অ]: তুমি না সঞ্জয়! মহাভারতের সঞ্জয় মহর্ষি বেদব্যাসের কৃপায় দিব্যদৃষ্টি পেয়ে ছিলেন। সেই দিব্যদৃষ্টির দৌলতে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছিলেন।
[সঞ্জয়]: আমি হলেম গিয়ে কলিকালের সঞ্জয়। রবি ঠাকুরের গানের এই বহুরৈখিকতা ধরতে পারিনি। স্বীকার করতেই হবে, হি ওয়াজ আ পোস্টমডার্ন পোয়েট। আ ভার্সেটাইল জিনিয়াস। …বাই দি ওয়ে, তোমার নামের উৎসটাও আজকে বুঝতে পারছি। অপরাজিতা নামটা কি তোমার দুলু মামার দেয়া?
[অপরাজিতা]: ঠিক ধরেছো। নামটা দুলু মামাই দিয়ে ছিলেন।… রাজনৈতিক ভাবে তিনি লাল ঝান্ডার লোক। বোমা ফেটে বাঁ পায়ের পাতা উড়ে গেছিল।… তিনি প্রকৃতি প্রেমিকও। অপরাজিতার ভায়োলেট রং পছন্দ করেন। ভায়োলেটকে নীল বললে চটে যান।… চলো আজকেই তাঁর সঙ্গে ফর্মাল পরিচয় হয়ে যাক।
[সঞ্জয়]: ‘দিগন্তে মেখলা তব টুটে আচম্বিতে অয়ি অসংবৃতে! স্বর্গের উদয়াচলে মূর্তিমতী তুমি হে উষসী, হে ভুবনমোহিনী উর্ব্বশী।…’
মোবাইল ফোনটা বার কয়েক বেজে ওঠে। কিন্তু কথা শোনা যায় না। আলো জ্বলে, আলো নেভে।
অপরাজিতা সঞ্জয়কে নিয়ে সেই চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। একশো ওয়াটের পুরনো ধরনের ইলেক্ট্রিক বাল্ব জ্বলছে। ফিলামেন্ট থেকে বের হওয়া হলুদ আলো জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ভৌতিক মোবাইল হ্যান্ডসেটের আলোটাও জ্বলছে নিভছে, জ্বলছে নিভছে। সঞ্জয় বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। অন্যের মোবাইল ব্যবহারেও দ্বিধা।
দুলুবাবু তিন কাপ অপরাজিতা চায়ের অর্ডার দিলেন।