সঙ্ঘশ্রী সেনগুপ্ত
সাদার ওপর নীল ছাপাছাপ ছুরিতে খসখস করে পেঁয়াজ কাটছে পাম্মী আন্টি। মোটামোটা করে পেঁয়াজ টুকরোর পর, বেশ কয়েকটা রসুন ছাড়িয়ে, কাঁচালঙ্কা শুদ্ধু মিক্সিতে বেটে ফেললেই তৈরি হয়ে গেল আন্ডাকারির মশলা। তারপর সব্জী, ডাল এর যোগাড় শুরু। পেঁয়াজভাজা আর শাহী গরমমশলার সুগন্ধ ভুলিয়ে দেয় এটা পাঞ্জাবের নয় আমেরিকার মাউন্টেনভিউ-এর রান্নাঘর।
একসপ্তাহ আগে মহিলাকে যখন প্রথম দেখছিলো, একটাও কথা বলেনি সুপ্রিয়া। ভারী বিরক্ত লাগছিলো, যেন ছেলের সংসারে অনাবশ্যক লোকের আমদানি। বাবুনকে সোনু সোনু বলে তড়কা আর রুটি খাওয়ানো দেখে গা জ্বলে যাচ্ছিলো। কে না কে একজন মহিলা বাবুনকে একেবারে ছেলে বানিয়ে ফেলেছে! বাবুন রুটি ভালোবাসতো না কোনোদিন, সেও সোনামুখ করে খেয়ে যাচ্ছে। হাত করে ফেলছে একেবারে।
বাবুন পরে বলেছিলো, ‘মা, পরেরদিন পাম্মী আন্টি এলে একটু কথা বোলো। নইলে খারাপ লাগে। তুমি তো জানো, এদেশে কেউ কাজের লোক ভাবে না কাউকে।’ বিরক্ত লাগলেও আজ সুপ্রিয়া তার ভাঙাচোরা হিন্দিতে দু-একটা কথা তাই জিজ্ঞেস করছিলো বাবুনের পাম্মী আন্টিকে। বাবুনের কোনও এক বন্ধুর বাড়িতে রান্নার কাজ করতো এই পাঞ্জাবি মহিলা, অফিস থেকে ফিরে রোজ কিনে খেতে ইচ্ছে করে না, শরীরও খারাপ হচ্ছিল তাই ওই দেবাংশুই এর কথা বলে বাবুনকে। তারপর থেকেই পাম্মী আন্টি পাকাপাকি দখল করেছে রান্নাঘর। তবে সপ্তাহে একদিন। অতি দ্রুতগতিতে নিরামিষ, আমিষ, ডাল তৈরি করে দেয় সারা সপ্তাহের জন্য। প্রায় বছর পঞ্চাশেক বয়স, হাতে লেটেস্ট আইফোন, কামিজের নিচে জিনস পরা, হাসিমুখের পাম্মী, ক্যালিফোর্নিয়ায় বে এলাকার অনেক ভারতীয় পরিবারগুলোর ভরসা। সকালে শ্রীকান্ত আয়ারের বাড়িতে তার কচি বাচ্চাকে আটঘন্টা যত্নআত্তি করে, পাম্মীআন্টি উবার নিয়ে পৌঁছে যায় কোনোদিন সাগর ব্যনার্জীর বাড়ি, কোনোদিন পট্টনায়েকের বাড়ি, কোনোদিন কৃষ্ণানদের বাড়ি। কোথাও পাঁচফোড়ন, কোথাও সর্ষে কারিপাতার ফোড়নে পাম্মীআন্টি ‘ঘর কা খানা’ বানাচ্ছে। পরিপাটি করে গুছিয়ে দিচ্ছে আধুনিক রান্নাঘর। বাসনপত্র ভরে দিচ্ছে ডিশ-ওয়াশারে।
সুপ্রিয়া আজ ষোলো দিন হল ছেলের কাছে এসেছে। দু’বছর ধরে ছেলের এই একার সংসারে খানা বানাবার দায়িত্ব পাম্মী আন্টির ওপরে। সপ্তাহে একদিন এসে বানিয়ে দেয় সারা সপ্তাহের খাবার। কৌটোবন্দী করে তাদের ঢুকিয়ে দেয় ফ্রিজের গভীরে। যে ছেলেটা বিউলির ডাল, সাদা পোস্তর তরকারি, সর্ষে মাছের বাইরে কিচ্ছু খেতে চাইতো না সে অবলীলাক্রমে পাম্মী আন্টির হাতের রাজমা চাউল খায়। বুকের মধ্যে কেমন একটা হুহু করে সুপ্রিয়ার। কী যে দরকার ছিল, এত দূরদেশে এসে পড়ে থাকার। আজকাল মনে হয় ছেলেটাকে জোর করে দেশে রেখে দিলেই ভাল হত। এখন পরিযায়ী পাখির মত প্রতি ডিসেম্বরে ছেলে একবার যায় ওটুকুই। সংসার চাকরি সামলে সুপ্রিয়া এই নিয়ে সাতবছরে তৃতীয়বার এল। তবুও কতটুকুই বা ছুঁতে পারে ছেলেকে, দূরে থেকে কেমন যেন পর হয়ে গেছে মনে হয়। আগে তবুও এটাওটা খাবার বানিয়ে ছেলের মন ভরাতো, এবার সেটাও ঠিকঠাক হচ্ছে না।
‘দ্যাখ বাবুন আমি যে কদিন আছি, কোনো দরকার নেই তোর ওই আন্টির, কী ছাতার মাথা রান্না করে তার জন্য আবার এতগুলো করে টাকা দেওয়া’— ছেলেকে বলেছিল সুপ্রিয়া।
আমলই দিল না ছেলেটা, ‘না, না মা, পাম্মী আন্টিই ভালো। আমি তো ছোলে, রাজমা চাউল খুবই ভালো খাই। তোমার আর এত কষ্ট করতে হবে না। কয়েকদিনের জন্য এসেছো, আরাম করো তো একটু।’
মাত্র সাত বছরে জিভের স্বাদও বদলে গেল, তবুও তো এখন বিয়ে করেনি, করলে আরও কতকিছু বদলে যাবে কে জানে! গজগজ করে সুপ্রিয়া। তখন হয়ত মা কেই অতিরিক্ত মনে হবে। আজকাল কথায় কথায় চোখে জল চলে আসে, বাবুনের ছোটবেলার কথা মনে হয়, নাকতলার বাড়ির কথা মনে হয়৷ সুপ্রিয়ার অফিস ছুটি থাকলে স্কুল থেকে এসেই মা কে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করতো, মা আজ তুমি রান্না করেছো না গায়ত্রী মাসি? মা করেছে, শুনলেই একমুখ হাসি। কোথায় চলে গেল দিনগুলো। আচ্ছা, বাবুন কী আর আগের মত ভালোবাসেনা ওকে? কী জানি! বাবুনের জীবনের প্রায়োরিটি লিস্টের তলার দিকে চলে যাচ্ছে না তো সুপ্রিয়া। ভয় করে, বড় অনিশ্চিত লাগে। কলকাতায় থাকলেও মনটা সুপ্রিয়ার এই বাড়িতেই রেখে যায় প্রতিবছর।
কুমকুম বলতো, ‘তুই বড্ড বেশিবেশি করিস সুপ্রিয়া, বাবুনকে ছাড় এবার। ছেলে যেন আর কারোর হয় না, ছাড়তে পারা ও একটা বড় পারা’ আজকাল কুমকুমকে এড়িয়ে চলে সুপ্রিয়া। কী করে বুঝবে কুমকুম কুড়ি হাজার কিলোমিটার ছাড়া মানে কতটা ছাড়া, চাকরি করতে যাওয়ার কয়েকঘন্টা ছাড়া বাবুনের জামাজুতো, অঙ্কের ক্লাস, আঁকার মিস— এই নিয়েই তো জীবন ছিল সুপ্রিয়ার। এমনকী অফিস গিয়েও মাছের টুকরোটা গায়ত্রী ঠিক দিল কিনা কতবার মনে পড়তো। সেই বাবুনকে ছেড়ে থাকা, কী বুঝবে কুমকুম। মাউন্টেন ভিউ-এর এই রাস্তার বাড়িগুলো এত সুন্দর, প্রতিটি বাড়ির সামনে ফুলের ঝাড়। বড়বড় ম্যাগনোলিয়া গাছ ফুলে ভরে আছে। সব গাছ চেনেনা সুপ্রিয়া, কিন্তু চুপচাপ একা দাঁড়িয়ে সময় কেটে যায় বেশ। কত কথা মনে পড়ে, সবই বাবুনের কথা।
পনীরকে টুকরো করে এর মধ্যে হালকা ভেজে ফেলেছে পাম্মীজী। কড়াইশুঁটি ছাড়িয়ে মটর পনীরে যোগাড়যন্ত্র করে চলেছে, মুখে হাসি লেগে আছে। ‘সোনু পনীর না ভাজলে খেতে পারে না ভাবীজী, তাই ভেজে নিলাম পনীরটা’।
কেমন যেন বিরক্ত লাগছিলো সুপ্রিয়ার। ইচ্ছে করছিলো না কথা বলতে, তবুও ভদ্রতার খাতিরে সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কতদিন এখানে এসেছেন পাম্মীজী?’
ভাঙাচোরা বাঙালায় পাম্মী আন্টি বললেন ‘আট সাল ভাবীজী’
‘ইতনাদিন হো গয়া।’
‘হাঁ ভাবীজী।’
‘দেশে কে কে আছে আপনার?’
‘মেরা পতি ঔর দো বেটি বলবীর, রাজবীর ঔর এক বেটা হরজিৎ।’
‘ও তাহলে সবাই দেশে। কোথায় থাকে ওরা?’
‘পাতিয়ালা ভাবীজী।’
‘বছরের কোন সময়ে যান আপনি পাম্মীজী? ওরা আসে কখনও?’
‘আট সালে কখনও যাইনি দিদিজী। ওরাও আসেনি। আমার হরজিৎকে বারা সাল দেখে এসেছিলাম, সে এখন কুড়ি সালের লায়েক ব্যাটা। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। বড়র জলন্ধর আর ছোটর পাতিয়ালাতেই শ্বশুরঘর।’
‘আপনি গেলেন না বিয়েতে? সে কী? দুই মেয়ের বিয়ে দেখলেন না?’
‘না ভাবীজী। আমি তো যেতে পারবো না। কানাডার ভাইয়া নিয়ে এসেছে আমাকে। খরচও হয়েছে অনেক। আর ফেরৎ যেতে পারবো না আমি। কাগজপত্রও তারই বানানো সব। এ কাগজে আমি থাকতে পারি ভাবীজী, লেকিন গেলে আর ফিরা যাবে না।’
‘তা বলে ছেলে মেয়েকে দেখবেন না? স্বামীকে দেখবেন না?’
‘না, ভাবীজী। এখান থেকে টাকা পাঠাই প্রতিমাসে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, দহেজই তো বিশ লাখ করে লেগেছে।’
‘এ কেমন কথা, এতদিন তাদের দেখোনা?’ মুখ থেকে তুমি বেরিয়ে যায় সুপ্রিয়ার। ‘খারাপ লাগেনা তোমার? আরে বাবা তারাও তো মনখারাপ করবে, অদ্ভুত ব্যাপার। তাহলে দেশেই ফিরে যাও, অনেক কিছু তো করেছো, আরও কত চাই শুনি? তোমার হরজিৎ এর কথাটাও ভাবো।’ সুপ্রিয়ার গলার স্বর কেমন একটা খসখসে হয়ে উঠলো।
এক মুহূর্তের জন্য হাসিটা মিলিয়ে গেল মুখ থেকে, চোখটা একটু যেন ছলছল করে উঠলো, প্রায় ফিসফিস করে পাম্মীজী বলে, ‘না, ভাবীজী, তারাও চায় না আমি ফিরে যাই। দো ওয়াক্ত খানা জোগাড় করতে আগে হিমশিম খেতো হরজিৎ-এর পিতাজী। ধার করে অনেক কষ্টে এদেশে এলাম। এখন আমার এই টাকায় ধার শোধ হয়ে জমিজিরাত কেনা হয়েছে, সামনের বছর ট্রাকটার কেনা হবে। বাড়ি দোতলা হলো, সামনে ব্যালকনি ভি হয়েছে। আমি ফেসটাইম করি, ছবি দেখি রোজ। এবার গেঁহু, সর্ষে সবকুছ বহোত আচ্ছা হয়েছে, লেকিন আমার ফিরা আর হবে না।’
সুপ্রিয়ার চোখ জ্বালা করে, গলা বন্ধ লাগে, পাম্মী আন্টির ততক্ষণে আবার হাসি ফিরে এসেছে মুখে, গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে ওর, হাসি-হাসি মুখ করে তার আইফোন খুলে ছবি দেখাচ্ছে, ‘ভাবীজী দেখিয়ে, ইয়ে হ্যয় মেরে রাজবীরকে বড়ে বেটা। বহোত নটখট হ্যায়। ফেসটাইম মে দাদীজী দাদীজী…’।