বিশ্বনাথ পাল
হাঁটু ভাঁজ করে স্যুটকেসটা নামাতে গিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল নান্টু। রাস্তার পাশে পানের দোকানের লোকটা তাকে নজর করছে না? হ্যাঁ, ঠিক, লোকটার চোখ এদিকেই। না, স্যুটকেসটা এখানে রাখা ঠিক হবে না। কোত্থেকে আবার কে পুলিশে খবর দেবে। দরকার নেই এখানে স্যুটকেস নামিয়ে।
নান্টু আবার হাঁটতে শুরু করে স্যুটকেসটা ডান হাতে ঝুলিয়ে। বড় রাস্তায় এসে সে ফুটপাথ ধরে চলতে শুরু করল। ভাবল ফাঁকা জায়গার থেকে ভিড়ের মধ্যেই স্যুটকেস নামিয়ে সরে পড়া সহজ। ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলে কে স্যুটকেস রেখেছে নিশ্চয়ই কেউ বুঝতে পারবে না। হঠাৎ নান্টুর নজরে পড়ল রাস্তার পাশে একটা মার্কেট কমপ্লেক্স। তিনতলা বিল্ডিং। নান্টু আর দেরি না করে ঢুকে পড়ল। লোকজন আছে, তবে খুব ভিড় নেই। মাঝারি ভিড়। মাস তিনেক বাদে পুজো বলেই এটুকু ভিড়। না হলে হয়তো তা-ও থাকত না এই দুপুরে।
নান্টু মনোরমা বস্ত্রালয়ের সামনে কয়েক জন ক্রেতার পিছনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে স্যুটকেসটা রেখে সরে পড়তে যাবে, এমন সময় তার কাঁধে যেন একটা বাঘের থাবা এসে পড়ল। সঙ্গে বাজখাঁই গলায় সে শুনল, ‘এখানে বোম রেখে কোথায় পালাচ্ছ চাঁদু?’
নান্টুর প্রথমে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তারপর থাবার থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে সে ব্যর্থ হয়। লোকটার গায়ে অসুরের শক্তি, নান্টুর অপুষ্টিতে ভোগা শরীরের সাধ্য কী যে ছাড়াবে! লোকটার গলার জোরে আরও লোক জড়ো হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই দোকানের ক্রেতাদেরও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল সে। দোকানের মালিক বললেন, ‘বোম রাখার জন্য আমার দোকানই পছন্দ হল?’
‘এই একটা দড়ি আন তো?’ একজন বলল।
দড়ির কথা শুনে নান্টুর চক্ষু চড়কগাছ। এবার তাকে নির্ঘাৎ লাইট পোষ্টের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধা হবে। তারপর চলবে তাকে উদোম কেলানো। তাকে মেরে পাবলিক হাতের সুখ করবে। তার ভবলীলা সাঙ্গ করা হবে। নান্টু আর ভাবতে পারে না। তার মনে হয়, আহা কত দিন ইলিশ মাছ খাওয়া হয় না। তার বিধবা মায়ের হাতের সর্ষে-ইলিশ দিয়ে সে নিমেষে এক থালা ভাত সাবাড় করে দিতে পারে। পুঁটিকে সামনের রথের মেলায় নাগরদোলা চড়ানোর কথা ছিল। এজন্মে আর হল না। পুঁটি নান্টুর প্রেমিকা। দেশের বাড়ির পাড়ায় থাকে। ব্যবসায় ভাল রোজগারপাতি হলে খুব শিগগির তাদের চার হাত এক হবে এমনই আশা ছিল।
নান্টুর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে ঝুঁকে বাঘের থাবাধারী মানুষটির পায়ে পড়তে চাইল, ‘বিশ্বাস করুন এই স্যুটকেসে বোম-টোম কিছু নেই। আমাকে মারবেন না।’
‘বোম নেই? তা তুমি স্যুটকেস রেখে পালাচ্ছিলে কেন?’
উত্তরটা আর দেওয়া হল না, কেউ একজন ঘুঁষি চালিয়ে দিল। নান্টুর মুখ ফেঁটে রক্ত। মুখে হাত দিয়ে সে বলল, ‘আমাকে মারবেন না, আপনারা পুলিশে খবর দিন।’
তার মনে হয় পুলিশই এখন এই মারমুখী জনতার হাত থেকে তাকে বাঁচাতে পারে।
লোকগুলোর বেশ দয়ামায়া আছে বলতে হবে। পুলিশে খবর দেওয়া হল। দু’তিন কিলোমিটারের মধ্যেই থানা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে নান্টুকে তুলে নিয়ে গেল কিংবা উদ্ধার করল বলা যায়। কিন্তু নান্টু তো আর ছিঁচকে চুরির দায়ে দোষী নয়। সে একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি। খবর গেল লালবাজারেও। বিশাল পুলিশ বাহিনী এসে নান্টুর রাখা স্যুটকেসের জায়গা কর্ডন করে রাখল। হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা করা হল দ্রুত মার্কেট চত্বর খালি করার।
খবর পেয়ে টেলিভিশন চ্যানেলের লোকজনও হাজির। দুরন্ত খবর। ব্রেকিং নিউজ দেখানো হতে লাগল। সূর্য মার্কেট কমপ্লেক্সে একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি ধরা পড়েছে। সে একটি স্যুটকেস রেখে পালাচ্ছিল। পুলিশের সন্দেহ স্যুটকেসে বোম আছে। মার্কেট চত্বর ফাঁকা করে পুলিশ এলাকাটি ঘিরে রেখেছে। বোম ডিফিউসাল স্কোয়াডে খবর দেওয়া হয়েছে।
বুম হাতে ক্যামেরার সামনে এত বড় ব্রেকিং নিউজ সম্প্রচারের সময় ঘোষিকার ঠোঁটের কোণে মৃদু ফুর্তির আভাস। স্বাভাবিক। ব্রেকিং নিউজ কভার করার কেতাই আলাদা।
নান্টুকে স্থানীয় থানা থেকে নিয়ে যাওয়া হল লালবাজারে। পুলিশের একাধিক কর্তা তাকে ঘিরে জেরা করতে লাগলেন।
‘বল। কোন জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে তোর যোগ আছে? আইসিস?’
নান্টু বলে, ‘আরে আমি জঙ্গি নই, জঙ্গি হলে কি কেউ স্যুটকেসে বোম নিয়ে যাবে? পেটে বেঁধেই নিয়ে যাবে। জঙ্গিদের এখন আত্মঘাতী হামলাই পছন্দ।’
পুলিশ-কর্তার সন্দেহ আরও বেড়ে যায়, ‘জঙ্গিদের পছন্দ-অপছন্দের খবর তুই রাখিস, তুই জঙ্গি ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারিস না।’ ঠিক এই সময় কেউ একজন তাঁর কানে কানে বলে, ‘স্যার উনি কিন্তু কোনও ছিঁচকে চোর নন। জঙ্গি। আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্যও হতে পারেন। এভাবে তুই-তোকারি করা কি ঠিক হচ্ছে?’
ফলে পুলিস-কর্তার সম্বোধন পালটে যায়, ‘আপনি আপনার দোষ স্বীকার করে আমাদের তদন্তে সাহায্য করুন।’
নান্টুর ভীষণ অবাক লাগে। আজ পর্যন্ত কত জন তাকে আপনি করে বলেছে হাতে গোনা যাবে। এই সুযোগে সে বলল, ‘স্যার এক গ্লাস জল পাওয়া যাবে? ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।’
পুলিশকর্তা ইশারায় একজনকে জল আনতে বললেন। তার মনে এখন মৃদু খুশির হাওয়া। এই রোগা-পাতলা ছেলেটা যদি সত্যি সত্যি জঙ্গি হয়, তবে তাঁর কেরিয়ারে নতুন পালক। জঙ্গি ডিল করা কি সোজা ব্যাপার? ছেলেটাকে দিয়ে দোষ স্বীকার করিয়ে কোর্টে তুললেই হয়! হয়তো শিগগির প্রোমোশন জুটে যাবে।
২
অবশেষে লাইন পাল্টানোর কথা ভাবছে নান্টু। ভাববে না-ই বা কেন? সামান্য একটা হাতসাফাই করতে গিয়ে যদি এত নাকাল হতে হয়, তবে কার ভাল লাগে? তা-ও আবার এমন একটা স্যুটকেসের হাতসাফাই, যার মধ্যে নান্টুর কাজে লাগার মতো কিছুই ছিল না। সেটা রাখতে গিয়েই যত বিপত্তি।
সেদিন যাত্রী সেজে বাসে উঠেছিল নান্টু। সঙ্গে সহকারী পচা। পচা প্রায় ছ’মাস ধরে নান্টুকে সহযোগিতা করছে। নানান কায়দা ফিকির করে টার্গেটকে বিরক্ত করে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়া তার কাজ। আর সেই সুযোগে নিপুণ শিল্পীর মতো কাজ হাসিল করে নান্টু। যেন পচার বাড়ানো পাসে নান্টুর গোল।
সেদিন অবশ্য নান্টুকে তেমন কিছুই করতে হয়নি। ভিড় বাসে নান্টু হাতল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সামনের সিটের বসা লোকটি নেমে গেলে সে আর বসার লোভ সামলাতে পারে না। আর ঠিক তখনই পাশের দাঁড়ানো একটি লোক তার হাতের স্যুটকেসটি নান্টুর দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইঙ্গিতটি পরিষ্কার— নান্টু যেন তার স্যুটকেসটা কোলে রেখে তার কষ্ট লাঘব করে।
পচাও কাছাকাছিই ছিল। নান্টুর কোলে স্যুটকেসের উপস্থিতিতে পচার চোখও চকচক করে। ভাল মালকড়ি নিশ্চয়ই আছে এতে। একেই বলে মেঘ না চাইতেই জল। সে স্যুটকেসের মালিককে ধাক্কা দিয়ে, ঠেলে, কখনও-বা পা মাড়িয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। লোকটির প্রতিবাদে পচার উপদেশও শোনা যায়, ‘ভিড় বাসে একটু এরকম হবেই, বাসে ওঠেন কেন, ট্যাক্সি করে যেতে পারেন না?’ আর এই সুযোগে নান্টু স্যুটকেস নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ে। ভিড় বাস ও নান্টুর বরাতজোরে অন্য যাত্রীদেরও বিষয়টা নজর এড়িয়ে যায়। পচা আর নান্টুকে অনুসরণ করতে পারে না। সে সঙ্গে সঙ্গে বাস থেকে নামে না, কারণ তাতে তাদের যৌথ প্রয়াস বেআবরু হয়ে মাঠে মারা যেতে পারে।
জয়পুর না কোন শহরে পরপর অনেকগুলি বিস্ফোরণ হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা প্রচুর। পুলিশ জোর তল্লাশি চালিয়ে কিছু তাজা বোমা উদ্ধার করেছে। সেগুলি রাখা ছিল কোনওটা টিফিন ক্যারিয়ারে, কোনওটা আবার প্লাস্টিকের ব্যাগে। সেগুলিকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। সব ক’টা ফাটলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ত।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ-রাজ্যেও জোর সতর্কতা জারি হয়েছে। টিভি, রেডিওতে খবরে বলা হচ্ছে যে কোথাও সন্দেহজনক কোনও ব্যাগ, বাক্স বা টিফিন ক্যারিয়ার পড়ে থাকলে জনগণ যেন তাতে হাত না দেয়। সঙ্গে সঙ্গে যেন পুলিশে খবর দেওয়া হয়। লালবাজারে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
নান্টু স্যুটকেসটা নিয়ে বেশ উৎফুল্ল মনে হেঁটে যাচ্ছিল। বেশ কিছুদিন ধরে তার মার্কেট ডাউন। এ-লাইনেও এখন মন্দার হাওয়া লেগেছে। গত পরশু একটা মানিব্যাগ সরিয়ে মোটে তেতাল্লিশ টাকা আর কিছু ভিজিটিং কার্ড জুটেছে। ক্রেডিট কার্ড ডেবিট কার্ডের কল্যাণে লোকে কি পকেটে নগদ টাকা রাখাই ছেড়ে দিল? সে ভাবল স্যুটকেসটা নিশ্চয়ই হতাশ করবে না। এখন একটা ফাঁকা নির্জন জায়গা খুঁজে বের করতে হবে, সেখানে বসে বাক্সটায় কী আছে সে দেখবে।
কিছুটা হাঁটার পরেই নান্টু বাঁদিকে একটা পার্ক দেখতে পেল। দুপুর বেলা, তাই পার্কে লোকজন থাকার কথা নয়, নেই-ও। নান্টু গ্রিলের গেট খুলে পার্কে ঢুকে পড়ে।
আশা জাগানো বন্ধ স্যুটকেস খোলা অবস্থায় নান্টুকে হতাশ করল। টাকাপয়সা, সোনাদানা কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে কীসব যন্ত্রাংশ আর একটা বহু পুরনো রেডিও যা কিলো দরেও কেউ নেবে বলে মনে হল না। নান্টু রেডিওটা বাজানোর চেষ্টা করে। ব্যাটারি ভরাই ছিল। কিন্তু কোনও আওয়াজ হল না। নান্টু দু-চার বার চাপড় মারল। তাতে বুকে সর্দি বসা রোগীর মতো ঘর্ঘর আওয়াজ তুলে একদম চুপ মেরে গেল। নান্টু তন্নতন্ন করে খুঁজেও বাজারে বিক্রি করতে পারে এমন মূল্যবান সামগ্রী পেল না।
অগত্যা স্যুটকেসটা বন্ধ করে পার্ক থেকে বেরিয়ে সে আবার হাঁটতে শুরু করে। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। পচার সঙ্গে দেখা হলে ভাল হত। দেখানো যেত যে তাদের হাতসাফাই নিষ্ফলা। পচার সঙ্গে এখন যোগাযোগ বিছিন্ন। সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরলে আবার দেখা হবে। কাজে বেরোলে তারা কেউ মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখে না। মোবাইল সঙ্গে থাকলে বিপদ বাড়তে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর স্যুটকেসটাকে নান্টুর একটা উটকো ঝামেলা বলে মনে হল। এটাকে কোথাও রেখে সে নির্ভার মুক্ত হতে চাইল।
স্যুটকেসটাকে নামিয়ে রাখার একটা জুতসই নিরিবিলি জায়গা খুঁজতে সে বড় রাস্তা ছেড়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। প্রায় দশ ফুটের চওড়া গলি। লোকজনের দেখাসাক্ষাৎ নেই বললেই চলে। স্যুটকেসটা নামিয়ে রাখতে গিয়েই সে খেয়াল করে পানের দোকানের লোকটা তাকেই নজর করছে।
৩
সেদিন বোম ডিফিউসাল স্কোয়াডের লোকজন দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যায় সূর্য মার্কেট কমপ্লেক্সে। তাদের মধ্যে একজনের আবার মহাকাশচারীদের মতো পোশাক। তিনিই এগিয়ে গিয়ে সম্ভাব্য স্যুটকেস-বোমা পরীক্ষা করে জানান যে ভয়ের কিছু নেই, এটা নিরীহ স্যুটকেসই, বোমা নয়।
খবর যায় লালবাজারে। স্যুটকেসে কোনও বোম নেই। আছে রেডিও টিভি সারানোর যন্ত্রাংশ আর একটা পুরোনো রেডিও। ম্যারাথন জেরার শেষে নান্টুর কথার সত্যতা ধরা পড়ে। সে অপরাধী বটে, তবে জঙ্গি নয়। ছিঁচকে চোর বা পকেটমার। কোনও রেডিও-টিভি সারানোর মেকানিকের সে হাতসাফাই করেছে। আর এরই ফলে তার দুর্ভোগ, হেনস্থায় পুলিশের বড়কর্তাও দুঃখিত। বেচারা নান্টুর স্যুটকেসে তো কিছু মূল্যবান সামগ্রী মিললই না, উল্টে জঙ্গি সন্দেহে প্রাণ যাওয়ার জোগাড়।
স্যুটকেসের মধ্যে থেকে মেকানিকের নাম, ফোন নম্বর লেখা একটা কার্ডও বের হয়, ফলে যার জিনিস তাঁকে ফেরত দিতেও আর বাধা রইল না।
পুলিশের বড় কর্তাকে নান্টু কোনওদিন ভুলতে পারবে না। পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে নান্টুর হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো, কর্মসংস্থান হিসাবে পকেটমারি কিন্তু ভাল জিনিস নয়। যা দিনকাল পড়েছে, পাবলিক তো রাঘববোয়ালদের টিঁকি ছুঁতে পারে না, কিন্তু তোমার মতো চুনোপুঁটিকে একবার ধরতে পারলে হাসপাতাল বা হাজত হয়েও পৌঁছনোর সুযোগ দেবে না, মেরে সোজা উপরে পাঠাবে।’