আজব জগৎ

অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়

মোবাইলে মেসেজটা পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। আরে, সেই যে সাত আট মাস আগে একটা সিরিয়ালের চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে এটা তারই উত্তর। ‘জলদি যোগাযোগ করুন— অমিত রায়’। ব্যাপারটা একটু ভাবলাম,আমার এক বন্ধু দিলীপ থ্রু-টা দিয়েছিল। ও আমাদের ক্লাবের নাট্যদলের মেম্বার, বেশ চৌখস ছেলে। সে বলেছিল, ‘তুই তো ভালো ডায়ালগ লিখিস আমাদের নাটকে, যা তো একদিন অমিত দার সঙ্গে দেখা কর। বড় চ্যানেলের পরিচালক উনি,চান্স লেগে যেতে পারে।’ দিলীপ অ্যাড্রেস ফোন নম্বর সব দিয়ে দিয়েছিল। তারপর একদিন ফোনে কন্টাক্ট করে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিলাম, সংলাপ লেখারও পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তারপর সব চুপচাপ, এতদিন পরে সাড়া। মেসেজ পেয়েই গুপিদার কথা মনে পড়ল, বিকেলে যাব তাঁর কাছে।

এখানে বলে নিই, আমি আমাদের পাড়ার ক্লাবের নাট্য দলের সদস্য, নাটকে সংলাপ লিখি। গুপিদা আমাদের নাট্য সংস্থার পরিচালক ও সর্বেসর্বা। পুরো নাম গোপীনাথ বর্মন। খর্বকায়, পক্ককেশ সুরসিক মানুষ। ষাটোর্ধ্ব গুপিদার মুখে হাসি সর্বদা লেগেই আছে। বছরে দুটো নাটক আমরা নামাই, সুনামও মেলে। আমি বাংলায় এম এ পাশ করে এখনও চাকরি পাইনি। কয়েকটা টিউশন ও নাটক করেই আমার দিন কাটে। একটু লেখালিখির বাতিক আছে।


সন্ধেবেলায় গেলুম তাঁর বাসায়। লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে খাটে বসে গুপিদা টিভি দেখছিলেন। আমাকে দেখে টিভি বন্ধ করে সোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘আরে সুবীর,এসো এসো অনেকদিন পর, তারপর বলো আছো কেমন? কোথাও তোমার লেখা বেরল নাকি?’

আমি খাটের কিনারায় বসে গুপিদাকে আমার ওই নতুন কাজ টিভি সিরিয়ালে সংলাপ লেখার ব্যাপারটা তাঁকে খুলে বললাম। উনি সব শুনে বললেন, ‘বাঃ, এ তো দারুণ সুখবর। ওরা ভালো পয়সা দেয়। তুমি তো লেখ ভালো তাই ওরা ডেকেছে। ভেরি গুড নিউজ। তা ভায়া, তুমি কি ও কাজ করতে পারবে? কারণ আমার নিজের অভিজ্ঞতা কিন্তু ভাল নয়।’
আমি শুধোলাম, ‘কেন,আপনি কখনও এ কাজ করেছেন নাকি?’

‘করিনি আবার। বছর চারেক আগেই ও অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে, তখন তোমার সঙ্গে আমার আলাপই হয়নি। এক বিচিত্র জগৎ ওটা। মাস ছয়েকের বেশি টিকতে পারিনি। যাই হোক, আমি তোমাকে ডিসহারটেনড করছি না। কাজে লেগে পড়ো। সুবীর,তুমি বাংলা সিরিয়াল দেখ কি?’ আমি বললাম ‘না, বিশেষ দেখি না।’ উনি বললেন, ‘আগে ওগুলো খুঁটিয়ে দ্যাখো, তাহলেই বুঝতে পারবে ওর খামতিগুলো। পারবে, থাকতে থাকতে সব বুঝতে পারবে। উইস ইউ গুড লাক।’
চা এল, চা খেলাম। উনি এরপর ডিবে খুলে একটা পান মুখে দিয়ে বললেন, ‘আমি পান করি না, পান খাই। যাই হোক, দিন সাতেক পর তোমার অভিজ্ঞতাটা একটু জানিয়ে যেও।’
আমি মনে একটা খটকা নিয়ে উঠে পড়লাম।
পরের দিন এগারোটা নাগাদ চ্যানেল অফিসে গিয়ে

মি. অমিত রায়ের সঙ্গে দেখা করতে উনি বললেন, ‘সরি ভাই, চালু সিরিয়ালটা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। সামনের মাসে আমাদের নতুন সিরিয়াল লঞ্চ হচ্ছে, ওতে আপনিই স্ক্রিপ্ট লিখবেন। আপনার ডায়ালগ লেখা তো সে সময় দেখেছি, ভালই লেখেন আপনি। একটা কথা বলি, আমাদের পেমেন্ট কিন্তু মান্থলি নয়, ডে বেসিস। আপনি একটু তিন নম্বর রুমে প্রতিমাদির সঙ্গে দেখা করে নিন। উনি আমাদের স্টোরি রাইটার, উনি আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। তারপর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট রনির সঙ্গেও দেখা করে যাবেন, ও আপনাকে কিছু কথা বলবে।’ অমিত রায় মধ্যচল্লিশ ফর্সা দীর্ঘকায় সুপুরুষ চেহারা, গালে হালকা দাড়ি।

পর পর ছ-ফুট বাই ছ-ফুটের পার্টিশন কামরা। তিন নম্বর রুমে বসে আছেন এক প্রৌঢ়া সুদর্শন ভদ্রমহিলা, কিছু একটা লিখছিলেন। আমি নমস্কার করে ঢুকতে উনি স্মিতহাস্যে বললেন, ‘সুবীরবাবু তো, বসুন। আপনার ডায়ালগ রাইটিং আমি দেখেছি, খুব ভাল লেখেন আপনি। তবে নাটকের ডায়লগ আর সিরিয়ালের ডায়লগে কিছু তফাৎ আছে, এখানে ডায়ালগ হবে চোখা চোখা। দর্শকেরা যাতে টিভি স্ক্রিন থেকে চোখ কান সরাতে না পারে। আমি স্টোরির এপিসোডগুলো লিখে ছেড়ে দেব, তাকে দারুণ সংলাপে জীবন্ত করে তোলার কাজ আপনার।’

একজন ছোকরা চা নিয়ে ঢুকল। লেখিকা বললেন, ‘নিন, চা খান। শুনুন, আমি একজন স্কুল শিক্ষিকা, রোজ এখানে আসি না, শনিবার ছাড়া। আপনাকেও রোজ আসতে হবে না। অমিতবাবুর কাছে হয়ত শুনেছেন সামনের মাসে আমাদের নতুন একটা সিরিয়াল লঞ্চ হচ্ছে, তারই প্রস্তুতি চলছে। নতুন স্টোরির সাতদিনের সাতটা এপিসোড আমি কাগজে লিখে খামে ভরে দিচ্ছি, আপনি সামনের শনিবার তার ডায়ালগ লিখে খামে ভরে আমাকে জমা দেবেন। আমি সেগুলো দেখে ফাইনালি পাঠিয়ে দেব। আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেমন ইংরিজি বাংলা হিন্দি মিশিয়ে কথা বলে সেরকমই সংলাপ লিখবেন কেমন, এই আমার কার্ডটা রাখুন, দরকার হলে ফোন করবেন।’ তিনি এক বান্ডিল খাম আমার হাতে দিলেন। আমি তাঁর খুপরি থেকে বেরিয়ে এলাম।

আট নম্বর খুপরিতে রনির দেখা পেলাম। আমারই বয়সী এক ছোকরা। লম্বা লম্বা চুল, এক কানে দুল, বামহাতে বিস্তর ট্যাটু। কম্পিউটারে খুটখাট করছিল। আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল, ‘এসো বস, সুবীর তো? একটু আগে অমিতদা ফোন করেছিল। আমাদের চ্যানেলে ওয়েলকাম। নিশ্চয় প্রতিমাদি তোমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। তুমি হচ্ছ ডায়ালগ রাইটার, তোমার খুব ইম্পর্ট্যান্ট রোল সিরিয়ালে। একেবারে সিরিয়ালের মেরুদণ্ড বলা যায়। ডায়লগ যদি ঝুলে যায় পুরো স্কিমটাই ঝুলে যাবে। তাই খুব অ্যালার্ট থাকতে হয়। প্রতিটা এপিসোড নয়, প্রতিটা দৃশ্যেই চাই সাসপেন্স, দারুণ দারুণ ডায়ালগ। আমাদের চ্যানেলের বিরাট নাম তুমি জানো, নতুন সিরিয়াল যেটা আসছে তার অ্যাড সামনের সপ্তাহে শুরু হবে। মাল্টিস্টারার সিরিয়াল। তারই প্রস্তুতি চলছে, সবাই খুব ব্যস্ত। আমার এই কার্ডটা রাখো দরকার হলে কল কোরো।’ ওর মোবাইলটা বেজে উঠল। রনি ‘আসছি’ বলে উঠে দাঁড়াল। ‘অমিতদা ডাকছে, পরে আবার কথা হবে’ বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল।

বাড়ি ফিরে সন্ধেবেলায় ওই প্রতিমাদির দেওয়া খামগুলো পড়ে দেখলাম এক উচ্চবিত্ত পরিবারের অন্দরমহলের গল্প। ছ-টা নারী আর দুটো পুরুষ চরিত্র। কেমন যেন অস্পষ্ট। এই তো শুরু, পরে বিস্তার হবে।

ভেবেচিন্তে তিনদিনে সংলাপগুলো লেখা শেষ করলাম। শনিবার গিয়ে প্রতিমাদিকে দিয়ে এলাম। উনি আমার সামনেই লেখাগুলো একে একে খুলে পড়লেন, তারপর বললেন, ‘এক্সেলেন্ট, দারুণ হয়েছে। তোমাকে দিয়ে হবে। তবে আর একটু ফেনিয়ে ফেনিয়ে লিখতে হবে। এই নাও পরের সাত দিনের এপিসোড। তোমাকে ‘তুমি’ বলছি বলে কিছু মনে করছ না তো? বয়সে তুমি অনেক ছোট। শোন, সিরিয়ালটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘পাপের প্রাসাদ’, অমিতবাবুই দিয়েছেন। কেমন? ভাল হয়নি? সামনের সোমবার শুটিং শুরু হবে। কাউকে বলো না, এই গল্পটা যে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা লেখিকা হয়ে আমি নিজেই জানি না, টিভি সিরিয়ালে এরকম হয়।’

প্রতিমাদি আমার লেখার প্রশংসা করায় মনে বেশ জোর পেলাম। রনির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, ও সিটে নেই। ফিরে আসছি, ও দূর থেকে হাঁক দিল ‘বস দাড়াও’। ও সামনে এসে বলল, ‘মেইন রোল কাস্টিং কমপ্লিট, সেটও তৈরি হচ্ছে। পরে একদিন শুটিং দেখতে এসো বস, তোমার লিখতে সুবিধা হবে। এখানে আউটডোর শুটিং খুব কম, ইনডোরই বেশি। তাছাড়া ক্লোজ শটই বেশি করতে হয়। তাই ডায়ালগের সঙ্গে এক্সপ্রেশন খুব জরুরি। এসো একদিন, আমাদের মেগা মেকাপ রুমটাও ঘুরিয়ে দেখাবো। আসি বস।’ রনি চলে গেল।

পুরোদমে কাজ করতে লাগলাম। বেকার মানুষ কাজ পেয়ে ভালই লাগছিল। অবশেষে টিভিতে আমার সিরিয়াল শুরু হলো। বাড়ির সবাই অবাক হয়ে দেখছিল, আমিও। আমার নামও দেখালো প্রথমে। তারপর আর কারো অবশ্য নাম দেখাত না। দিন যায়, টাকা ভালই আসছে। একদিন কাজ করতে করতে রাত দশটার সময় প্রতিমাদির ফোন পেলাম— ‘শোনো,ওই শর্মিলা নামের চরিত্রটাকে ছেঁটে ফেলতে হবে।’
‘কেন, ওতো খলনায়িকার একটা বড় চরিত্র।’
‘আরে ও কাজ ছেড়ে দিচ্ছে, ফ্লিমে চান্স পেয়েছে। অ্যাক্সিডেন্ট জাতীয় কিছু একটা বুঝিয়ে ওকে ভ্যানিশ করে দাও। সিরিয়ালে এসব চলে।’

আমার একটু খারাপই লাগল, ওর মুখে গরম গরম ডায়ালগ দিতে পারতাম। কী আর করা যাবে, তাই করতে হল। একদিন গুপিদার কাছে যেতে হবে, অনেকদিন ব্যস্ত থাকায় যাওয়া হয়নি। তাঁর বাসায় যেতেই উনি বললেন, ‘এসো, এসো বৎস। তা কাজ কেমন চলছে বলো?’
—‘ভালই, তবে—’
—‘তবে কি? তোমার লেখা সংলাপগুলো ঠিকঠাক থাকছে তো নাকি পাল্টে দিচ্ছে? শোনো সুবীর, ও এক আজব জায়গা। গল্পের গরু ওখানে মহাশূন্যে উঠে যায়। সব সিরিয়ালেই দেখবে এক মসলা। বিয়ে বিয়ে আর বিয়ে, একেক জনের দুটো তিনটে করে বিয়ে। বড় বড় মালা, দামি বেনারসি, টোপর সব সময় রেডি রাখতে হয়। সব কিছু ওখানে চড়া। চড়া মেকাপ, চড়া আলো, চড়া সংলাপ। মেয়েদেরই ওখানে দাপট বেশি, মহিলামহল বলতে পারো। সব সিরিয়ালে দেখবে পটভূমিটা এক। একান্নবর্তী ধনী পরিবার, তা নাহলে কূটকচালিটা জমবে না যে। কী সব হাস্যকর উদ্ভট ঘটনা, একজনকে টাইট দিতে অন্যজন তার রান্নায় লুকিয়ে গাদাখানেক নুন দিয়ে দিচ্ছে, কিংবা আছাড় খাওয়াতে পথে ফেলে রাখছে ‌তেলজল। এসব সহ্য হয়?’

—‘কিন্তু এইসবই তো বাংলার মেয়েরা গোগ্রাসে গিলছে দাদা’ আমি বললাম।
—‘কেন গিলবে না, ঘরে বসে টক ঝাল মিষ্টির এমন মশলাদার ঘন্ট বিনামূল্যে কেউ ছাড়ে? মানুষের রুচিটাই তো বদলে দিয়েছে এই বাংলা সিরিয়ালগুলো। ওগুলোর এ টু জেড চক্রান্তে ভরা, খুন ঘটাতেই হবে। ডাক্তারও খুনি, যা এথিক্স-বিরুদ্ধ। একটা ভাল উপন্যাস নিয়ে সিরিয়াল করো, চলবে না।’ চা এলো। চা খেতে খেতে আমি বললাম, ‘আর কী কী ঘটে ওই চ্যানেল গুলোয়?’

চা শেষ করে পান মুখে দিয়ে গুপিদা বললেন, ‘ও, ওসব শুনতে চাও? অভিনয় করতে করতে কারো মাঝ পথে সটকে যাওয়া, টিআরপি পড়ে যাওয়া, দুই অভিনেত্রীর মধ্যে কে বেশি ফুটেজ পাচ্ছে তাই নিয়ে মন কষাকষি, গাঁজাখুরি গল্পের মাথা মুন্ডু না থাকা, দোলের সময় দোল, পূজোয় পূজো, রথের সময় রথ অকারণেই ঢুকিয়ে দেওয়া কত আর বলব। তোমার কোনো স্বাধীনতা নেই, এসব মানিয়ে যদি চলতে পারো বিন্দাস থাকবে, না হলে নয়। ওখানে কে যে কখন ইনসুইং গুগলি মারছে বোঝা মুশকিল ভায়া।’

সেদিন রাত বারোটা নাগাদ সংলাপ লেখার কাজ করছি হঠাৎ অচেনা নাম্বারে ফোন এলো, ‘সুনন্দা বলছি, এইমাত্র শুটিং থেকে ফিরলাম, তুমি ভাই আমার ডায়ালগগুলো এমন গুডি-গুডি টাইপ লিখছো যাতে আমার ক্যারিয়ারটা চোট খাচ্ছে। ওসব ডায়লগ চলবে না,পাল্টাও। রাখছি।’ ঝড়ের মতো বলে গেলেন কথাগুলো। আমি তো হতবাক, উনি এমন কথা বললেন কেন? আমার ফোন নম্বরই বা কোথায় পেলেন? পরদিন প্রতিমাদিদিকে ব্যাপারটা বললাম ফোনে। উনি জানালেন, ওসব পাত্তা না দিতে। এসব নাকি এ জগতের অঙ্গ।

পুজো আসছে। কাজের চাপ বাড়ছে, লম্বা এপিসোড হচ্ছে। এক শনিবার প্রতিমাদি বললেন, ‘শোনো, পুজোয় আমি দিন পনেরো থাকবো না। দেরাদুন যাচ্ছি বেড়াতে। তোমাকে আমি দিন কুড়ির স্টোরি রাইট আপ দিয়ে যাচ্ছি, পুজোর ব্যাপারটা মিলিয়ে ডায়ালগগুলো লিখে ফেলো। কিছু দরকার হলে ফোন কোরো। অমিতবাবুকে সব বলা আছে।’

তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে রনির ঘরে ঢুকলাম। ও কম্পিউটারে কাজ করছিল, আমাকে দেখেই বললো, ‘বস, তুমি একেবারে ফাটিয়ে দিচ্ছ। সুনন্দা বলছিল তুমি নাকি ওর ক্যারিয়ার ড্যামেজ করে দিচ্ছ। ও খুব হিংসুটে মেয়ে,ওর কথায় কান দিও না। অমিতদা তোমার ওপর খুব খুশি।’ কেমন যেন বেসুরো লাগল কথাটা। কী জানি কোথায় কে কী কলকাঠি নাড়ছে। বেশ ক’মাস হয়ে গেলো সিরিয়ালটা চলছে। এখন লক্ষ্য করছি, আমার লেখা ডায়লগগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে! সন্দেহ হওয়ায় গুপিদাকে ফোন করলাম। উনি বললেন, ‘শোনো, ওখানে ওরকমই হয়, দিনকে দিন গপ্পো পয়দা হয়। ওই দিগগজ অ্যাসিস্ট্যান্টগুলোই তা বানিয়ে দেয়। এর পিছনেও কলকাঠি থাকে, এসব আমার জানা আছে। চিন্তা কোরো না ভায়া, যে গানের যে বাজনা, লেগে থাকো।’

প্রতিমাদি চলে গেছেন পুজোর দুদিন আগে। আমার পুজো নেই, কাজের চাপ। এক-একদিন লম্বা মেগা সিরিয়াল হচ্ছে, তার জোগান দিতে হচ্ছে। বিজয়ার পরদিন হঠাৎ অমিতবাবুর ফোন এলো। ব্যাপার কী! উনি তো আমাকে কখনও ফোন করেন না। ফোনে উনি বললেন, ‘কালকে আসুন, জরুরি দরকার।’ পরদিন গেলাম তাঁর অফিসে। ঘরে উনি ছাড়া আরও একজন টাকমাথা বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন, বোধহয় প্রযোজক। অমিতবাবু বললেন, ‘বসুন, প্রতিমাদিকে তো ফোনে পাচ্ছিই না। কোন দেরাদুনে গিয়ে বসে আছেন, নট রিচেবেল। শুনুন, এই সিরিয়ালটা আমরা দশ দিনের মধ্যে শেষ করে দিতে চাই। আপনিই স্টোরিটাকে ছোট করে দিন, দিন পাঁচকের মধ্যে। আপনি একটু রনির সঙ্গে কথা বলে যান।’
ওই টাকমাথা ভদ্রলোক বললেন, ‘স্টোরিটা বাজারে চলছে না। টিআরপি বহুত লো।’

আমি অমিতবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা রনির ঘরে ঢুকলাম। ও কম্পিউটারে কী যেন দেখছিল, আমাকে দেখে সোৎসাহে বলল, ‘এসো বস, অমিতদার কাছে সব শুনেছ তো। এই সিরিয়ালটা গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে, বাজারে তেমন খাচ্ছে না, ব্যাড লাক। মাঝে মাঝে এমন হয়।’

আমি বললাম, ‘তার জন্যে আমার কোনও খামতি আছে কি?’
—‘নো নো নট অ্যাট অল। এই ফেলিওর আমাদের সবার ফেলিওর। সাকসেস হলেও সবার সাকসেস। এই নীতি নিয়েই আমাদের চ্যানেল চলে। বস,তুমি একটু ক্যাশ অফিসে গিয়ে প্রভাতবাবুর সঙ্গে দেখা করো। তোমার পেমেন্টটা রেডি আছে।’

আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই বাজল ওর মোবাইল। ‘যাচ্ছি’ বলে রনি তড়াক করে উঠে দাঁড়াল— ‘অমিতদা ডাকছে।’ বলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রনি।
আমি ক্যাশ অফিসের শেষ কাজ মিটিয়ে রাস্তায় নামলাম। এবার কোথায় যাব? বাড়ি না গুপিদার কাছে?