কল্যাণ সেনগুপ্ত
তাকে হঠাৎই দেখা গেল ঘুষখোর পুলিশটার সামনে। শুনশান রাস্তায় মধ্যরাতে এসে সটান দাঁড়িয়েছিল, গোবেচারার মত ছোটখাটো। চুলগুলো সামনের দিকে পাটপাট করে আঁচড়ানো। নিষ্পাপ মুখ। চোখ দুটোতে কৈশোর লেগে আছে। বয়স সতেরো-আঠেরো। ফতুয়া আর ধুতি পরা। লরি থামিয়ে পয়সা নিচ্ছিল যখন, সে নাকি বোকার মতন সামনে এসে পড়ে। কোথা থেকে এল কেউ জানে না। মরা মাছের মতন হিমশীতল ঠাণ্ডা দৃষ্টি গা শিরশির করে উঠেছিল পুলিশটার। যেন ভিতরটাও দেখতে পাচ্ছে। পুলিশটা ওকে সরিয়ে দিতে গিয়ে অবাক হল। মাত্র সতেরো-আঠেরো বছর বয়সী ছেলের কী প্রচন্ড গায়ের জোর। সে নড়ছে না, নড়ানো যাচ্ছে না। যে ঘুষ দিচ্ছে সেও হতবাক। এই নির্জনে শুভকাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলাই ভালো। রাস্তায় ছেলেটা পুলিশের হাতটা অক্লেশে নীচে নামিয়ে দিল। দুই আঙুল তুলে মানা করলে। তারপরেও পুলিশটা যখন বিরক্ত হয়ে হাত তুললে টাকার জন্যে তখন সে নিজের হাত তুলে কব্জিতে মৃদু চাপ দিল। নিমেষে ভোজবাজির মত আঃ! আঃ! আর্তনাদ করে কাতরাতে কাতরাতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল সেই ঘুষখোর। অসহ্য যন্ত্রণায় পুলিশ রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। লরিওয়ালা হতভম্ব। ভয় পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে লরি চালিয়ে বেরিয়ে যায়। নির্জন রাস্তায় পুলিশটা যন্ত্রণায় ধুলোয় গড়াগড়ি খেতেই থাকে। মধ্যরাতের শূন্য রাস্তায় পড়ে থাকে পুলিশ আর তার পদধ্বনি ধ্বনিত হতে থাকে মাটিতে, বাতাসে।
সে আবার এসেছিল যখন দুটি পাড়ার ছেলে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রমথবাবুর দরজায়, ওঁকে উঠিয়ে দেবার জন্যে।
এই কাকডাকা ভোরে কোথা থেকে এল কেউ জানে না। হঠাৎই উদয় হল। বাড়ি আর ওদের মাঝে এসে দাঁড়ালে। নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওদের দিকে।
ওদের একজন মুখ বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্য নিয়ে বললে, ‘কে তুই? সরে দাঁড়া’।
সে অবিচল। শুধু চেয়ে রইল, নড়লে না। ঠাণ্ডা গলায় বললে, ‘কি চাও?’
এসব শুভ কাজে কাজে বাধা পড়লে মেজাজ তো হারাবেই। ‘এই সরে যা’ বলে একজন বুকে হাত দিয়ে ছেলেটিকে সরাতে গেল।
দু-চোখ মুহূর্তে জ্বলে উঠল, ছেলেটি হিংস্র বাঘের মতন লাফিয়ে পড়লে দুজনের ওপর। এক-এক প্যাঁচে কলা গাছের মতন ফেলে ক্ষুধার্ত বাঘের মত হাঁটু মুড়ে গলা টিপে ধরলে দু-হাতে। নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার মত করে শেষ মুহূর্তে ছেড়ে দিলে। এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে, মাটিতে শুয়ে ওরা ভাবলে ব্যাপারটা কী হল? সে দাঁড়িয়ে রইল অবিচল। ছেলেদুটি উঠে বসে আগুন-চোখে পকেট থেকে পিস্তল বার করে তাক করলে। সে শুধু মৃদু হেসে বললে, ‘যা, চলে যা। গিয়ে বল দাদাদের, আমি মরিনি। আমি ফিরে এসেছি। বলে পিছন ফিরলে আর তোলাবাজ দুজন ফট, ফট, পিস্তলের গুলি ছুঁড়লে। তাদের বিস্মিত করে গুলি বেরিয়ে গেল ছেলেটির বুক চিরে। এক ফোঁটাও রক্ত ঝরল না। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসলে। সে হাসিতে বিদ্রুপ লুকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলে। চোখদুটো শিকারি হায়নার মত জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চিপে বললে, ‘গুলি কী করবে? ফাঁসিতে মৃত্যু হয়নি। আগুন আমায় জ্বালাতে পারেনি। জল আমায় ধুয়ে নিতে পারেনি। বাতাস পারেনি উড়িয়ে নিয়ে। মৃত্যুহীন আমি। ছেলেদুটির বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বললে, ‘ঠিক এইখানে আমার বাস। ফিরে এসেছি। শুধরে যা, ফিরে যা’।
গুলি যাকে ছেদ করতে পারে না। তার কি অপরিসীম শক্তি।
এবার ওদের বুক শুকিয়ে এল। গলা ধরে এল। সাতসকালে ভয়ে মুখ ঝুলে গেল। অজানা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘড়ঘড় শব্দ করে বললে, ‘তুই কে?’
চলে যেতে যেতে পিছন ঘুরলে। ফিরে এসে বললে, ‘অনেক রক্ত ঝরেছে, ভুলে গেলে হবে? তারপরে এই? আমি আসছি। সবখানেই আমি আসছি।’
এবার আর্তনাদের মতন শোনাল, ‘আপনার নাম?’
দৃপ্ত গলা বাতাসে ভেসে গেল বহুদূর ‘পঁচাত্তর বছরের শেষেও আমাকে চিনতে পারিসনি? আমি ক্ষুদিরাম।’
ছেলেদুটি চেনে না, ও নাম কখনও শোনেনি। পরস্পরের মুখে চেয়ে রইল। সকালে রোদ তার গায়ে পড়ে ঝলসে যাচ্ছে চারিদিক।
দাঁড়ালে না। সে দৃপ্ত পায়ে জ্বলন্ত গোলার মত হেঁটে মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে। তোলাবাজরা কোন দিকে পালাবে কিছুক্ষণ ভেবে বন্দুক গুটিয়ে, কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে উঠে যখন দেখল সে চলে গেছে, তখন প্রাণভয়ে দৌড় লাগালো।
ভোরের রাস্তায় গুলির শব্দ স্বাধীনতার প্রাক্কালে প্রভাতফেরীর ড্রামের শব্দে চাপা পড়ে গেল।
শহরে, গ্রামে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জটলা। মোড়ের সেলুনের পাগলা বুড়ো চিৎকার করে উঠলে, ‘সে আসছে। তাই তো! সে তো বলেছিল ফিরে আসবে। সেই নির্ভীক যুবক ফিরে আসছে। সেই তেজস্বী কঠিন ইস্পাত ফিরে আসছে। কোনো মাসীর কোল আলো করে সে আসছে? তার বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশ বাতাস গমগম করছে তার পদধ্বনিতে। আগুন, জল, মাটি, বাতাস ভেদ করে সে আসছে। বেড়া, পাঁচিল ভেঙে, পাহাড় সমুদ্র পেরিয়ে সে আসছে।