অমিত মুখোপাধ্যায়
সময় যে কেমন তা কে বলতে পারে! ভালো সময়, খুব খারাপ থেকে ওই চলে যাচ্ছে অবধি তার মাপকাঠি। ভাবুক লোকের অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ সময় বা সন্ধিকাল ইত্যাদি আছে। তার মানে, দেখা না গেলেও সময়ের চেহারা আছে। তা গোমড়া হয়ে থমকে থাকতে পারে, আবার কেপমারের মতো চোখের সামনে ভোল বদলে নিতে পারে!
এসব কথা কালু কিছুতে মানতে পারে না। তার কাছে সময় মানেই ধান্দার সময়। তা নিয়ে অত কথার কী আছে! কেউ বলতে পারবে, সময় মন্দ বলে কালুর মন্দা যাচ্ছে! চেলাদের সে বলে থাকে সুযোগ মতো কামাই করে যাও। নইলে মওকা তৈরি করে নাও! তার ভালোই জানা আছে যে এই সব সমাজ ফমাজ, সিস্টেম জমানা সময়ের সঙ্গে আরও খারাপ হয়েই চলবে। তাই তাদের আর চিন্তা কী, সময় অস্থির হলেই তা আদতে মস্তির!
বেড়াতে যাবার সময় ছাড়া সাথি আর মিলির সময় বড় একঘেয়ে। পুজোর দিনগুলো সব ভুলে তবু কাটিয়ে দেওয়া যায়। বাকি দিন মাসগুলো অখাদ্য রোদের গরমে, গাছহীন গুমোটে আর রেহাইছাড়া রান্নাঘরে কাটতে চায় না। টিভির ধারাবাহিকে মজা নেই, বেডরুমে বিশ্বাসঘাতকতা, রান্নাঘরে তরল গরল, ড্রয়িংরুমে আঁকা হয় ষড়যন্ত্র! কারো না কারো দুর্ঘটনা, অসুখে হাসপাতাল, নয়ত স্মৃতিহীনতা! অন্য ধারাবাহিকে গিয়েও লাভ নেই, সে সবই ফিরে আসে! সিনেমা যা দেখাবে, তা-ই দু’তিন দিন অন্তর রিভাইস করিয়ে মুখস্থ করাবেই! এমনকি রেডিওর প্রভাত-রবির গানে এখন হাতেগোনা শিল্পীর সে-ই নির্দিষ্ট তিনখানা গান শোনা ছাড়া উপায় নেই!
সাথি মিলিদের সময় তাই আটকে থাকে মুঠোর ছবিতে। নানা গ্রুপের কারবার, লাইভ কেরদানি, মিম, ভিডিও, রিল দেদার বৈচিত্র দেয়। দিশির সঙ্গে পাকিস্তানি ওয়েব সিরিজ ঢুকে পড়ে। কখনো সময় ভুলিয়ে দেয় ফেসবুক। ভুলিয়ে দেয় পাড়া বেড়ানো, আড্ডা, পরচর্চার সুখস্বাদ! এমনই গুণ সেই শালগ্রাম শিলারূপ যন্তরের, যে লোকের সময় নিয়ে সে দিব্যি ছিনিমিনি খেলে যায়!
পৃথার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া প্রায় শেষের মুখে। যাতায়াত সয়ে, পড়া সামলে, অসুস্থ মাকে সাহায্য করে, আড্ডা ম্যানেজ করে কেমন করে, বন্ধুরা ভেবে পায় না। এখানে ওখানে লেখালিখি করে। তার পরে একটা ছোটো ছবিও বানিয়ে ফেললো! কোথায় এত সময় পায়! চুরি করে? সঙ্গীরা তার রহস্য জানতে তৎপর হয়ে থাকে আজকাল। কারণ প্রশ্নে উত্তরের বদলে কেবল হাসি মেলে।
পৃথা নিজে পাগল হয়ে থাকে সময়ের দিকে তাকিয়ে। কিছু না কিছু সে করছে বটে, কিন্তু কোনও কাজ মনোমত হচ্ছে না। লেখাগুলো সময়ের সেচ পায় নি, তাড়াহুড়োর অসুখে ভুগছে। পড়া সামলাতে গিয়ে চিত্রনাট্যে তেমন নজর দিতে পারে নি। কয়েকটা সূক্ষ্ম ছোঁয়া বাদ পড়ে গেছে। তার ওপর অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ায় পেশাদার ক্যামেরা নিতে পারেনি। সেলফোনেই কাজ সারতে হলো। ভাগ্যিস একটা সংস্থার কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছিল! আর বন্ধুদের অনেকে আলো শব্দ অভিনয় থেকে শুরু করে সম্পাদনায় সাহায্য করেছে, নইলে নামানো সম্ভবই হতো না!
পৃথার সমস্যা আরও বেড়ে গেছে ছবিটা একটা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাবার পরে। আসলে লকডাউনের ওপরে অনেকে কাজ করলেও, তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নজর কেড়ে থাকবে বিচারকদের। এখন নতুন সব প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। তারাই সব ব্যবস্থা করবে। হঠাৎ করে আর টাকার সমস্যা নেই, ক্যামেরা, সেট বা পেশাদার অভিনেতা সব মিলে যাবে। পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি করার শখ তার কত দিনের! অথচ মায়ের শরীরটা আরেকটু খারাপ হয়েছে। পরীক্ষাও ধেয়ে আসছে হুড়মুড় করে। তার কাছে সময় এখন দূরের ডাঙা, বন্যার জল পার হয়ে যার নাগাল কিছুতেই মিলছে না!
কালু কখনো ফালতু জিনিস নিয়ে আলোচনা করে না, অন্য কেউ তার সামনে বাড়তি কথা বলতে গেলে ধমক খায়। আয়ের ইঙ্গিত থাকলে তবেই সে শব্দ ব্যয় করে। কাছের সাকরেদরা জানে, ওস্তাদ চোখ নাড়ালেই যে যা বোঝার বুঝে যায়। সেই কালুর মুখ ক’দিন তো বন্ধই, চোখও বুঝি নড়তে চায় না!
ব্যাপারটা কী হলো তা গোড়ার দিকে আন্দাজ করতে পারেনি চেলারা। কিন্তু কিছু জিনিস থাকে যা নিজে থেকেই বোঝা যেতে থাকে। অনেক দিন ধরে কাজের বরাত যেমন জুটে যাচ্ছিল, তেমন সহজে করাও যাচ্ছিল সে সব। লোকে ভয়ের চোটে চুপ করে থাকত কিনা! বাড়তি মজাও নিত তাদের অনেকে। এখন কেমন ভাটার সময় চলে এসেছে। একটা এমন বড় ক্যাচাল হয়েছে, যে বড়রাই সালটে দিতে পারছে না! সবাই কেমন সমঝে চলছে! তাই কাজও কমে গেছে। কালু যেন কিছুটা দমে গেছে। দু’চার দিন কাজ না করলে তার অবশ্য কিছু যায় আসে না। অসুবিধে হবে ভোলা দিপু রতুদের, তাদের সময় হোঁচট খেতে থাকবে।
মাঝে কী একটা কাজ কালু অন্য ওস্তাদদের সঙ্গে করে এসেছে অন্য কোথায় গিয়ে। তারপর ক’দিন তার পাত্তাই পাওয়া যায়নি! কাল ঘরে ফিরেছে, কিন্তু সেই থেকে ফিউজ হয়ে আছে। কাউকে ডেকে কাজের কথা বলা তো দূর, দেখা করতেও চাইছে না! বেশির ভাগ সময়ে নাকি শুয়ে কাটাচ্ছে! তা শুনে রতু খুব চিন্তায় পড়েছে। ওস্তাদের সময় চিত হয়ে পড়লে, তাদের সময় যাবে কোথায়!
মিলি আর সাথি কেমন করে যেন জেগে উঠেছে। ঘন ঘন টিভির খবর দেখছে। রান্নাঘরে ফাঁকা পেলেও মুঠোফোন জ্বালছে। পাশের বাড়ি থেকে একে অপরকে ডেকে নিয়ে আলোচনা করছে। কখনো রাগ নয়ত হতাশা উগরে দিচ্ছে। তাতে থেমে থাকলেও চলত। কিন্তু তারা বেশ বুঝতে পারছে যে দিন দিন সময় নিজের চরিত্র নষ্ট করে ফেলছে। সময়ের মুখ, তার ভাবগতিক, চলন বলন একটা মোড়ে এসে যেন থমকে গেছে! সময় যেন আরও কিছু দাবি করছে!
শুরু হয়ে যায় লোকেদের মিলিতভাবে বাইরে বেরিয়ে পড়া। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসে পড়া বা নির্দিষ্ট সড়ক ধরে হাঁটা খবর হয় রোজ। তারপর মেয়েরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে পথে নেমে পড়ে। যে যেখানে খবর পায়, স্বেচ্ছায় চেনা সখি বান্ধবী নিয়ে পরিকল্পনামতো পথে মিছিল করে চলে। দিকে দিকে কেবল মেয়েদের মিছিল সাড়া ফেলে দিতে থাকে। যোগ দিতে বাকি নেই কোনো বয়সের, কোনো স্তরের মহিলার। সেই সব গণযাত্রা দিন বা রাত মানে না। বরং সব কাজ সেরে মায়েরা মেয়েরা নানা ধরনের বাতি জ্বেলে সাঁঝের আবছায়া দূরে ঠেলে দেয়।
সাথি আর মিলিদের মফস্বলি পাড়ায় সেই ঢেউ পৌঁছে যায়। সেখানেও মেয়েরা ছটফট করতে থাকে যোগ দেবার জন্য। অন্যায়ের প্রতিবাদে তারাও গলা তুলতে চায়। সমাজ-মাধ্যম তো আছেই, প্রতিদিনের যোগাযোগের সূত্র ধরেও চট করে নিজেদের মধ্যে খবর দেওয়া নেওয়া হয়ে যায়। স্থির হয় দিন ও সময়। কে কী নেবে, কোথায় গিয়ে থামবে, তা-ও ঠিক হয়। প্রথমে মিলি সাথি ও তাদের কাছের বন্ধুদের উৎসাহ বেশি ছিল। ছিল পৃথার মতো কমবয়সী পড়শিরাও। সবাই মিলে সব ঠিক করার পরে দেখা যায় অন্য মেয়েরা উত্তেজনার স্তরে পৌঁছে গেছে, ফেটে পড়বে, এমন অবস্থা!
আন্দাজের চেয়ে অনেক বেশি নারী এসে জড়ো হয়েছে। বিপুল সমাবেশ! যথেষ্ট চেষ্টা ও সময় খরচ করে তাদের সারি দিয়ে সাজাতে হলো। মিলি দেখলো একাংশ চায় সামনের দিকে থাকতে। পেছনে যেতে অনেকেই চায় না! মহা ঝামেলা! যুদ্ধের আগেই চাপা লড়াই সামলানো কী জিনিস তা আয়োজকরা ভালো করে টের পায়।
সন্ধে নেমে যাবার বেশ কিছু পরে মিছিল নড়ে ওঠে। পায়ের গতি বাড়ে, দাবির জোরও! খানিক পরে দিব্যি আলোছায়ার অবয়ব হুঙ্কার দিয়ে পথ করে নিতে থাকে। খবর দেওয়া হলেও সংবাদ-মাধ্যমের লোক আসেনি কেউ। মিলি বোঝে যে চারপাশে এত বেশি করে মিছিল হয়ে চলেছে, সব কভার করা শক্ত। হয়ত এই মফস্বলি জনপদের থেকে বেশি জরুরি জায়গায় তাদের পাঠানো হয়েছে!
মেয়েদের পদযাত্রা জনপদের প্রান্তিক এলাকার দিকে এগোতে থাকে। দু’পাশের দর্শক কমে যায়। পথের আলোও সেদিকে তেমন নেই। আর একটু এগিয়েই বাঁক নিয়ে মূল চকে ফেরার রাস্তা ধরার কথা। কিন্তু রাস্তার অবস্থা দেখে মিলির মনে হয় আরও আগেই ফিরে গেলে ভালো হতো। তারা তো আর রাতে এসব জায়গার চেহারা দেখেনি! উচিত ছিল রাতে এসে দেখা! তার বন্ধুরা আর পৃথা রয়েছে মিছিলের মাঝে। আর সাথি সে-ই পেছনে। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে!
পেছনে থাকা মেয়েদের সংগঠকরা সাথির সঙ্গে একই সময়ে খেয়াল করে দু’দিক থেকে কিছু ছেলে বড় বেশি কাছে এসে গেছে! দূর থেকে আরেকজন ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন ঘিরে আসে! একজন মেয়েদের চুল ধরে টান দেয়। অন্যরা ধাক্কা দিতে থাকে। প্রতিবাদ হতেই গুন্ডারা অসভ্যতা শুরু করে দেয়। মেয়েরাও পাল্টা ধাক্কা দেয়! মারামারি বেধে যায়। মশাল মোমবাতি ইত্যাদি গড়াগড়ি খায়। চিৎকার শুরু হতে মাঝের মিছিলের আওয়াজ থেমে যায়। তারা ঘুরে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। সামনের মেয়েরা তখনো স্লোগান দিয়ে চলেছে!
এদিকে বাধা পেয়ে মরিয়া গুণ্ডারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তবে তাদেরও হয়ত মাত্রা ছাড়াতে মানা করা আছে। নইলে এর মধ্যেই আরও অনেক কিছু হতে পারত! তবু মেয়েদের রুখে ওঠার ফলে কিছু অপ্রিয় ব্যাপার ঘটতেই থাকে। খেপে গিয়ে নির্দেশ ভুলে যায় হয়ত। বেগতিক দেখে সাথির মনে হয় বাড়ির লোকেদের কথা শুনে অন্তত কাছেপিঠে থাকতে দিলে ভালো হতো! এরা তো যা খুশি করে ফেলতে পারে! চেঁচিয়ে বা পাল্টা মেরে কিছুতে ঠেকানো যায় না!
এর মধ্যে সামনের মেয়েরাও বিপদ বুঝে ফেলে। সামনে থেকে এক দল সাহসী মুখ ফিরিয়ে আসতে থাকে। এদিকে পৃথাকে দেখে মাঝের মেয়েরাও যোগ দেয়। স্লোগান বন্ধ, আলো সব এলোমেলো, কেবল এক চাপা অচেনা শব্দ বাড়তে থাকে।
কালু অচেনা শব্দ শুনে ঘুরে তাকায়। এক দল মেয়ে জেদি পায়ে আসে! কালু তাদের অনেকের দিকে তাকিয়ে চমকে যায়। তাদের মুখ এত কঠিন রকম কোঁচকানো কেন! চোখের জল আলোছায়ার মাঝে ভয়ংকর দেখায়। চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে কালু বুঝে নেয় যে সাকরেদরা কেটে পড়তে শুরু করেছে! দেরি হয়ে গেল কি! আর ক’জন আছে তার সঙ্গে! কী জ্বালা, বেশ কয়েকটা মোবাইলে তার ছবি তুলে নেওয়া চলেছে!
কাঁদতে কাঁদতে মেয়েদের আসতে দেখে থেমে যায় কালু। এমন ভয়ংকর আগ্রাসী কান্না সে কখনো দেখেনি! সময়ের এক আজব গর্তে পড়ে গেছে সে!