• facebook
  • twitter
Saturday, 11 January, 2025

কেউটে সাপের বিষ

গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী ওকে নিয়ে যাওয়া হল গঙ্গার ধারে। আমি কাঁদতে কাঁদতে চললাম ওদের পিছু পিছু। কলা গাছের কাণ্ড দিয়ে ভেলা বাঁধা শুরু হল। কথিত আছে, কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিলেন রোগী প্রাণ ফিরে পায়।

অঙ্কিত চিত্র

কেয়া রায়

সাপ নিয়ে আলোচনা জমে উঠেছে সবুজ সঙ্ঘ ক্লাবে। নামে সবুজ সঙ্ঘ হলেও নতুন পুরোনোর সমাহারে সরগরম আজ সভা। যারা পুরোনো মেম্বার, বর্তমানে কিশোর; তারাও আসর আলো করে বসে আছে। একে রবিবারের সান্ধ্য আড্ডা, তায় আবার অঝোর বর্ষণ। কারেন্ট গেছে চলে। তাতে কুছ পরোয়া নেই। চার্জার লাইটের মৃদু আলোয় ডাক্তারি পড়ুয়া আকাশ শুরু করল, ‘প্রচুর সাপে কাটা পেশেন্ট আসছে আউটডোরে। বর্ষায় সাপের গর্তে জল ঢুকে যাচ্ছে। বেচারারা লোকালয়ে ঢুকে এসে মানুষকে কামড়াচ্ছে।’
স্বপ্নময় আগ্রহী গলায় বলল, ‘তোমরা‌ কী ট্রিটমেন্ট দিচ্ছ, আকাশদা? বাঁচাতে পারছ সাপে কাটা রোগীকে?’

তাচ্ছিল্য সহকারে আকাশ বলল, ‘আরে বেশির ভাগ সাপেরই তো বিষ নেই। জলঢোঁড়া সাপই বেশি। তবে বিষাক্ত সাপ কামড়ালে স্যালাইনের মধ্যে দিয়ে অ্যান্টি ভেনাম ইঞ্জেকশন দিই। কপাল ভালো থাকলে আর তাড়াতাড়ি আনতে পারলে রোগী বেঁচে যায়। সাপটা সনাক্ত করা জরুরী।’

‘আর বাঁধন? শক্ত করে কষে বাঁধলে শুনেছি সাপের বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে না। তাই না আকাশদা?’
‘একদম ঠিক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাঁধন দিলে বিষ ছড়ায় না। আর পেশেন্টকে জাগিয়ে রাখতে হবে। ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না।’
সবজান্তা ফটিকদা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। সব বিষয়ে ওর মতামত থাকে বলে ক্লাব থেকে ‘সবজান্তা’ উপাধি পেয়েছে। এইবার মাঠে নামল ফটিকদা। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘কোনো ইঞ্জেকশন, ওষুধ ছাড়া কালকেউটের কামড় খাওয়া রোগীকে আমি বেঁচে যেতে দেখেছি।’
সবাই নড়েচড়ে বসল। আকাশ বাঁকা হাসি হেসে বলল, ‘ফটিকদা এবারে নিশ্চয়ই বেহুলা লক্ষীন্দরের পৌরাণিক কাহিনীর রেফারেন্স দেবে। কারণ কালকেউটের কামড় থেকে বাঁচা অসম্ভব।’

ফটিকদা আকাশের‌ বাঁকা কথায় আমল না দিয়ে বলল, ‘কেন পৌরাণিক কাহিনীর উদাহরণ দেব? শুনলি না, বললাম আমি স্বচক্ষে দেখেছি। সর্প দংশনে মৃতপ্রায় রোগী এক ঘন্টার মধ্যে উঠে বসেছে। দুই ঘন্টার মধ্যে হেঁটে চলে বেড়িয়েছে। এটা গল্প নয়, সত্য ঘটনা।’
আকাশকে ছেড়ে সবাই ফটিকদাকে ঘিরে ধরল, ‘কী রকম, কী রকম? বল তো শুনি।’

ফটিকদা এবার খানিক সময় নিল। ক্লাবের ওপরে সিলিংয়ের কড়ি কাঠের দিকে ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে পাঁচ সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর শুরু করল, ‘আমার মামার বাড়ি হুগলি জেলার আদিসপ্তগ্রামে। এখন তো অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বিশ বছর আগে আদিসপ্তগ্রাম ছিল অজ পাড়া গাঁ, জলা জায়গা। নিচু জমি। সাপখোপের আড্ডা। প্রায়ই গ্রামের লোকজনকে সাপে কাটত। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব সাপ, বুঝলি। কেউটে, দাঁড়াশ, চন্দ্রবোড়া, গোখরো; এক-সে-বঢ়কর-এক বিষাক্ত সাপ সব। এক কামড়েই সারা শরীর নীলবর্ণ হয়ে, মুখে ফেনা উঠে রোগী শেষ। তো আমার বাল্য বন্ধু শিবুকে ভোররাতে সাপে কাটল। খবর পেয়ে আমিও ছুটে গেলাম। দেখি, শিবুকে উঠোনে শুইয়ে রেখেছে। ওর সারা শরীর কালো হয়ে গেছে বিষে। পায়ের গোড়ালিতে দংশন চিহ্ন। জ্ঞান নেই শিবুর। সাপের ন্যাজের দিকটা ও চেপে ধরেছিল, হাতের মুঠোয় ন্যাজটুকু রয়ে গেছে। ন্যাজটা দেখে গাঁয়ের মুরুব্বিরা মত দিলো, ‘কেউটে বিষ ঢেলেছে। বাঁচার আশা নাই। কলার ভেলায় ভাসায়ে দাও।’ বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। একটা জোয়ান ছেলে চলে গেল সাপের কামড়ে। যাই হোক, তখন শিবুর শ্বাস উঠেছে। হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে, অচেতন।

গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী ওকে নিয়ে যাওয়া হল গঙ্গার ধারে। আমি কাঁদতে কাঁদতে চললাম ওদের পিছু পিছু। কলা গাছের কাণ্ড দিয়ে ভেলা বাঁধা শুরু হল। কথিত আছে, কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিলেন রোগী প্রাণ ফিরে পায়। কলার ভেলা তৈরির কাজ প্রায় শেষ। এমন সময় একজন ওঝা গুনিন এগিয়ে এলেন। উনি গঙ্গার পাড়ে ধুনুচি জ্বালিয়ে তন্ত্র সাধনা‌ করছিলেন। বারো বছরের এক কিশোরের অচৈতন্য দেহ দেখে তাঁর করুণা হল। বললেন, ‘কী সাপ জানতে পারলে বিষ ঝেড়ে দেবার চেষ্টা করতে পারতাম।’ কেউ সঠিক জানে না কী সাপ। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে‌। আমার মাথায় বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো বুদ্ধি খেলে গেল। বললাম, ওই তো শিবুর হাতের মুঠোয় সাপটার লেজটুকু ধরা আছে।

ওঝা সাপের লেজটা ভালো করে দেখে বলল, ‘কালকেউটে। আসবে, ওকে আসতেই হবে।’ তারপর ঝোলা থেকে বীণ বের করে বাজাতে শুরু করল। ওহ, সে কী কলজে নিংড়ানো বীণের বাদ্যি! তোরা বললে বিশ্বাস করবি না, ঘন্টা খানেক বীণ বাজানোর পর জঙ্গল থেকে কালো কুচকুচে দীর্ঘ সরু একটা সাপ এঁকেবেঁকে এগিয়ে এল। শিবুর গোড়ালি থেকে শুষে নিল যত বিষ ঢেলে ছিল। বিষ শুষে নেবার পর যখন সাপটা আবার অরণ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, আমি খেয়াল করলাম সাপটার লেজটা কাটা। তারপর শিবুর চোখের পাতা নড়ল। সে চোখ খুলল। গরম দুধ পান করে উঠেও বসল। তোরা হয়তো বিশ্বাস করছিস না, তবে এই ঘটনা ছেলেবেলায় আমার চোখের সামনে‌ ঘটেছিল।’ সবাই বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকল। কেবল আকাশ বলল, ‘বৃষ্টিটা ধরেছে। বাড়ি যাই। তোরা আকাশকুসুম কল্পনা করতে থাক, ভাই।’