• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

শিবের গাজন

প্রদীপ মারিক: চৈত্রের শেষ বিকেলে চৌধুরীদের ভাঙাচোরা ফটকের ছায়া বড়পুকুরে পড়েছে৷ ঢাক-কাঁসরের শব্দে চড়কতলা গমগম করছে৷ একটা লিকপিকে ছেলেকে মোটা তিনটে লোহার বঁড়শি পিঠে আর দুই থাইয়ের মাঝে ফুটিয়ে দিয়ে মোটা দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ ফুটের বাঁশের এক মাথায়৷ বন বন করে তাকে ঘোরানো হচ্ছে৷ এটা যেন শিউরে ওঠা দৃশ্য৷ এইভাবে নিজেকে কষ্ট দিতে

প্রদীপ মারিক: চৈত্রের শেষ বিকেলে চৌধুরীদের ভাঙাচোরা ফটকের ছায়া বড়পুকুরে পড়েছে৷ ঢাক-কাঁসরের শব্দে চড়কতলা গমগম করছে৷ একটা লিকপিকে ছেলেকে মোটা তিনটে লোহার বঁড়শি পিঠে আর দুই থাইয়ের মাঝে ফুটিয়ে দিয়ে মোটা দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ ফুটের বাঁশের এক মাথায়৷ বন বন করে তাকে ঘোরানো হচ্ছে৷ এটা যেন শিউরে ওঠা দৃশ্য৷ এইভাবে নিজেকে কষ্ট দিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ওই লিকপিকে সন্ন্যাসী৷ এই আত্মপীড়নের মধ্যে দিয়েই দেবতার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করা হয়৷ এটা হিন্দু সভ্যতার লোকসংস্কৃতি৷

এই গাজন আসলে মহাদেবের পুজো৷ চৈত্রসংক্রান্তির শেষ তিনটে দিন পাঁজি মেনে পুজো করার এক আচার৷ এই গাজন পার্বনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ চড়ক পালা হয় শেষ দিনে৷ এক-একটা এলাকা জুড়ে এই পার্বনের এক এক নিয়ম৷ বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে এক নিয়ম আবার হুগলি, বিষ্ণুপুর বা উত্তরবঙ্গের গ্রামের এক নিয়ম৷ কোনও জায়গায় চলে জিভ ফোড়া, কোনও জায়গায় চলে বাণ ফোড়ার কাজ৷ যেসব সন্ন্যাসী বেশি বাণ শরীরে ফোটাতে পারে হিরো সে-ই হয়৷ বাংলার মঙ্গলকাব্যে গাজনের উপস্থিত লক্ষ্যণীয়৷ ধর্মমঙ্গল কাব্যে রানি রঞ্জাবতী ধর্মকে তুষ্ট করার জন্য গাজন করেন৷ ‘শিবের আজ বড় রঙ্গ, জটার মাঝে গঙ্গার তরঙ্গ’৷ শ্মশানচারী শিবকে নিয়ে সংসারী পার্বতীর দুঃখের অন্ত নেই৷ বাঙালিদের সঙ্গে এমনি ঘরোয়া সম্পর্কে জড়িয়ে আছে দেবাদিদেব মহাদেব৷ এই শিবই লোকসংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত৷ ষাঁড়ের পিঠে চড়া আত্মভোলা শিব৷ গাজনের মধ্যমণি তিনি৷ জাতপাত, সামাজিক কৌলিন্যের সব বেড়াজাল ভেঙে আবালবৃদ্ধবণিতারা শিব ভজনায় ব্যস্ত৷ তিনটি উৎসব একত্রে করে গাজন উৎসব হয়৷ একটা চড়ক, নীলের ব্রত আর ঘাট সন্ন্যাস৷ সন্ন্যাসীদের কৃচ্ছসাধন করতে হয়৷ ঘাট সন্ন্যাসীরা উত্তরীয় ধারণ করে এবং হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন৷ এই সন্ন্যাসীরা শিব ঠাকুরের মাথায় দল দিয়ে পালন করে নীলের ব্রত৷ এই নীলের ব্রতের পূর্বদিন থেকে শুরু হয় গাজন৷ নানাভাবে সঙ সেজে নেচে চলে সন্ন্যাসীরা৷ এখানে হর-গৌরী, নন্দী-ভৃঙ্গী, ভূত-পেত্নির মুখোশ পরে গাজন তলায় নৃত্য করে সন্ন্যাসীরা৷

এই মুখোশ পরে গাজন গানের কথা উল্লেখ আছে পতঞ্জলি মহাকাব্যে৷ মালদা জেলার বাশরা গ্রামে বাঁশুরানি চামুন্ডার কাহিনি সত্যিই চমকপ্রদ৷ শোনা যায়, চৈত্র মাসে পুকুরের জল কমে যায়৷ আর বাচ্চারা সেই পুকুরে দাপাদাপি করতে করতে দেখতে পায় একটা সাদা মতো কিছু ভেসে আসছে৷ কৌতূহলবশত সেটা মুখে নিয়ে নাচতে থাকে বাচ্চাটা৷ এরপর হয় অদ্ভূত ঘটনা৷ শত চেষ্টা করেও সেই মুখোশ আর খুলতে পারে না৷ এই সময় দৈববাণী হয়৷ ‘আমি বাঁশুরানি চামুন্ডা, আমি এই গ্রামের দেবী, আমাকে কেউ পুজো দাও না৷ আমার পুজোর প্রচলন করো তবেই মুখোশ খুলবে৷’ সেই থেকে বাঁশুরানি চামুন্ডার গাজন মেলায় মুখোশ নাচ হয়৷ গাজনের পরেই হয় নীল ষষ্ঠী৷ এই ব্রত সন্ন্যাসী থেকে গৃহী মহিলাদের কাছে পুণ্য ব্রত৷ সন্তানদের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত উদযাপন হয়৷ গাজনের শেষ দিন চড়ক৷
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের চৌধুরী বাড়ির পুকুরে চড়ক গাছ ঠিক গাজন মেলার আগে ভেসে ওঠে৷ চড়ক গাছটি তুলে এনে গাজনতলায় পুজো করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়৷ তার ওপরে সন্ন্যাসীরা বঁড়শি, লোহার কাঁটা শরীরে ফুটিয়ে দিয়ে নানান কেরামতি দেখায়৷ আঠারো শতকে ব্রিটিশ সরকার আইন করে পিঠবাণ চড়ক নিষিদ্ধ করে৷ কারণ অনেক সন্ন্যাসীর এই কেরামতি দেখাতে গিয়ে মৃতু্য হয়৷ চড়ক নিয়ে বিচিত্র ইতিহাস পাওয়া যায় বারুইপুর চৌধুরী বাড়িতে৷ চড়ক পুজোর পর পুকুরে চড়ক গাছটি ভাসিয়ে দিলেই আপনা থেকে ডুবে যায়, আবার চৈত্র মাসের শেষে সন্ন্যাসীরা হবিষ্যান্ন করে ঢোল কাঁসর বাজিয়ে পুকুরের ধারে চড়ক গাছটিকে আহ্বান করলে সংক্রান্তির দিনে পুকুরে ধারে চড়ক গাছটির উদয় হয়৷ গাজন মেলা, চড়ক এখনও তাই এই চৌধুরী মাঠে মহাধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয়৷ অনেকে ভাবেন সন্ন্যাসী হতে গেলে সারা জীবন কৃচ্ছসাধন করতে হয়৷ এই ক’দিনে কী হয়? কিন্ত্ত গাজনের সন্ন্যাসীরা সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধতায় থাকে৷ শিবগাজনের সন্ন্যাসী হতে গেলে কোনও জাতি-ধর্মের বাঁধন লাগে না৷ এই বর্ষশেষের গাজন গ্রাম, শহরতলি, শহরের মধ্যে সর্বজনীন লোকসংস্কৃতির বাতাবরণের মধ্যে দিয়েই সর্বধর্ম সমন্বয়ের লোকউৎসবে পরিণত হয়েছে৷