রাজেশ কুমার
আজ সকালে কোর্ট খুলেই ডিভোর্স হয়ে গেল দীপ্তরূপ আর বিদিশার। মর্নিং সেশন। কালো কোট পরে জজসাহেব সম্মতি দিলেন। বলা যায় ওদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করলেন। শুধু দীপ্তরূপ আর বিদিশাই নয়, বিদিশার বাবা মা-ও মনেপ্রাণে চাইছিল ওদের এই বিচ্ছেদ। মাস ছয়েকের সামান্য কিছু আইনি পদ্ধতি পার করে অবশেষে আলাদা হল তারা। কাগজপত্র হাতে পেতে অবশ্য আরও কিছুদিন লাগবে।
আমি অনিমেষ। দীপ্তরূপ মানে দীপের বন্ধু, কলেজবেলাকার। আর সেই সুবাদে বিদিশারও। ওদের এই আইনি লড়াই নিয়ে দীপের পরিবার উদাসীন। এমনকি তার আগে বিদিশার আলাদা থাকা নিয়েও। তারা কেউ কোর্টে আসেনি, নিদেনপক্ষে ফোনও করেনি একটা। বিদিশার বাড়ির লোকজন অবশ্য ছিল ওর সঙ্গে। দীপই বলেছিল আমায়, আজকের দিনটা আমার সঙ্গে থাকবি! ওর গলায় একাকিত্ব ভেসে উঠেছিল একটা কিম্বা লুকানো কোনও আর্তি। আমি না করতে পারিনি। যদিও পুরো বিষয়টাতেই অস্বস্তি রয়ে গেছে একটা। বিদিশার সঙ্গেও তো দেখা হবে। চোখাচুখি হলে কি বলব! নিজে থেকেই এগিয়ে যাব! সান্ত্বনা দেবো নাকি উপদেশ! বুঝে উঠতে পারছিলাম না ঠিক। সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ও ভাবছিলাম এড়িয়ে গেলেই তো হত। তাছাড়া ইনস্টিটিউটে ক্লাসও ছিল আজ দুপুরে। আমার প্রিয় পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির ওপর। আমি ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করি। ক্লাসটা মিস করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না আমার। তবুও কি জানি একটা বাধ্য বাধকতা কাজ করছিল আমার ভেতর। যেন বহুদিন আগেই ঠিক হয়েছিল ওদের এই বিচ্ছেদের, আজ এই চন্দননগর সাব ডিভিশনাল কোর্টে। সঙ্গে এই স্থান, কাল, মুহূর্তে আমার সাক্ষী থাকার কথা। কে যেন আগে থাকতেই স্ক্রিপ্ট করে রেখেছে পুরোটা।
আমার বাড়ি উত্তর কলকাতা। বনেদি পরিবার। পুরোনো পারিবারিক ব্যবসা। রোজগার পত্তরের চাপ নেই তেমন। সামান্য কয়েকটা টিউশন করি। এডিটিং শেখাই বাড়িতে বসেই। বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। সারাদিন সিনেমার মধ্যেই ডুবে থাকি। দেশ বিদেশের ছবি দেখি, গল্প বলার ধরণ লক্ষ্য করি। বিভিন্ন সাইটে ক্রিটিকদের আলোচনা পড়ি। পৃথিবী বিখ্যাত ডাইরেক্টরদের ইন্টারভিউ, সিনেমায় নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি। এই সংক্রান্ত বেশ কিছু সাইট সাবস্ক্রাইব করা আছে আমার। কোর্সটা শেষ হলে ডাইরেকশনে আসতে চাই। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন এর প্রতি অদ্ভুত এক প্যাশন রয়েছে আমার মধ্যে।
দীপের পৈতৃক ভিটে চন্দননগর। যদিও সেই কলেজ জীবন থেকেই কলকাতায় থাকে সে। ছাত্রাবস্থায় হোস্টেলে, তারপর এক কামরার ফ্ল্যাটে। ওই ফ্ল্যাটেই আমি প্রথম দেখেছিলাম বিদিশাকে, দীপের এক মারাত্মক অসুস্থতার দিনে। মনে হয়েছিল সে যেন হঠাৎ করে জেগে ওঠা এক নারী চরিত্র। বিছানায় শুয়ে দীপ তার ছেলেবেলার কথা বলছিল। তাদের চন্দননগরের ঘরবাড়ি, এক টিপিক্যাল ঘরানার মানুষজন, পুরোনো কিছু ধ্যান ধারণার বর্ণনা। দীপের কন্ঠস্বর ছিল খুবই দুর্বল। অগোছালো বিছানা, মেঝেয় ছড়িয়ে থাকা ওষুধের স্ট্রিপ্স। পত্র পত্রিকা, অধিকাংশই শেয়ার বাজার সংক্রান্ত। মেডিকেল রিপ্রেসেনটেটিভের চাকরির আড়ালে শেয়ার বাজারেও কিছু টাকা ইনভেস্ট করেছিল সে, বন্ধু বান্ধবের থেকে ধার করে। এ কথা দীপ নিজেই জানিয়েছিল আমায়।
—দিনকাল যা পড়েছে তাতে চাকরির বাইরেও একটা সোর্স অফ ইনকাম থাকা দরকার। শেয়ার মার্কেটে ট্রাই নেওয়া যেতে পারে কি বলিস!
আমি যেহেতু বাবার হোটেলে, ওসব নিয়ে কোনও মতবাদই তৈরি হয়নি আমার। বরং মনে হয়েছিল এক অদৃশ্য বিশৃঙ্খলা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ভেতরে। যেন তেন প্রকারে রোজগার বাড়িয়ে নেওয়ার এক অবাধ্য প্রবণতা কাজ করছে সেখানে।
অঙ্কটা সেদিন মিলিয়ে দিয়েছিল বিদিশাই। সে বলেছিল, দীপের বাড়ির কারও মত নেই। কারণ আমরা বড়লোক। আমার বাবার কলকাতায় দুটো ফ্ল্যাট আছে, গাড়ি আছে। ওরা নাকি কোনওভাবেই আমাদের সমকক্ষ হতে পারবে না। আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাকিয়েছিলাম বিদিশার দিকে। ও হঠাৎ রিডিকিউলাস বলে উঠে গেল আমায় পাশ কাটিয়ে। জানালার ধারে সাইড হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো একটা। ঝলমলে ওয়ান পিস। টানটান শরীরে চেপে বসে আছে হাঁটু অবধি। আমার চোখ পড়ল ঘরে রাখা আয়নায়। বিদিশার সাইড ফেস সেখানে ফুটে উঠেছে নিখুঁত এক ফ্রেমে। ধারালো চোখ, ধারালো নাক, ঈষৎ লম্বাটে চিবুক। সঙ্গে একরাশ ঔদ্ধত্য। এক অতীন্দ্রিয় আলো যেন ছড়িয়ে পড়ল আয়নাটায়। জানান দিল এই ঔদ্ধত্যই তার ভূষণ।
হাওড়া বর্ধমান মেইন লাইনে দু-এক বার আসতে হলেও চন্দননগর শহরটাতে আগে কখনও আসা হয়নি আমার। গঙ্গার ধারেই কোর্ট। জজসাহেব এজলাসে ওঠার আগেই দীপ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ওর ল’ইয়ারের সঙ্গে। সেরে নিচ্ছিল দরকারি কথাবার্তা, সইসাবুদ। বিদিশাকে চোখে পড়েনি তখনও। সম্ভবত এসে পোঁছায়নি। ওকেও তো আসতে হবে সেই কলকাতা থেকে। নেহাত কাগজে কলমে দীপের বাড়ি চন্দননগর তাই, না হলে এই কেস কলকাতাতেই ওঠা উচিত। অন্তত সব পক্ষের সুবিধার কথা ভেবে।
আমি চারপাশটা ঘুরে দেখছিলাম একটু। ল’ইয়ারদের বসার জন্য লম্বা টিনের শেড। পর পর সব টাইপ রাইটার নিয়ে বসে আছে ল’ক্লার্করা। লিগ্যাল পেপারে খটাখট টাইপ করে চলেছে কিসব। ভারি অবাক লাগলো আমার। আজকের পৃথিবীতে একমাত্র এই আদালত চত্বরই মনে হচ্ছে টাইপ রাইটার নামক যন্ত্রদের একমাত্র বিচরণভূমি কিম্বা অভয়ারণ্য। বাকি পৃথিবী পুরোটাই কমপিউটারের দখলে। সে যাই হোক, দলে দলে মানুষজন আসছে এক পরাবাস্তব জগতের মতো। দেখলেই বোঝা যায় বেশিরভাগই দূর দূরান্ত থেকে। চেহারায় দারিদ্র, আচরণে গ্রাম্য ভাব যেন কোনও ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছে না জেনে বুঝে। এদের সবাইকেই আমার একই রকম মনে হচ্ছে। অনেকটা ভিড়ের মতো, অ্যামরফেস। সাদা জামা, কালো কোট, জড়ো হচ্ছে অ্যাডভোকেটরাও। তাদের কেউ বাদী পক্ষে কেউ ফরিয়াদি। কারও হাতে রিট পিটিশন, কেউ ব্যস্ত মোবাইলে শেষ মুহূর্তের আলোচনা সেরে নিতে। বাড়ছে মুহুরিদের আনাগোনাও। তাদের চোখে লোলুপ দৃষ্টি।
কোর্ট কমপাউন্ডের মধ্যে কোনও চা দোকান নেই। আমি কম্পাউন্ডের বাইরে গেলাম। গঙ্গার ধার বরাবর বাঁধানো স্ট্র্যান্ড। মানুষজন বসে আছে উদ্দেশ্যহীন। নদীর হাওয়া খাচ্ছে। কারও কারও মুখজুড়ে গাছের ছায়া। পাতার ফাঁক দিয়ে আলোর ক্ষুদ্রতম গতিবিধি ধরা দিচ্ছে নিখুঁত কোরিওগ্রাফে। কতগুলো স্ট্রিট চাইল্ড খেলে বেড়াচ্ছে নিজেদের মধ্যে। এক অপরিণত বয়স্ক হবু মা তাকিয়ে আছে সেদিকে রহস্যময়, জটিল, অবাস্তব স্বপ্ন দেখার মতো। ক্লোজ সিকোয়েন্সে ওরা এমনভাবে ধরা দিচ্ছে যেন বিখ্যাত কোনও ভাস্করের ভাস্কর্য, গেঁথে আছে শহরটার বুকে। ভেসে যাচ্ছে
দু-একটা ডিঙি নৌকো। পাশেই ফেরিঘাট। এইমাত্র একটা লঞ্চ ছেড়ে গেল চূড়ান্ত উদাসীন ভঙ্গিতে। গঙ্গানদী বাঁক নিয়েছে এখানে। একটা প্যানারমিক ভিউ মন্দ হবে না। ভাবতে ভাবতে সিগারেট ধরালাম। একরাশ ধোঁয়া সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল বাতাসে।
চা খেয়ে ভেতরে এলাম আমি। জজসাহেব তখন উঠে গেছে এজলাসে। কাঠগড়ায় অন্য দুজন নারী পুরুষ। তাদের বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হলেই আমার বন্ধু আর তার বউয়ের পালা। আদালত কক্ষে হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখলাম বিদিশাকে। একটু আগেই এসেছে মনে হচ্ছে। ওর বাবা-মার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়। আমাদের উলটো দিকে। বরাবরের মতো আজও কেয়ারলেস বিউটি মনে হচ্ছে তাকে। বিদিশা ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলছে নিচু গলায়। মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছে। হাত চালাচ্ছে চুলের ভেতর। মুখ মুছছে ওয়েট টিস্যু দিয়ে। যেন শট রেডি। ওর ডাক পড়বে এখনই। ওকে দেখে তারকোভস্কির সিনেমার সেই বিখ্যাত দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেল আমার। শস্যাগারে আগুন জ্বলছে আর তার বিপরীতে অদ্ভুত এক কাব্যিক ভঙ্গিমায় চুল ধুয়ে চলেছে সিনেমার নায়িকা। আমি দূর থেকেই ক্যামেরা ধরে রাখি তার ওপর। বিদিশা হাত নাড়ে আমার উদ্দেশে, ভাবখানা এমন যেন তার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলেছে এই কাহিনী।
আদালত কক্ষটিকে হঠাৎ এক স্মৃতি এবং স্বপ্নের মিশ্রণ মনে হয় আমার। পুরোনো বিল্ডিং, বড় বড় থাম। মাথার ওপর কড়িবরগা। সিলিং থেকে নেমে এসেছে লম্বা লম্বা ব্লেডওয়ালা পাখা। ঘুরে চলেছে এক লুকোনো সংকেতে, ক্যাঁচকোঁচ শব্দে, যেন কত বেদনা লুকিয়ে আছে ওটার ভেতর। আমি হঠাৎ তারিখ ভুলে যাই আজকের। নির্দয়ভাবে ক্যামেরা তাক করি দীপের ওপর। খুব কাছ থেকে। ওর মুখের প্রতিটা পেশী স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার চোখে। ধরা পড়ছে আশ্চর্য রকমের শিথিলতা, ঝুলে পড়া চোয়াল। যেন এক অন্ধকার আর ফ্ল্যাক্সিড জীবনের জন্যে অপেক্ষা করছে সে আদালত কক্ষের বেঞ্চে বসে।
আগের দু’জনের বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়। ডাক পড়ে দীপ আর বিদিশার। ওরা কাঠগড়ায় দাঁড়ায় পাশাপাশি। উকিলবাবু বলতে শুরু করেন, ইয়োর অনার, মাই ক্লায়েন্ট মিসেস বিদিশা ঘোষ…। হঠাৎই যেন স্বর পরিবর্তন ঘটে আদালত কক্ষের। স্টক ফুটেজের মতো পরপর ঘটে যেতে থাকে সবকিছু। দীপ আর বিদিশা যান্ত্রিক স্বরে উত্তর দিতে থাকে জজসাহেবের প্রশ্নের।
আদালতের বাইরে এসে বিদিশা বলে, এখান থেকে সোজা হসপিটালে যাব। আমার এক কলিগ ভর্তি রয়েছে বাইক অ্যাকসিডেন্ট করে। বলতে বলতে গাড়িতে উঠে যায় সে। দরজা বন্ধ করে নেয়। কিছু চরিত্র সবসময়ই আবির্ভূত হয় তারপর অদৃশ্য হয়ে যায় তাদের কাজ শেষ করে। বিদিশাকে আমার তেমনই মনে হয় এই মুহূর্তে, তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
দীপ জিজ্ঞেস করে, বিচ্ছেদ কেন হয়! আমরা কি সারা জীবন শুধু ভুলই করি! তার কন্ঠস্বরে অনুশোচনা হয় আমার। অথচ অনুশোচনার জন্য তো একটি অপরিহার্য অনুভূতি থাকা প্রয়োজন। ভাবতে অবাক লাগে এই ব্যাপারে সেই প্রত্যক্ষ অনুভূতি কোনও দিনই নেই আমার। আমি আগে কখনও ডিভোর্স দেখিনি আমার পরিবার কিম্বা বন্ধু বান্ধবের মধ্যে। বিচ্ছেদের পর ঠিক কি হয় সে সংক্রান্ত কোনও ব্যক্তি অভিজ্ঞতাও নেই আমার। ডিভোর্স শুধুমাত্র সিনেমায় দেখেছি কিম্বা সোশ্যাল মিডিয়ায়। খবরের কাগজেও পড়েছি এক সময়। দীপ বলে চলে তার জীবনের প্রেমহীনতা এবং মানসিক আঘাতের কথা। আমরা হেঁটে চলি গঙ্গার ধারের সেই বাঁধানো স্ট্র্যান্ড বরাবর। এখন ভরা দুপুর। কোথায় যাব, বাকি সময় কীভাবে কাটাব ঠিক নেই কিছুই। দু’জনে হেঁটে চলেছি উদ্দেশ্যহীনভাবে যেন বের হয়েছি অজানা কোনও তীর্থযাত্রার উদ্দেশে। বুঝতে পারি একটা ক্যামেরা অবচেতনে তখনও ফলো করে চলেছে আমাদের। আলো-আঁধারির ব্যারিকেডের মতো ঢেকে দিচ্ছে আমাদের হেঁটে যাওয়া।
ফেরার পথে ট্রেনে বসে মনে হয় একটা সিনেমা বানাবো দীপ আর বিদিশাকে নিয়ে। জানালার বাইরে কতগুলো মোটিফ ভেসে ওঠে। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, নির্জন একটা বাড়ি। বাড়ির পাশে ছোট্ট জলাশয়। রহস্যময় কুয়াশার আনাগোনা। সিনেমার শেষ দৃশ্যে ফিরে আসে ওরা, সেই নির্জন বাড়িতে। কুয়াশা কেটে রোদ ওঠে। জলের ওপর ছায়া পড়ে বাড়িটার। দূর থেকে ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া কোনও প্রাচীন গানের সুর।