সিদ্ধার্থ সিংহ
একজন মালি ছিল। সে কাজ করত ব্রহ্মদেশের রাজার বাগানে। বাগানটা ভারি সুন্দর। নানান গাছগাছালিতে ভরা। ফুলে-ফুলে ছাওয়া। বাগানটা রাজার এত প্রিয় ছিল যে, রানিকে নিয়ে মাঝে মাঝেই তিনি বিকেলের দিকে ঘুরতে আসতেন। তাই বাগানটাকে সব সময় পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখার জন্য প্রায় সারাক্ষণই বাগানের পিছনে পড়ে থাকত সে। কখনও গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিত। কখনও সার দিত। কখনও গাছগুলোকে স্নান করিয়ে দিত, তো কখনও অবাঞ্ছিত ডালপালা ছেঁটে দৃষ্টিনন্দন করে তুলত গাছগুলোকে। কখনও আবার নতুন নতুন চারা পুঁতত।
গাছপালা নিয়ে দিন-রাত এতই ব্যস্ত হয়ে থাকত যে, বাড়ি যাবারই ফুরসত পেত না সে। বাগানের এক কোণেই পড়ে থাকত। নিজের বলতে থাকার মধ্যে ছিল তার একটা বউ। আর একটা মুরগি। আর সেই মুরগির ছ’-ছ’টি ছানা। তার কোনও ছেলেপুলে ছিল না। তাই মুরগিগুলোকে সে খুব ভালবাসত। মনে করত, ওই মুরগিটাই তার মেয়ে আর ছানাগুলো তার নাতি-নাতনি।
বিষয়-সম্পত্তি না থাকলেও তার মনে কোনও খেদ ছিল না। বেশ সুন্দর ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ একদিন এক বৌদ্ধ পুরোহিত এসে হাজির হলেন তার বাগানের সামনে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, আমি অনেক দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি। আমি ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত। মাথা গোঁজার জন্য একটুখানি ঠাঁই চাই।
মালি আর মালি বউ গরিব হতে পারে, কিন্তু তা বলে বাড়িতে কোনও অতিথি এলে তাকে ফিরিয়ে দেবে, এটা হতে পারে না। অতিথি তো দেবতার মতো। তা ছাড়া ইনি একজন পুরোহিত। তাই ওরা দু’জনে তাঁকে অত্যন্ত আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে গেল। ঘরে যা ছিল খেতে দিল। গাছ থেকে ডাব পেড়ে দিল। ঘরের একচিলতে খাটটা ছেড়ে দিল বিশ্রাম করার জন্য।
আদর-যত্নের কোনও ত্রুটি রাখতে চায় না তারা। আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু পরের দিনের কথা ভাবতেই আঁতকে উঠল তারা। মাথায় হাত পড়ে গেল। চাট্টি চাল ছাড়া ঘরে যে আর কিছু নেই। নিজেরা না-হয় সেটাই একটু ফুটিয়ে ফেনা-ভাত খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারে, কিন্তু অতিথির পাতে তো আর তা দেওয়া যায় না। অন্য দেশের পুরোহিত হলে না-হয় বাগানের ফলমূল দিয়ে খাবার থালা সাজিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু এ যে ব্রহ্মদেশের পুরোহিত। আমিষ ছাড়া খেতেই পারেন না। কী করা যায়! বাজারও বেশি দূরে নয়, মাছ-মাংস তরি-তরকারি আনা যায় ঠিকই, কিন্তু সেগুলো যে কিনবে, টাকা কোথায়! পকেট যে একদম খালি!
স্বামী যখন এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একেবারে দিশেহারা, ঠিক তখনই মালিবউ বলে উঠল, পেয়েছি পেয়েছি, একটা উপায় পেয়েছি।
—উপায়? কী উপায়? মালি কৌতুহলী চোখে বউয়ের দিকে তাকাতেই বউ বলল, আমাদের মুরগি আছে না?
—মুরগি?
—হ্যাঁ, মুরগি। গরম গরম ভাত আর মুরগির মাংস করলে কেমন হয়?
মুরগিটাকে খুব ভালবাসত মালি। তাই বউয়ের কথা শুনে শিউড়ে উঠল সে। বলল, এ কী বলছ তুমি?
—কেন? কী হয়েছে? মুরগিটাকে যদি কাটিও, মুরগির ছানাগুলো তো আছে। দেখবে, ক’দিন পরে ওরাও বড় হয়ে যাবে। ডিম দেবে।
—সে ঠিক আছে। কিন্তু তা বলে সেই ছোট্টবেলা থেকে এত দিন ধরে যাকে নিজের হাতে খাইয়ে-দাইয়ে আদর-যত্ন করে বড় করেছি, সেই মুরগিটাকে কেটে ফেলব! না, আমি পারব না। কিছুতেই পারব না। কান্না ভেজা গলায় ফুঁপিয়ে উঠল মালি।
স্বামীকে দুর্বল হয়ে পড়তে দেখে কঠিন গলায় বউ বলল, ঠিক আছে, তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব।
—মুরগিটাকে তুমি কেটে ফেলবে! আর থাকতে পারল না মালি। ডুকরে কেঁদে উঠল। তার মনে হল, তার বুকের ভিতরটা কেউ বুঝি হামান-দিস্তে দিয়ে মেরে মেরে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।
—হ্যাঁ, কাটব। কারণ, অতিথি হল নারায়ণ। নারায়ণ সেবা সবার আগে। তুমি আমাকে বাধা দিয়ো না।
মালি আর তার বউ যখন দাওয়ায় বসে এই কথাগুলো বলছিল, মুরগিটা তখন উঠোনে খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছিল। জন্ম থেকেই এ বাড়িতে আছে সে। সেই জন্য ওদের দু’জনের কথাই খুব ভাল ভাবে বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারল, আজই তার শেষে রাত। অগত্যা বাচ্চাদের কাছে ডেকে নিয়ে সে বলল, একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোন। কান্নাকাটি করিস না।
‘কান্নাকাটি করিস না’ শুনেই এক অজানা আতঙ্কে বাচ্চাগুলোর বুক ধকধক করতে লাগল। এ ওর মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তার পর উন্মুখ হয়ে তারা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? কী হয়েছে?
খুব ধীরে-সুস্থে শান্ত গলায় মুরগি বলল, আজই আমার শেষ রাত। কাল সকালেই আমি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব।
—কেন মা? কেন? মুরগির বাচ্চাগুলো একসঙ্গে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করল।
মুরগি বলল, দেখিসনি, এ বাড়িতে একজন অতিথি এসেছেন। তাঁকে খাওয়ানোর মতো ঘরে কিছু নেই। তাই আমাকে কাল সকালে কেটে রান্না করে তাকে খেতে দেওয়া হবে। তোরা লক্ষ্মীসোনা হয়ে থাকবি। কেউ কারও সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটি করবি না। আর তোরা যদি ভাল হয়ে না-থাকিস, তা হলে আমি কিন্তু মরেও শান্তি পাব না।
ছানাগুলো মায়ের কথা শুনবে কী! তারা তো কেঁদেই আকুল। তখন ওদের মা ওদের অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করে বলল, তোরা এত কাঁদছিস কেন? জন্মালে তো মরতেই হবে। আমি তো আর চিরকাল থাকব না। আমাকেও একদিন না-একদিন মরতে হবে। না-হয় দু’দিন আগেই মারা গেলাম। তাও, এটা তো আমার সৌভাগ্য যে, একটা ভাল কাজের জন্য আমি জীবন দিচ্ছি। অতিথি সেবার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করছি। এটা কি চাট্টিখানি কথা!
ছানাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি যদি মরে যাও, আমরা কার কাছে থাকব? তোমাকে ছাড়া আমরাও আর বাঁচতে চাই না। তুমি মরলে, আমরাও তোমার সঙ্গে মরব।
ওদের মা ওদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সে কথায় ওরা কান দিল বলে মনে হল না।
পরদিন খুব ভোরে মুরগিটার ঘরে গিয়ে মালিবউ উঁকি মেরে দেখল, মুরগি তার ছ’টি ছানাকে তার পাখনা দিয়ে গভীর মমতায় আগলে নিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সেই দৃশ্য দেখে মালিবউয়ের খুব মায়া হল। কিন্তু কী করবে সে! ঘরে যে কিচ্ছু নেই। অথচ অতিথি-সেবা বড় সেবা। সেটা না করলেই নয়। তাই হাত কাঁপলেও, মন না-চাইলেও, খুব সন্তর্পণে বাচ্চাদের কাছ থেকে আলতো করে মুরগিটাকে তুলে আনল সে। নিজেই ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে, কেটেকুটে সাফ করল। তার পর মশলা দিয়ে খুব ভাল করে কষিয়ে মাখল। উঠোনের এক ধারে তিন ঝিকের উনোনে, যেখানে রোজ তাদের রান্না হয়, সেখানে কাঠকুটো দিয়ে আগুন ধরাল। তাতে চাপিয়ে দিল কড়াই। কড়াইয়ের জল ফুটতেই, ঝোল করার জন্য তার মধ্যে ফেলে দিল দিতে লাগল সেগুলি।
মালিবউ খেয়াল করেনি, মুরগিটাকে আস্তে করে তুলে আনার সময় ছ’টি ছানারই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারা যখন আড়াল-আবডাল থেকে দেখল, তাদের মাকে কেটে টুকরো টুকরো করে কড়াইয়ের গরম জলের মধ্যে মালিবউ ফেলে দিচ্ছে, তখন তারা আর স্থির থাকতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে একসঙ্গে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ওই কড়াইটার মধ্যে ঝপাঝপ করে দল বেঁধে ঝাপ দিল।
এ রকম যে হতে পারে, মালি বা মালিবউ, কেউই তা কল্পনা করতে পারেনি। শুধু মুরগি নয়, মুরগির সঙ্গে সঙ্গে তার বাচ্চাগুলোকেও এই ভাবে খুইয়ে হু হু করে উঠল তাদের বুক। দুঃখে বুক ফেটে যেতে লাগল। তবু তারা মুখে কোনও রা করল না। কোনও রকমে নিজেদের সামলে নিল। তার পর মায়ের সঙ্গে ছানাগুলিকেও একটা বড় জামবাটি করে অতিথির সামনে পরিবেশন করল মালিবউ। বড় তৃপ্তি করে খেলেন তিনি।
খাওয়া-দাওয়া সেরে সেই বৌদ্ধ পুরোহিত যখন যাবার জন্য উঠোনে এসে দাঁড়ালেন, তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য মালি আর মালিবউও সেখানে উপস্থিত। তারা তাঁকে বিদায় জানাতে না-জানাতেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল তাদের চোখের সামনে। স্বামী স্ত্রী দু’জনেই অবাক হয়ে দেখল, না, হেঁটে নয়, সেই অতিথি হঠাৎ হুস করে সোজা উপরে উঠে গেলেন। তিনি যখন উঠছেন, তাঁর শরীর থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগল শ্বেতশুভ্র উজ্জ্বল এক আলোক ছটা। মালি আর তার বউ দু’জনেই সে দিকে তাকিয়ে রইল। দেখল, সেই বৌদ্ধ পুরোহিত কেমন ছোট হতে হতে মহাশূন্যে একেবারে মিলিয়ে গেলেন।
স্বামী-স্ত্রী বুঝতে পারলো, যিনি তাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন, তিনি কোনও সাধারণ মানুষ নন। হয় কোনও দেবতা, আর তা না হলে কোনও সিদ্ধপুরুষ।
সে দিন রাতেই তারা টের পেল, তাদের অনুমান মিথ্যা নয়। স্বপ্নেই তারা জানতে পারল, স্বয়ং দেবতাই ছদ্মবেশে পৃথিবীতে এসেছিলেন মানুষের মন পরীক্ষা করার জন্য। অতিথি সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাদের আশীর্বাদ করলেন। সেই আশীর্বাদে স্বামী-স্ত্রীর যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে গেল।
অন্যদিকে মুরগি আর তার ছ’-ছ’টি ছানার উপরেও দেবতা যারপরনাই প্রসন্ন হলেন। তাঁর বরে পরের জন্মে তাদের জন্ম হল দেবলোকে। আকাশের অনেকখানি জায়গা নিয়ে তারা থাকতে শুরু করল। দেবলোকে জন্মগ্রহণ করে তারা তো অমর হয়ে গেছে। তাই আজও রাত্রিবেলায় আকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় বিন্দু বিন্দু আলোর ছটা দিয়ে তৈরি একটা বিশাল জিজ্ঞাসা চিহ্ন। না, ওগুলো কিন্তু আলোর ছটা নয়। আসলে সাত-সাতটি তারা। যাকে পৃথিবীর মানুষ জনেরা বলে— সপ্তর্ষিমণ্ডল। ব্রহ্মদেশের লোককথায় নাকি ওই সাতটি তারাই হল, সেই মুরগি আর কার ছ’-ছ’টি ছানা।